শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • সারাদেশ
  • খাগড়াছড়ির রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে শেষ হলো বারনী স্নান উৎসব

খাগড়াছড়ির রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে শেষ হলো বারনী স্নান উৎসব

খাগড়াছড়ির রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে শেষ হলো বারনী স্নান উৎসব

খাগড়াছড়ি, ৩১ মার্চ , এবিনিউজ : খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা রামগড় উপজেলায় উৎসবের আমেজ গুটিয়ে দিতে পারে দু’দেশের কাঁটা তারের সীমারোখা, ভারতের দক্ষিন ত্রিপুরার সাব্রুমের বারুনী মেলায় গিয়ে দেখা গেল এমনই চিত্র। ভারত-বাংলাদেশের অজস্র মানুষের অংশগ্রহণে উৎসব মুখর হয়ে উঠে গোটা সাব্রুম। প্রতিবারের ন্যায় এবারও দুই বাংলার মানুষ মিলিত হয়েছিল বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবব্রুম সীমান্তের ফেনী নদীতে। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য দু’দেশের অঘোষিত সম্মতির উম্মুক্ত বিচরণ এ মেলায় উভয় দেশের মানুষ পালন করেছে উৎসবটি। দু’ বাংলার সকলেই চান অনন্তকাল জুড়ে অব্যাহত থাকুক অঘোষিত এ উদ্যোগ। রোববার ঐতিহ্যবাহি বারুণী স্নানোৎসবকে ঘিরে রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে ফেনী নদীতে সকাল থেকে সন্ধ্যাব্দি মুখরিত হয়ে উঠে লাখো পুণ্যার্থী ও দর্শণার্থীর সমাগমে। প্রতিবছর বারুনী মেলাকে ঘিরে(১দিন) সবার জন্য সীমান্ত উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নদীর পাড়ে বিপুল সংখ্যক উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ছাড়াও পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি, জীবনে পূর্ণতা পাওয়া এবং সব ধরণের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির আশায় প্রায় শতাধিক বছর আগে থেকে চৈত্রের মধুকৃষ্ণের ত্রয়োদশী তিথিতে প্রতি বছর ফেনী নদীর পারে বারনী মেলায় মিলিত হোন দুই বাংলার মানুষ। বাংলাদেশ পার্বত্যাঞ্চল খাগড়াছড়ি আর ত্রিপুরার মধ্যখানে রয়েছে ছোট্ট নদী “ফেনী”। ছোট্ট এই নদীটি ভাগ করে রেখেছে দুই দেশকে। এপারে বাংলাদেশের রামগড় উপজেলা আর ওপারে ভারতে ত্রিপুরার সাব্রুম অঞ্চল। নদী পার হয়ে মাত্র কয়েক’শ গজ হাটলে সাব্রুম বাজার। যেখানে প্রতিবছর হিন্দু ধর্মাবলম্বীতে ধর্মীয় উৎসব বারুনী স্ন্যান উপলক্ষ্যে বসে বারুনী মেলা। সকাল ৭টা থেকেই শুরু হয় বারুণী স্নানোৎসব। স্নান কিংবা পুজা আর্চণা ছাড়াও দুই দেশে বসবাস আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অনেকে ছুটে আসেন দূর দূরান্ত থেকে। সময় মাত্র ১২ঘন্টা। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। এরই মধ্যে কাজ সেরে, ফিরতে হবে নিজ দেশে। নয়তো অবৈধ অভিবাসির দায়ে থাকতে হবে শ্রীঘরে। তাইতো হাজারো মানুষ যে যার মতো পার হচ্ছে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম সীমান্তের ফেনী নদী দিয়ে। কেউ যাচ্ছেন স্বজনদের সাথে দেখা করতে, কেউবা নিজ জন্মভূমির প্রতিবেশি দেশকে দেখার কৌতোহলে। আবার অনেকেই যাতায়াত করেন বাণিজ্যের উদ্দেশে। তবে, বছরে কয়েক ঘন্টার জন্য পাওয়া এ সুযোগ ছাড়তে নারাজ দু’বাংলার মানুষ। বারুণী মেলায় শুধু বাঙালি হিন্দু স¤প্রদায়ের অংশগ্রহণ নয়, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, মুসলিম সকল স¤প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। এটি ধর্মীয় উৎসব হলেও দু’দেশের বিভিন্ন জাতি, স¤প্রদায় ও ধর্মের মানুষের সমাগমে সার্বজনীন আনন্দ মেলার ঐতিহ্যে পরিনত হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার রামগড় উপজেলা বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ফেনী নদী পার হয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশী এ মেলায় অংশগ্রহন করছে। নদীর মাঝখানে শতাধিক সাধকের মন্ত্র নিয়ে ¯œ্যান করছে হিন্দু ধর্মালম্বীরা। দুই পার্শ্বে শত শত নিরাপত্তা কর্মী বিজিবি-বিএসএফ কঠোর ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। প্রথম অবস্থায় দর্শনার্থীদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দু’দেশের প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁধা দেয়ার চেষ্ট করা হয়েও বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত উপচেপড়া মানুষের ঢেউকে রুখতে পারেনি উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সীমান্ত অতিক্রম করা অনেকটাই সহজ ছিল। কারণ এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানি কম ছিল। নদী পার হয়ে মাত্র কয়েকশ গজ হাটলেই দেখা মিলে সাব্রুম বাজার। প্রথমেই ঘুরে দেখলাম পুরো বাজারটি। বাজারের প্রতিটি দোকানেই ছিল ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। মূল মার্কেটে যেতে হয় সাব্রুম থানার সামনে দিয়ে। এখানে বসানো হয়েছে পুলিশের বিশেষ চেক পোষ্ট। এর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কজন ভারতীয় পুলিশ। বাংলাদেশীদের দু’এক জনকে এরই মাঝে আটক করা হয়েছে শুনে মনের মধ্যে কিছুটা ভয় আসে। আমাদের গ্রুপে ছিল ঢাকা থেকে আসা বিজয় টিভির বিশেষ প্রতিনিধি মোকাররম মামুন, দৈনিক ইত্তেফাক এর সাংবাদিক মিল্টন চাকমা, দৈনিক স্রংগ্রমের প্রতিনিধি মোঃ আব্দুল আলী, বাংলা নিউজের ফেনীর ষ্টাফ রিপোর্টার ডালিম হাজারী, দৈনিক পূর্বকোণের মোঃ শাহ আলম রানা। মেলায় ঘুরাঘুরি ফাঁকে চোখে পড়লো সাব্রুম প্রেসক্লাব। দেখা হলো সাব্রুম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মান্না চৌধুরীর সাথে। তিনি সাথে নিয়ে ঘুরে দেখালেন পুরো শহর। পরিচিত হলাম ভারতীয় পত্রিকা দৈনিক সংবাদ এর সাব্রুম প্রতিনিধি বন্ধন দাসসহ বেশ কজন সাংবাদিকের সাথে। মেলায় ঘুরতে আসা ভারতীয় দর্শনার্থী সাব্রুম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী(৪ বান্ধবী) তুন্না সরকার, সুইটি মগ ও রিতা পাল জানান, প্রতিবছর বারুনী মেলায় বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ আসে, আমরাও তাদের দেশে যাই। এ মেলাকে ঘিরে উভয় দেশের মানুষের মাঝে গড়ে উঠে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই দিনটিকে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের অতিথিদের নিয়ে দারুন ভাবে উপভোগ করি। সারাদিন কেনাকাটা, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ আর আনন্দ-উল্লাস শেষে বিকেলে নিজ দেশে ফেরার পালা। ফেরার সময় তেমন একটা বাধাঁন সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে জেনে রাখা ভাল, ভারতীয় পণ্য ক্রয় করে মূল ফটক দিয়ে না আসাই উত্তম। কারন মূল ফটকে সবসময় বিএসএফ অবস্থান করে। সুতরাং সামান্য অসাবধানতাই তীরে এসে তরি ডুবার কারন হতে পারে। এদিকে রামগড় বাজার মুখরিত হয়ে উঠে ভারতীয়দের কেনাকাটা ও পদচারণায়। বারুণী মেলা উপলক্ষে দু’দেশের সীমান্ত অঘোষিত ভাবে উন্মুক্ত থাকায় ওপারের সাব্রুম থেকে হাজার হাজার ভারতীয় বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ধেয়ে আসে রামগড়ে। একইভাবে রামগড় থেকেও ওপারে যান অগণিত মানুষ। ভারতীয়রা রামগড় বাজার থেকে সেমাই, নারিকেল, সাবান, শুটকি মাছ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। আবার ওপারের সাব্রুমের থেকেও এপারের লোকজন বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে আনে। আর কেনা কাটার সুবিধার্থে রামগড় বাজারের অলিগলিতে কতিপয় লোক দুদেশের টাকা বদলের ব্যবসা করেছে। রামগড় বাজারে আসা ভারতীয়রা ১০০রুপিতে বাংলাদেশী ১০০টাকা হারে পেলেও সাব্রুমে বাংলাদেশীরা ১০০টাকার পরিবর্তে ভারতীয় ৭৫রুপি করে পেয়েছে। ঐতিহ্যবাহি এ বারুণী মেলা সম্পর্কে রামগড়ের অধিবাসি ও অসরপ্রাপ্ত সহকারি জেলা শিক্ষা অফিসার রামেশ্ব শীল বলেন, ভারত বিভক্তির পূর্বে এখানে বারুণী মেলায় বাংলাদেশ ভারত দু’দেশের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পুণ্যার্থীর সমাগম হত। পাকিস্তান আমলেও ফেনী নদীতে বারুণী মেলা বসতো। অবশ্য তখন দুদেশের সীমান্ত পারাপারের সুযোগ ছিল না। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এ মেলাকে ঘিরে সীমান্ত আইনের অঘোষিত শিথিলতার কারণে দুদেশের মানুষ একে অপরের সান্যিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ মেলাটি এখন দু’দেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় রীতি পালনের পাশাপাশি দুদেশে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনদের দেখা সাক্ষাতেরও একটি চমৎকার ক্ষেত্র হয়েছে এ বারুণী মেলা।’ দুই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসেন আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে। বাঙ্গালী হিন্দু ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা সমপ্রদায়ের অসংখ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয় এখানে। চট্টগ্রাম, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি প্রভৃতি এলাকা থেকে অসংখ্য নারী পুরুষ পুণ্যস্নানে অংশ নিতে ছুটে আসেন ফেনী নদীতে। বাংলাদেশ ভারত দু’ দেশের পাহাড়ি বাঙ্গালী, বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও স¤প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবণিতার বিপুল সমাগমে ফেনী নদী পরিণত হয় এক মিলন মেলায়।

এবিএন/ চাইথোয়াই মারমা/জসিম/নির্ঝর

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত