শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

পাহাড় জুড়ে প্রাণের উৎসব বৈসাবির আমেজ

পাহাড় জুড়ে প্রাণের উৎসব বৈসাবির আমেজ

খাগড়াছড়ি, ০৬ এপ্রিল , এবিনিউজ : উপজাতীয় স¤প্রদায়ের প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বৈসাবি। বৈসাবিকে ঘিরে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণের ছোঁয়া। নব আনন্দে জাগে পাহাড়ের উপজাতিরা। আর এ উৎসবে সামিল হতে আগে থেকেই যাতায়াত ও থাকার ব্যবস্থা করে রাখে পর্যটকরা। আগামী ১২ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত খাগড়াছড়ির হোটেল-মোটেল কিংবা পরিবহনের সিট ইতোমধ্যেই বুকিং হয়ে গেছে। প্রতিবছর বৈসাবি আমেজ উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে খাগড়াছড়ির সবুজ পাহাড়ে। তবে হোটেল-মোটেলে সিট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত এসব পর্যটকের আশ্রয় মিলে উপজাতিদের মাচাং ঘরে। চৈত্রের শেষ দুদিন এবং পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষকে ভিন্নরূপে উদযাপন করে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ। পাহাড়, হ্রদ ও সবুজ অরণ্যের শহর রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের অধিবাসীদের প্রাণের উৎসব বর্ষ-বিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি চাকমাদের ভাষায় এ উৎসবকে বিঝু, ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক, মারমাদের ভাষায় সাংগ্রাইং, তংচঙ্গাদের ভাষায় বিষু ও অহমীয়দের ভাষায় বিহু নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এছাড়া ম্রো স¤প্রদায়রা ক্লবং পাই নামে উৎসবটিকে পালন করে। প্রধান তিন স¤প্রদায়ের প্রাণের এ উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই এ মহান উৎসবকে বলা হয় বৈসাবি। কেউ কেউ বৈসাবি নামকরনটি মেনে নিতে না পারলেও পার্বত্যাঞ্চলে এ নামটি বহুল পরিচিত ও আলোচিত। তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুলবিঝু, দ্বিতীয় দিনকে মূলবিঝু এবং তৃতীয় দিনকে নুয়াবঝর বা গেজ্যা পেজ্যা দিন বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে হারিকুইসুক, দ্বিতীয় দিনকে বুইসুকমা এবং তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল নামে অভিহিত করে থাকে। মূলত এটি পাহাড়ি স¤প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হলেও বাঙ্গালী স¤প্রদায়ও সমান তালে উপভোগ করে এ উৎসব। এ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে প্রতিবছর দেশি-বিদেশি হাজার হাজার মানুষ পাহাড়ে ভিড় জমায়। ঘরে ঘরে নামে অতিথিদের ঢল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকলে একাকার হয়ে যায় বৈসাবির আনন্দে। এ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আনন্দ র‌্যালি বের করা হয়। তরুন-তরুনীদের জন্য আয়োজন করা হয় পানি খেলার। বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখি মেলা ও উপজাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বৈসুক: ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং প্রধানতম উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রমাসের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথম দিন মোট তিনদিন পালন করা হয় এ উৎসব। উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড়-চোপর ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মোরগ-মুরগীকে ছিটিয়ে দেয়। ত্রিপুরা নব দম্পতি ও যুবক-যুবতীরা নদী থেকে কলসি ভরে পানি এনে গুরজনদের গোসল কারনোর মাধ্যমে আর্শিবাদ গ্রহণ করে। গৃহপালিত সব প্রাণীকে খুব ভোরে ছেড়ে দেয়। পরিষ্কার পরিছন্ন কাপড়-চোপড় পড়ে ছেলেমেয়েরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরর দিন থেকে গরয়া নৃত্যদল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য করে। এ আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা গরয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে থাকে। এ নৃত্যে ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। নৃত্য শেষে শিল্পিরা উপঢৌকন হিসাবে পাওয়া সামগ্রী গরয়া দেবতার পূজা করে। কোন শিল্পী একা গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেয় না। নৃত্যটিতে ১৬,১০০,১৫০, থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে।

সাংগ্রাইং: পাহাড়ের মারমা স¤প্রদায়ের লোকজন তিন দিন ধরে সাংগ্রাইং উৎসব পালন করে। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাইং। মারমারা সাধারণত মঘিসনের চন্দ্র মাস অনুসারে এ দিনটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথমদিন তারা পালন করে ফারাং রিলংপোয়েহ অর্থাৎ বৃদ্ধের স্নানোৎসব। এ দিন মারমা স¤প্রদায়ের নারী পুরষ সবাই মিলে বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকে নদীর ঘাটে নিয়ে যায়। তারপরের দিনগুলোতে শুর হয় মারমা স¤প্রদায়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান রিলংপোয়ে অর্থাৎ জলকেলি উৎসব। সাংগ্রাইং উৎসব এবং রিলংপোয়ে বা পানি খেলা এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এ খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুঁড়ে মারে। স্নিগ্ধতায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে। সাংগ্রাইং উৎসব উৎযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা তৈরি করার জন্য চাউলের গুড়া তৈরি করে। পাড়ায় পাড়ায় ঝুলবে ফুল-ফল, পত্র পল্লবে শোভিত নানা কারকার্য, বাজবে ড্রাম, চলবে নাচ-গান, হাসি-তামাশা। এছাড়াও এ দিন মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শ্রবণ করে।

বিঝু: চৈত্রের শেষ দুইদিন ও পয়লা বৈশাখ এ তিনদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ স¤প্রদায় চাকমারা মহাসমারোহে বিঝু উৎসব পালন করে। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনুভূতি আর মোহানীয় আবেশ। তারা মনে করে প্রতি বছরই চাকমা জনপদে একটি পাখির বিজু বিজু ডাক সবাইকে বিঝুর আগাম আগমনী বার্তা জানিয়ে দিয়ে যায়। তাই এ উৎসবের সঙ্গে যেন দুলে উঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিঝু উৎসবের সময় তারা কোন প্রাণী হত্যা করে না। উৎসবের জন্য তারা ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমাণে পাহাড়ি মদ সংগ্রহ করে রাখে, মুখরোচক খাবারের জন্য নানা রকম শাক-সবজি, তরি-তরকারী সংগ্রহ করে রাখা হয়। উৎসবের প্রথম দিনে খুব ভোরে তারা নদীতে গিয়ে স্নান করে। নদীর ঘাটে গিয়ে জলদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল পূজা করে। সবাই মিলে একসাথে বৌদ্ধমূর্তিকে স্নান করায়। রাতে সারিসারি আলো জালিয়ে সব গ্রাম উৎসবের আলোয় উদ্ভাসিত করে রাখা হয়। এটাই হচ্ছে তাদের মূল উৎসব। এ দিন সবার ঘরে কমপক্ষে ৫ রকমের তরিতরকারী দিয়ে বিশেষ ধরনের পাজোন রান্না করা হয়। গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা গিলা খেলা, গুদু (হা-ডু-ডু) খেলায় মেতে উঠে, আর আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং আতশবাজী ফোটায় মহানন্দে। সব মিলে পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শুর হয় এক মহামিলন মেলা।

এবিএন/ইব্রাহিম শেখ/জসিম/নির্ঝর

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত