![মুন্সীগঞ্জে সরকারি খালদখলের মহোৎসব](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/06/20/munshigonj-khal-1@abnews_84285.jpg)
মুন্সীগঞ্জ, ২০ জুন, এবিনিউজ : মুন্সীগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক সরকারি জায়গা-জমি ও খাল দখল করে ব্যবসা করে আসছে প্রভাবশালী মহল। পুরো মুন্সীগঞ্জ জুড়ে চলছে খাল দখলের মহাউৎসব। বিভিন্ন থানার সরকারী খাস জায়গাগুলো যে যার মতো করে গিলে খাচ্ছে বাধাহীনভাবে। কোন নিয়ম নীতি মানছেন না তারা। সরকারের উপরি মহল তাতে এক ধরনের মুর্তিময় আচরণ করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে একটি হলো মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত বীরবাড়ির খাল।
খাল দখলকারীদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী হলেন সাবির হাজী। যিনি বীরবাড়ি খালের উপর ২০বছর ধরে ৪তলা বিল্ডিং তৈরী করে বসবাস করে আসছে। অপরদিকে খালের উপরই রয়েছে তার অনেকগুলো অবৈধ কারন্ট জাল তৈরীর কারখানা। বার বার খালটি দখল মুক্ত করার জন্য জরিপ করে লাল নিশান সাটানো হলেও অজ্ঞাত কারণে কোন উদ্ধার তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছে মোটা অংকের টাকার বিনিময় প্রশাসন খালটিকে গিলে খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এখানে বৃষ্টির দিন এলে চরম দুর্ভোগে বসবাস করেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এলাকার সাধারণ মানুষের অভিযোগ পয়:নিষ্কাশনের জন্য তাদের কোন ব্যবস্থা নেই। খালটি দখল করায় যেটুকু খাল আছে তাও ময়লা ও মলমূত্রে ভরপুর। সেই মলমূত্র ও ময়লা পানি রাস্তা ও ঘরের সামনে চলে আসে। সামন্য বৃষ্টি হলেই ময়লা পানি মাড়িয়ে আমাদেরকে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে হয়।
বাগবাড়ী এলাকার সুনামধন্য এই বীরবাড়ি নামের খালটি দিয়ে একসময় নৌকা চলতো, মাছ ধরতো, গোসল থেকে শুরু করে সকল ধরণের কাজকর্ম করতো এই খালের পানি দিয়ে। কালের বিবর্তনে এই খালটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে সাবির হাজির বহুতল ভবনের পিছনে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। সেই সুযোগে এলাকার অবৈধ কারেন্টজাল ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে দখল করে কারখানা তৈরী করে ব্যবসা করে আসছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় খালের বেশিরভাগ দখল করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সাধারণ জনগণ সেখানে নিরুপায়। মুন্সীগঞ্জ সদর থানা থেকে দুই কি:মি: পশ্চিমে, মুক্তারপুর বাগবাড়ী সদর রোড হতে (ছাবির হাজির বাড়ী) দক্ষিন দিকে প্রায় পৌনে এক কি:মি: জায়গা, পঞ্চসার মৌজার ৭১নং ক্ষতিয়ানে সরকারি বীরবাড়ি নামের খালটির সবটুকু দখলে চলে গেছে। যেটুকু বাকী আছে সেটুকুও আস্তে আস্তে দখলে চলে যাচ্ছে। যারা দখল করেছে তারা বলছে আমরা সরকারি খাল দখল করে কারখানা করেছি সরকার চাইলে আমাদের কারখানা ভেঙ্গে ফেলুক। কিন্তু সাবির হাজির চারতলা ভবন আপনারা কি করবেন? এমন প্রশ্ন করে বলেন, রাগব বোয়ালদের থেকে সরকারী জায়গা উদ্ধার করেন পরে আমরা আমাদের ঘর, কারখানা সরিয়ে নেব।
সি.এস, ম্যাপ দেখে অনেক কিছুই বোঝার আছে। রাস্তার দক্ষিনে কাঠের একটি পুল ছিল। বর্তমান অবৈধ দখলদারদের কবলে পরে তা মাটি ভরাটের মাধ্যমে বহুতল ভবনের নিচে হারিয়ে গেছে। এখন খালের চিহ্নটুকু নেই।
দখলদারদের অনেকেই বলেছেন সরকারের শক্তি আর অসাধু লোকদের টাকায় সরকারী খাল এভাবে দখল করে নিয়ে যাচ্ছে। যদি তাই না হয় তাহলে কি করে সরকারী খালের উপর বড় বড় বহুতল ভবন নির্মাণ ও কারখানা তৈরী করা হয়? সরকারী অফিসাররা আসে। সাংবাদিক পরিচয়ে আসে। ছবি তোলে। লাল নিশান সাটায়। কিছুদিন পরে সবকিছু হারিয়ে যায়। কেন এমন হয়? কেন প্রভাবশালীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সরকারী জায়গা দখল মুক্ত করে না? এমন প্রশ্ন পঞ্চসার ইউনিয়নের বাগবাড়ী এলাকার বীরবাড়ী খাল পাড়ের বসবাসরত শত শত লোকের।
জনগনের দাবী মাননীয় জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা ইচ্ছা করলেই এই খালটি পুণ:উদ্ধার করে এলাকার পয়:নিষ্কাসনের জন্য দখল মুক্ত করতে পারবে। ইতিপূর্বে মুন্সীগঞ্জ জেলার বেশ কিছু কাজ তিনি করেছেন বলে জানিয়েছেন তারা এবং বীরবাড়ির খালটি উদ্ধার করে পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করলে মুন্সীগঞ্জ জেলাবাসীর তার প্রতি আস্থা আরো বাড়বে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
এ বিষয়ে খাল দখলকারী মো. জয়নাল বলেন, আমি সরকারী খাল দখলের বিষয় অবগত আছি। সরকারের প্রয়োজন হলে আমি আমার কারখানা সরিয়ে ফেলবো। এই জায়গার প্রতি আমার কোন দাবীও নাই। তিনি আরও বলেন, আমার ঘরের উত্তরে মৃত্য ছাবির হাজী খাল দখল করে বড় ফ্যাক্টরী করেছে সে সময় কেউ বাঁধা দেয় নাই বলে আজও সরকারী খাল বে-দখলের আওতায় আছে। খাল উদ্ধারে প্রশাসনের কোন তৎপরতা নেই বলেও জানান তিনি। আমরা সাধারণ মানুষ টিন দিয়ে ঘর করেছি এটা অবৈধ বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে আরেক দখলদার মো. জুলহাসের ছেলে মো. রমজান জানান, এই খালটি সরকারী মাপে প্রস্থ ৩৭ ফুট। আমি আইন মেনেই আমার দালান করেছি। এই সরকারী খালটি উত্তরে বড় নদীর সাথে সংযোগ ছিলো। ছাবির হাজী ক্ষমতার বলে দখল করেছেন। আমরাও চাই এই খালটি উদ্ধার হোক। আমার জায়গাতেও খাল থাকলে আমি ছেড়ে দিবো।
খাল দখলকারী মৃত কাদির খার ছেলে বিল্লাল বলেন, আমার ফ্যাক্টরী আমার ক্রয়কৃত জায়গাতেই আছে। সরকারী লোক এসে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রয়োজনে আপনী ইউনিয়ন পরিষদে এসে কাগজ দেখে যান বলে সেল ফোনে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, আমি কোন সরকারী খাল দখল করি নাই। আমার জমি মেপে আমি ফ্যাক্টরী করেছি।
যেখানে এলাকার ৯০শতাংশ মানুষ বলছেন এটা সরকারী খাল সেখানে কি করে বিল্লাল খা চ্যালেঞ্জ করে বলে তার কারখানা তার ক্রয়কৃত জায়গায়? সরকারী লোক তাকে এই জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছেন? কিভাবে সম্ভব হলো সরকারি লোকদের তাকে এই সরকারি খালের জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছেন? কত টাকা তিনি খেয়েছেন? প্রশাসনের লোক বিভিন্ন সময় আসে আর কারখানার মালিকদের কাছ থেকে বখরা নিয়ে চলে যায় এমন হাজারো কথা জানিয়েছেন ওখানকার পঁচা পানিতে বসবাস করা মানুষগুলো। তারা আরো বলেন, সরকারি খাল উদ্ধার করার কোন তৎপরতা এ পর্যন্ত লক্ষ করেন নি তারা।
সরেজমিনে গেলে এলাকাবাসী বীরবাড়ির নামকরা এই খালটি উদ্ধার করার দাবী জানান। তারা বলেন, রাগব বোয়ালদের হাত থেকে সরকারি খাল উদ্ধার করে আমাদের পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। দখল মুক্ত করে জনগনের জন্য উদ্ধার করতে হবে এবং আমরা জনগণ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের ভালো কাজে সহযোগিতা করব। এলাকার শতশত মানুষের একই কথা। এই খাল সরকারী। কি করে সরকারী খালে বড় দালান করে? এমনও হাজার প্রশ্ন জনগনের।
অত্র এলাকার আমজাদ জানান, উচ্চ মহলের শক্তি নিয়ে সরকারী খাল জোর করে ভরাট করছে। তবে এই উচ্চ মহল যে কারা তার কোন উত্তর দিতে পারেনি। তবে কারেন্ট জালের অর্ধেক টাকাই তাদের উচ্চ মহল বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সদর উপজেল সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. সাঈদুজ্জামান খান জানান, যারা খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে তাদেরকে আমরা নোটিশ করেছি এবং সময় নির্ধারণ করে দিয়েছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের স্থাপনা সরিয়ে না নিলে আমরা এ্যাকশনে যাব। খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মানের বিষয়ে বলা হলে তিনি জানান, অনেক জায়গায় মনে হয় খাল দখল করে ভবন নির্মাণ করেছে কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় তাদের নিজস্ব জায়গাতেই ভবন নির্মাণ করেছে। কারণ খাল কোথায়ও প্রশস্ত বা আবার কোথায়ও সংকীর্ণ হওয়ায় এ রকম হয়ে থাকে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুরাইয়া জাহানকে সরকারী খাল বেদখলের কথা জানালে তিনি বলেন, আমাদের জেলা প্রশাসক মহোদয় “সবুজে সাজাই মুন্সীগঞ্জ” যে প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তা সফল করার লক্ষ্যে সরকারী খাল উদ্ধারের একটি অংশ। খাল দখল করে যারা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে বা খাল দখল করছে বলে মনে হচ্ছে তাদেরকে আমরা নোটিশ দিচ্ছি ও নোটিশে সময় নির্ধারণ করে দিচ্ছি। তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে না নিলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবো। আর আমরা এ বিষয়টি নিয়ে মিটিং করেছি। মুন্সীগঞ্জের সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আমরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করব। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করে মুন্সীগঞ্জ শহরকে একটি সুন্দর শহরে রুপান্তর করা যায়।
এ বিষয় মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা মহোদয়কে অবগত করলে তিনি ক্ষুব্দ মনে বলেন, যাহারাই খাল দখল করছেন তারভ সমাজের ভালো লোক না। আমি আপনাদের মাধ্যমে খবর জানলাম, খুব দ্রুত খালের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এবিএন/আতিকুর রহমান টিপু/জসিম/নির্ঝর