মানিকগঞ্জ, ১১ জুন, এবিনিউজ : অাগে যাও ভোর রাতের দিকে গ্যাস পাওয়া যেত রমজান শুরুর পর থেকে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। দিন-রাত মিলে এক-দুই ঘণ্টাও গ্যাস থাকে না। রান্নাবান্না করতে হচ্ছে মাটির চুলায় অথবা এলপি গ্যাসে। তারপরও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। যেখানে আমরা গ্যাসই পাই না সেখানে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দারিয়েছে। কথাগুলো ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন মানিকগঞ্জ শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকার গৃহিণী বুলবুলি অাক্তার।
জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে মানিকগঞ্জ শহরসহ জেলার সর্বত্রই চলছে গ্যাস সংকট। অার রমজান শুরুর সাথে সাথে তা চরম অাকার ধারন করেছে। ফলে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন আবাসিক গ্রাহকরা। এ ছাড়া সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাসের প্রেসার না থাকায় সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। যার কারণে সিএনজি স্টেশনগুলোতে প্রতিদিনই যানবাহনের চাপ বেড়ে যাচ্ছে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে থাকতে হচ্ছে। অথচ গ্যাস সংকট সমাধানের কোনো উত্তর নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ, ঝাড়ু মিছিল, তিতাস গ্যাস কার্যালয় ঘেরাও, মানববন্ধন এমনকি পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষ হয়েছে। এতো কিছুর পরও মানিকগঞ্জে গ্যাস সংকট দূর হয়নি।
মানিকগঞ্জ তিতাস গ্যাসের আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১২ হাজারের বেশি আবাসিক, ২২০টি বাণিজ্যিক, ৬৪টি শিল্প এবং ১৭টি সিএনজি স্টেশসে গ্যাস সংযোগ রয়েছে। ঢাকার সাভারের আশুলিয়া থেকে সঞ্চালনা পাইপের মাধ্যমে মানিকগঞ্জ হচ্ছে গ্যাস লাইনের শেষ ঠিকানা। ফলে আশুলিয়া, সাভার এবং ধামরাইয়ের শিল্প-কারখানা ও আবাসিক চাহিদা মেটানোর পর অবশিষ্ট গ্যাস মানিকগঞ্জে সরবরাহ হচ্ছে। যার কারণে গ্যাসের চাপ নেই মানিকগঞ্জে।
সরজমিনে মানিকগঞ্জ শহরের পশ্চিম দাশড়া, সেওতা, বান্দুটিয়া, গংগাধরপট্রি, বেওথা, জয়রা, উচুটিয়াসহ বিভিন্নএলাকার বাসা বাড়ির গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বললে সকলেই ক্ষোভে সঙ্গে জানিয়েছে গ্যাসই পাই না তার ওপর দাম বাড়ছে।
মানিকগঞ্জে সকাল বিকাল রাত সকল সময়ই গ্রাহকদের দুর্ভোগ হচ্ছে গ্যাসের অভাবে। সব এলাকায়ই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।প্রায় ২৪ ঘন্টা এ অচলাবস্থা বিরাজ করে। মাঝে মধ্যে গ্যাস এলেও তা নিবু নিবু অবস্থায় জ্বলে। তাতে রান্নাসহ প্রয়োজনীয় কাজ করা যায় না। অনেকে বাসা বাড়িতে বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাস, কেরোসিন ও মাটির চুলা ব্যবহার করছে।
গ্যাস না থাকলেও প্রতি মাসে দিতে হচ্ছে বিল। এতে একদিকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অপরদিকে জালানি খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
মানিকগঞ্জ শহরের গংগাধর পট্রির বাসিন্ধা মাসুদ জানায়, দিন রাত মিলিয়ে দুই ঘণ্টাও গ্যাস থাকে না। সময় মতো রান্না করতে না পারায় সেহেরী ও ইফতার তৈরি করা নিয়ে বাসার মহিলাদের চরম ভোগান্তি পহাতে হচ্ছে। আর গ্যাসের এই দুর্ভোগ এক দুইদিনের নয় এটা কয়েক বছর ধরেই চলছে। শহরে থেকেও বাধ্য হয়ে মাটির চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ নিয়মিত গ্যাসের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে।
রমজান অালী সড়ক এলাকার গৃহিণী কাজল অাক্তার জানায়, দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাস সংকটে ভুগছি। পরিবারের জন্য রান্না, বাচ্চাদের জন্য পানি গরমসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহার করছি। গ্যাস না চালিয়েও গ্যাসের বিল প্রতি মাসে পরিশোধ করা হচ্ছে এবং সিলিন্ডার গ্যাস কেনা হচ্ছে। অামাদের দ্বিগুন খরচ হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের খান বাহাদুর অাওলাদ হোসেন কলেজের প্রভাষক সাইফুদ্দিন অাহম্মেদ নান্নু তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, আমাদের বাসায় গ্যাসের চুলা এসেছে ৩০বছর আগে। ৩০ বছরে এবারই প্রথম কোন রোজার মাস যাচ্ছে যে মাসের প্রথম দুদিন সেহেরির সময় গ্যাসের চুলা জ্বললো না, ইফতারির আগেও না। ইফতারের এবং মধ্যরাত পেরুনো সময়েও কি গ্যাসের পিক আওয়ার থাকে যে গ্যাস মিলবে না!
মাস শেষে বিল ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু গ্যাস দিচ্ছে না। আমাদের অপরাধটা কি,কেন আমাদের গ্যাস নেই বলবার মত কেউ নেই।
যারা কথা বললে কাজ হবে তাঁদের কাছে এটা কোন সমস্যাই না। মাথা ব্যথাও তাদের নেই,অঢেল টাকা আছে, ডজন ডজন সিলিণ্ডার এদের বাড়িতে জ্বললেও কিছু যায় আসেনা।
এটা নিছক রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, যার কোন প্রতিকার নেই।
মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর সামাজিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি গাজী কামরুল হুদা সেলিম জানায়, মানিকগঞ্জে গ্যাস সংকট আমাদের দীর্ঘ দিনের সমস্যা। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবিতে পৌরবাসীকে নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামও করেছিলাম। মাঝে গ্যাসের সংকট কম ছিল। কিন্তু এখন সংকট আরো বেড়ে গেছে।
এদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের সিএনজি স্টেশনগুলোতে দেখা গেছে, যানবাহনের সারি সারি লাইন। গ্যাসের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে ছোট-বড় যানবাহন গুলো। কয়েকদিন ধরেই গ্যাস নিতে আসা যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিএনজি স্টেশনগুলো ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সিএনজি স্টেশনের কর্মকর্তা- কর্মচারী জানিয়েছেন, কয়েকদিন ধরে গ্যাসের প্রেসার কম। যার কারণে একটি পরিবহনে গ্যাস দিতে সময় লাগছে আগের চাইতে বেশি। চাপ না থাকায় যানবাহনগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। গ্যাস সংকটের কারণে ইতিমধ্যে তিনটি সিএনজি স্টেশন কার্যত বন্ধ রাখা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে জেলার ১৭টি সিএনজি স্টেশন যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে বলে সিএনজি স্টেশনের মালিকরা।
সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের চাপ না থাকায় মানিকগঞ্জের টেম্পো, অটোরিকশার চালকরা গ্যাস সংকটের কারণে তাদের জীবিকা নির্বাহ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
সিএনজি স্টেশনের মালিক সিরাজুল ইসলাম জানায়, গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় সিএনজি স্টেশন চালানো দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক রতন চন্দ্র দে জানায়, মানিকগঞ্জে গ্যাস সংকট অনেক দিন ধরেই। এই সংকট উত্তরণে এই মুহূর্তে কোনো সুখবর নেই। সরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা ও সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করাতে মানিকগঞ্জের আবাসিক লাইনে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। তবে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ালে এ সংকট থাকবে না বলে তিনি জানান।
এবিএন/মো: সোহেল রানা খান/জসিম/নির্ঝর