বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

মানিকগঞ্জে নদী আছে, পানি নেই

মানিকগঞ্জে নদী আছে, পানি নেই

মানিকগঞ্জ, ০৩ জুন, এবিনিউজ : দীর্ঘ বাঁক নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার এক পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মা-যমুনা নদী। আর এই বড় দুটি নদীর শাখা নদী গুলোই প্রবাহিত হয়েছে জেলার অভ্যন্তর ভাগের বুক চিরে। এর মধ্যে কালিগঙ্গা,ধলেশ্বরী ও ইছামতিসহ ৯টি শাখা এখন প্রায় মৃত। এ ছাড়া কয়েকটি নদীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শুধু মাত্র বর্ষা মওসুমের ৩-৪ মাস পানি থাকে এসব নদীতে। বছরের বাকি সময় নদীগুলো যেনো মরুময় হয়ে পড়ে। চৈত্রের শুরুতে বেশির ভাগ নদীর আশি ভাগ অংশ পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। এছাড়া নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তেমনী একটি নদী কালিগঙ্গা। একসময় এই নদীর বুকভরা ছিল উচ্ছল যৌবন । অথচ এখন এখন ধু ধু বালুচর। নদীর বুকে যেটুকু পানি আছে তার ওপর দিয়ে ছোট্র ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল করতে হিমসীম খায়। লোকজন কাপড় না ভিজিয়েই অনায়াসে নদী পাড় হতে পারে। কালিগঙ্গা নদী তীরবর্তী স্থানীয় অনেকেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, প্রচন্ড ঢেউ, ভয়াবহ স্রোত ও ঝড় তুফানের কথা। মানুষজন ছোট খাট নৌকা নিয়ে নদী পারাপার হতে সাহস পেতো না। মানুষ ও যানবাহন পারাপারের জন্য ছিল ফেরি,লঞ্চ,স্টিমার ও বড় বড় নৌকা। ঢাকা আরিচা মহাসড়কের সমস্ত যানবাহন ও মানুষ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত করতো কালিগঙ্গা নদী পার হয়ে। এই নদী পার হতে গিয়ে বড় বড় ঢেউ এসে নৌকাকে সজোরে ধক্কা দিলে মানুষের বুকে কম্পন শুরু হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মানিকগঞ্জের তরা কালিগঙ্গা নদীর ওপর নির্মান করা হয় বিশাল সেতু। সেতুটি নির্মানের পর থেকেই ধীরে ধীরে কালিগঙ্গার নদী তার যৌবন হারাতে থাকে। বর্তমানে কালিগঙ্গা নদীর এক পাশে খালের মতো হাটু পানির আঁকাবাঁকা লাইন চলে গেছে জেলার গন্ডি পেরিয়ে অন্য কোন জেলায়। তবে মানিকগঞ্জ সীমানায় জলহীন মরাকান্নার এই কালিগঙ্গা নদীকে পুজি করে প্রভাব শালীদের মাটি ও বালু কেনা বেচার রমরমা ব্যবসা জমে উঠেছে। সেই সাথে নদীর সরু পথে যে টুকু পানি রয়েছে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো ড্রেজার বসিয়ে উত্তলন করা হচ্ছে বালু। ফলে নদীতীরবর্তী এলাকার বাড়ি ঘর,বিাভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কৃষি জমি ভেঙ্গে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের লোকজন প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তলন করলেও এ গুলো দেখার কেউ নেই। কালিগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীরও একই অবস্থা। একসময় ধলেশ্বরী নদী পানিতে ভরপুর থাকতো। এখন এ নদীতে পানির দেখা মেলাভার। নদী শুকিয়ে ফসলের মাঠে রুপান্তরিত হয়েছে। মানিকগঞ্জের জাগির ব্রিজের নীচে গেলেই দেখা যায় ধলেশ্বরীর মরাকান্না। মাইলকে মাইল শুধু ফসলের মাঠ । এছাড়া গড়ে তোলা হয়েছে নার্সারী ও খেলার মাঠ। আর কয়েকটি শিল্পকারখানার বর্জের পানিই হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীর পানি।

ধলেশ্বরীর মতো ইছামতি নদীরও একই হাল। পদ্মা নদীর শাখা ইছামতি নদী এখন অনেকটা পানি শুন্য। হরিরামপুর উপজেলার ইছামতি নদী দিয়ে এক সময় ঐতিহ্যবাহী বাহী ঝিটকা হাটের সমস্ত পন্য নৌকা যোগে আনা নেয়া করা হলেও এখন সে অবস্থা নেই। বর্ষা মওসুম ছাড়া সারা বছরই নদীতে পানি থাকে না। ৩-৪ মাস নৌকার কদর থাকলেও বছরের বাকি সময় নৌকা চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায় পানির অভাবে। মানবেতন দিন কাটছে জেলেদের। জাল যার জলা তার, আর জেলেদের হাতে জাল থাকলেও নদীতে পানি না থাকায় মাছ শিকার করতে পারছে না কালিগঙ্গা তীরঘেষা মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তরা গ্রামের জেলে পল্লির বাসিন্দারা। ফলে অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া তাদের এই পেশাকে অনেকেই ছেড়ে দিয়ে অন্যপেশায় জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। অনেকে পরিবারের সন্তান লেখা পড়া শিখে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতও হচ্ছেন। জেলে পল্লির মন্টু রাজবংশী জানালেন, একসময় নদীতে সারা বছরই পানি থাকাতো,ফলে প্রচুর মাছ শিকার করা যেতো। কিন্ত দিন দিন নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ শিকার করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কারন পানির সাথে মাছের সম্পর্ক। যেখানে পানিই নেই সেখানে মাছ কিভাবে থাকবে। তাই তো বাধ্য হয়ে নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছি। অন্যর পুকুর ভাড়া নিয়ে সেগুলোতে মাছ চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। বানিয়াজুরীর মঙ্গলরাজ বংশী জানালেন, এক সময় নদীতে প্রচুর মাছ পেতাম। রাতভর মাছ মেরে সকালে আড়তে নিয়ে সেই মাছ বিক্রি করতাম। কিন্ত এখন নদী শুকিয়ে একাকার হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে পুকুরে পালন করা মাছ পাইকারী দামে কিনে সেগুলো তরাঘাট, সভার ও ঢাকার বড় বড় বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। এদিকে আগের মতো মাছ শিকার করতে না পারায় অনেক জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পুর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। গাংডুবী গ্রামের অমর রাজবংশী জানান,একসময় মাছ শিকার করাতান যখন নদ নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। নদ নদী মরে যাওয়ার কারনে মাছও কমে গেছে। বাধ্য হয়ে সেই পেশ ছেড়ে দিয়ে টেইলারিং পেশা বেছে নিয়েছে। একমাত্র ছেলে সুব্রতকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ঢাকা কলেজ থেকে এমবিএ পাড়াচ্ছি। এরকম অনেক জেলে পরিবার তাদের পুর্বপুরুষের মাছ শিকারের পেশে ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে।

এবিএন/সোহেল রানা খান/জসিম/তোহা

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত