সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২
logo

মানিকগঞ্জে মরিচ চাষীদের মাথায় হাত

মানিকগঞ্জে মরিচ চাষীদের মাথায় হাত

মানিকগঞ্জ, ০৯ মে, এবিনিউজ : গেল বছরের মতো এবারও মানিকগঞ্জের কাঁচা মরিচ চাষীদের মাথায় হাত পড়েছে। ফলন ভালো হলেও পানির দরে মরিচ বেচা কেনা হওয়ায় তারা এই বিপাকের মধ্যে রয়েছে।

কাচা মরিচের জন্য বিখ্যাত জেলা মানিকগঞ্জে বড় বড় আড়ৎ ও হাট বাজারে প্রতি কেজি মরিচ পাইকারী বিক্রি হচ্ছে ৭ থেকে ৮ টাকা দরে। ক্ষেত থেকে কেজি প্রতি মরিচ তুলতে লেবার খরচ দিতে হয় ৫ টাকা। আর পরিবহন খরচ এবং নিজের পারিশ্রমিক মিলে লাভ গুনতে পারছে না মরিচ চাষীরা।

সরজমিন মানিকগঞ্জে বিখ্যাত আড়ৎ শিবালয় উপজেলার বরঙ্গাইল হাটে গিয়ে দেখা গেলো, মরিচ চাষীদের চোখে মুখে হতাশার ছাপ। বস্তা বস্তা মরিচ নিয়ে বসে আছেন তারা। মন্দা বাজারে কখন একটু দাম উঠবে সেই অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে তাদের। কিন্ত পাইকাররাও একদাম বলেই মুখে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। পাইকারদের সাফ কথা তারাও সুখে নেই। চলতি মওসুমের শুরুতে গত এক সপ্তাহে মরিচ বেচা কেনার বাজারে ধস নামায় মরিচ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন মানিকগঞ্জে কৃষক। ইতি মধ্যে অনেক চাষী তাদের ক্ষেত থেকে মরিচ তোলা বন্ধ রেখেছে। তারা আশায় আছে সামনে রমজান মাস হয়তো দাম ভাল পাবে।

কথা হয় শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামের এক মরিচ চাষীর সাথে। তার মনের ভেতর একবুক কষ্ট নিয়ে বলেন, ৪ বিঘা জমিতে এবার মরিচ আবাদ করেছি। গেল বছরও লোকসান গুনতে হয়েছে এবারও একই অবস্থা। এখন আমরা যামু কোথায়। প্রতি বিঘা মরিচ আবাদ করতে গিয়ে শরীরের ঘাম ঝড়ে যায়। ভেবেছিলাম গেল বছরের লোকসান এবার পুষিয়ে যাবে। কিন্ত এবারও যে একই অবস্থা। ক্ষেত থেকে এক কেজি মরিচ তুলতে লেবার খরচ পড়ে যায় ৫ টাকার ওপরে। তার পর হাটে আনতে পরিবহন খরচ লাগে মনপ্রতি ৪০ টাকা, নিজের পারিশ্রমিক তো আছেই। আর হাটের খাজনা দিয়ে লাভ থাকে না।

ঘিওর উপজেলার শোলধারা গ্রামের আফফসার উদ্দিন জানায়, দুই বিঘা জমিতে মরিচ আবাদ করতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকার ওপরে। এ পর্যন্ত চার মণ মরিচ বিক্রি করতে পেরেছি। ক্ষেত থেকে মরিচ তুলতে প্রতি কেজিতে খরচ লাগে ৫টাকা আর হাটে বিক্রি করতে হচ্ছে ৭ টাকা কেজি। গত দুইদিনে পকেট থেকে ২শ টাকা লোকসান হয়েছে। তাই ক্ষেত থেকে মরিচ তোলা আপাতত বন্ধ রেখেছি। দাম যদি ১০ টাকা কেজিও হতো তাহলে কোন রকম চালান উঠতো। জানিনা সামনে কি হবে। এভাবে যদি দাম থাকে তবে ক্ষেত থেকে আর মরিচ তুলবো না।

শোলধারা গ্রামের মহর উদ্দিনের মনের ভেতর একই কষ্ট। তিন বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করে বিপাকে পড়েছে। জানালেন, গতবারও লোকসান গুনতে হয়েছে ঠিক এবারও সেই অবস্থা। লাভের মুখ দেখতে পারছি না। এক বিঘা মরিচ আবাদ করতে যেভাবে শরীরে যে পরিমান ঘাম ঝড়ে সেই তুলনায় কোন রকম একটু লাভ পেলে নিজেকে বুঝ দিতে পারতাম। বীজ,সার,কামলা আর নিজের খাটুনি সবই বিফলে যাচ্ছে। দেখি আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ ফিরে তাকায় নাকি।

শিবালয় উপজেলার তাড়াইল গ্রামের কুষক দবির উদ্দিন জানান, সরকার যদি মরিচের একটা দাম নির্ধারন করে দিতো তাহলে অন্তত কিছু লাভ পেতাম। আসলে আমাদের দিকে কেউ তাকায় না।

ভাল লাভ পাবে এমন আশা নিয়ে এবারও প্রায় ৪ বিঘা জমিতে কাচা মরিচ আবাদ করেছিল শিবালয় উপজেলার ধুবুলিয়া গ্রামের কৃষক হামেদ আলী। গত বছরের মতো এবারও দাম না পাওয়ায় তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। সে জানায়, ৫-৬ দিন ধরে প্রতি কেজি মরিচের দাম পাচ্ছি ৭ থেকে ৮ টাকায়। আর ক্ষেত থেকে এক কেজি মরিচ তুলতেই খরচ হয় ৫টাকা। এছাড়া হাটে নিতে যাতায়াত খরচ কেজি প্রতি আরো ১ টাকা এবং হাটের খাজনা তো আছেই। তাহলে আপনারাই বলেন মরিচ বিক্রি করে কি পাচ্ছি।

একই উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের দুর্জন মিয়া বলেন,কত আর লেখবেন। আমাগো দিকে কারো নজর নাই। ভাবছি যদি লাভই না হয় তাহলে ক্ষেত থেকে আর মরিচ তুলবো না। ক্ষেতের মরিচ ক্ষেতেই মজে যাবে।

মরিচ আবাদের জন্য বিখ্যাত মানিকগঞ্জের শিবালয়,ঘিওর ও হরিরামপুর উপজেলার প্রত্যেক মরিচ চাষীর মধ্যেই এমন ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে। শুধু মরিচ চাষীই নয় বেপারী,আড়ৎদার ও মহাজনদেরও ক্ষোভের সীমা নেই।

বরংগাইল হাট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান,এই হাট থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক মরিচ যাচ্ছে ঢাকার কাওরান বাজার,শ্যাম বাজার,কুমিল্লা ও চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। পাশাপাশি দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখান থেকে সৌদি,কুয়েত,দাম্মাম,দুবাইসহ আরো কয়েকটি দেশেও মরিচ রপ্তানী করা হয়ে থাকে। হাটে মরিচ বিক্রি করতে আসা অনেক কৃষকের ধারনা,এখান থেকে পাইকরারা কম দামে মরিচ কিনে শহরের বেশি দামে বিক্রি করছে। শহরের সাথে গ্রামে দামের ফারাক আকাশ পাতাল।

বংরগাইল হাটের আড়দদার ও পাইকার বেপারীদের সাথে কথা হলে তারা জানিয়েছে, পানির দরে মরিচ কেনা বেচা হওয়ায় একদিকে কৃষক মরছে অন্যদিকে পাইকারদেরও লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমদানী ভাল হলেই মরিচের দাম পড়ে যায় বলে তারা জানান।

পাইকার ব্যবসায়ী মনির হোসেন জানালেন, গেল বছর মরিচ কেনা বেচায় লোকসান হয়েছে। এবারও সেই দিকেই যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইতি মধ্যে পকেট থেকে ৮০ হাজার টাকা নেই।

তিনি বলেন, বরংগাইল হাট থেকে প্রতিদিন মরিচ কিনে চট্রগামে পাঠাই। প্রতি কেজি মরিচ ৭ টাকা দিয়ে কিনতে হয় আর এক কেজি মরিচ পাঠাতে সব মিলে খরচ পড়ে ৮ টাকা। আর সেখানেও বিক্রি হয় ৮ টাকা কেজি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য এই লোকসান মেনে নিতে হচ্ছে।

হাটের আড়ৎদারারা জানান, মরিচের দাম চড়া থাকলে কৃষক ও আড়ৎদারারা লাভবান হতো। কিন্ত দাম নেমে যাওয়ায় উভয়কে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে লাভ কাকে বলে তারা জানেনা।

মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: আলীমুজ্জামান মিয়া জানায়, এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় মরিচের উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। আর ফলন বেশী হওয়ায় ও বিদেশেী রপ্তানী না হওয়ার কারনেই বর্তমানে মরিচের দাম কম। এতে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির সন্মূখীন হচ্ছে।

এবিএন/মোঃ সোহেল রানা খান/জসিম/ইমরান

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত