শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

খাগড়াছড়িতে টানা বর্ষন, ফের পাহাড় ধসের আশংকা

খাগড়াছড়িতে টানা বর্ষন, ফের পাহাড় ধসের আশংকা

খাগড়াছড়ি, ১৬ আগস্ট, এবিনিউজ: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় প্রবল বর্ষন অব্যাহত থাকায় ৯টি উপজেলায় ফের পাহাড় ধবসের আশংকায় ঝুকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছে প্রশাসন। পাহাড় ধবসের প্রাণহানির আশংকায় সকাল থেকে প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে শহরে মাইকিং করছে। ভাড়ী বর্ষনের কারণে বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের কলাবাগান, নেন্সিবাজার, শালবন, হরিনাথ পাড়া গ্যাপ, আঠার পরিবার, সবুজবাগ ও কলেজ গেইট এলাকাসহ ৯টি উপজেলায় আবারও পাহাড় ধবসের আশংকায় সম্ভাব্য প্রাণহানির আশংকায় প্রবল হয়ে উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া লক্ষ্মীছড়ি ও গুইমারা, দীঘিনালার উপজেলার ছোটমেরুং এলাকা নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে শতাধিক পরিবার পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। চেঙ্গীনদীর তীরে বসবাসকারীদের মাঝে ঘরে পানি ওঠার আতংক বিরাহ করছে। খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলায় গত কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে ফের পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পার্বত্য জেলাগুলোতে মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। ভারি বৃষ্টিতে যে কোনো মুহূর্তে ভূমিধসের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এতে জনমনে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক।

এদিকে ভারী বর্ষন অব্যাহত থাকায় জেলায় প্রবাহমান চেংগী, মাইনী ও ফেনী নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অতি বর্ষনের কারনে জেলা শহরের পৌর এলাকা নিম্নাঞ্চল ও তীরবর্তী প্লাবিত হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের কাছে ঝুকিপূর্ন বসতির কোন হিসেব না থাকলেও জেলা প্রশাসক মো: রাশেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, খাগড়াছড়িতে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ন বসবাসের সংখ্যা খুবই কম। তবুও প্রশাসন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের নিরাপদে রাখার ব্যাপারে সতর্ক রয়েছেন। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাাসন আবহাওয়া প্রতিকুলতার কারণে বিভিন্ন জায়গায় সতর্কবার্তা জারি করে পাহাড়ের পাদদেশে ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসাবাসকারী লোকজনকে দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্রে বা যে কোনো নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করেছেন। জেলা প্রশাসক রাশেদুল ইসলাম আরো জানান, পানিবন্দী মানুষদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে আনতেও উপজেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।

অপরদিকে খাগড়াছড়িতে ছয়দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে, শত শত বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ধারাবাহিক বর্ষণ অব্যাহত থাকায় চেঙ্গী নদীর তীরবর্তিসহ নিম্মাঞ্চলে বসবাসকারীর পরিবারগুলোর মাঝে পানি উঠার আতংক বিরাজ করছে। টানা বর্ষণে জেলা সদরের মিলনপুর, আনন্দনগর, মুসলিমপাড়া, বাঙ্গালকাটি এলাকার নিন্মাংশ, নদী তীরবর্তী গঞ্জপাড়া, রাজ্যমনি পাড়া, বটতলী ফুটবিল ও শান্তিনগর এলাকায় বসবাসরত বেশীরভাগ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

অব্যাহত বর্ষনের কারনে পাহাড়ী ঢলে জেলার চেংগী ও মাইনী নদীর পানি বাড়তে থাকে। ফলে জেলা সদরের মুসলিমপাড়া, বাঙ্গালকাটি এলাকার নিন্মাংশ, নদী তীরবর্তী গঞ্জপাড়া ও শান্তিনগর এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। এদিকে দুপুরের পর থেকে পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।

খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র মো: রফিকুল আলম জানান, পানিবন্দী পরিবারগুলোর জন্য জেলা শহরের মুসলিম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মিউনিসিপ্যাল প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য স্ব-স্ব এলাকার কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের শালবন, কুমিল্লাটিলা, সবুজবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাইকিং করা হয়েছে। খাগড়াছড়ির শালবন, মোহাম্মদপুর, সবুজবাগসহ বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থায় রয়েছে প্রশাসন।

প্রশাসনের সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, যারা আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভিটেবাড়ি গিয়ে অবস্থান নিয়েছে তাদেরকেও দ্রুত কেন্দ্রে ফিরতে বলা হচ্ছে। এ মুহূর্তে কাউকে বিধ্বস্ত, ক্ষতিগ্রস্থ বা ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় যেতে দেয়া হচ্ছে না। এ জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। আবারও কোনো বিপর্যয় ঘটলে তখন সেই দায়ভার কে নেবে? তাই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছাড়তে বসবাসকারীদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।

অন্যদিকে ছয়দিন ধরে টানা বর্ষণে খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল আবারো প্লাবিত হয়েছে। এতে করে দীঘিনালার দুই ইউনিয়নসহ জেলার ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পাহাড় ধসের শঙ্কাও রয়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে মাইনী নদীর পানি বেড়ে গিয়ে নিম্নাঞ্চল ডুবে গিয়ে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় রাঙামাটির লংগদু উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৌকায় করে চলাচল করছে দীঘিনালা উপজেলার পানিবন্দী শতাধিক মানুষ। পানির নিচে মেরুং বাজার তলিয়ে যাওয়ায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। হঠাৎ মাইনী নদীর পানি বেড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলার শতাধিক একর আমন ধানের ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত দীঘিনালা উপজেলার হাজাছড়া, ৩নং কলোনি এলাকায় পাহাড় ধসে ৪টি বাড়ি ধসে পড়েছে। তবে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকায় কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে দীঘিনালা উপজেলার সহকারী কমিশনার(ভূমি) মো: মাহাফুজুর রহমান। তিনি বলেন, পাহাড়ী ঢলে মাইনী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ছোট মেরুং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অর্ধশতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা ১২টি পরিবারকে রশিক নগর দাখিল মাদ্রাসায় রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে পানিবন্দী মানুষদের মাঝে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।

অপরদিকে মাটিরাঙা উপজেলায় ধলিয়া নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। এতে করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলার চরপাড়া এলাকার হাজারো মানুষ। ভাঙ্গনের হুমকিতে রয়েছে নদী তীরবর্তী বসতভিটা ও ফসলি জমি।

মাত্র দুই মাসের ব্যাবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বন্যা কবলিত হয়েছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নিন্মাঞ্চল। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে লংগদুর সাথে সড়ক যোগাযোগ। গত ছয়দিনের টানা বর্ষন আর পাহাড়ি ঢলে দীঘিনালার মেরুং ও কবাখালি ইউনিয়নের ৪শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। ছোটমেরুং বাজারসহ দীঘিনালা-লংগদু সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে লংগদুর সাথে সড়ক যাতায়াত। পাহাড় ধসে চাপা পরেছে পাঁচটি বসত ঘর। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

অতিবৃষ্টির কারণে শুক্রবার থেকেই মাঈনী নদীতে পানি বাড়তে থাকে। শুক্রবার রাতেই নি¤œাঞ্চলের বসতিদের ঘর-বাড়ি ডুবতে থাকে। শনিবার পুরো বন্যা কবলিত হয়ে পরে উপজেলার নিন্মাঞ্চল। মাত্র দুই মাস আগে একইভাবে বন্যা কবলিত হয়েছিল উপজেলার এসব এলাকা।

মেরুং ইউপি চেয়ারম্যান রহমান কবির রতন জানান, বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর মধ্যে ছোটমেরুং, চিটাগাংগ্যা পাড়া, সোবাহানপুর, হাজাছড়া, ছদকছড়া উল্লেখযোগ্য। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪৫০জন। এদের সবার ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিতদের ৫০ পরিবার ছোটমেরুং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে; বাকিরা আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে। এছাড়া পাহাড় ধসের আশংকায় রসিক নগর দাখিল মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন ১৮টি পরিবার। কবাখালি ইউনিয়নে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান মো: জাহাঙ্গীর হোসেন। দীঘিনালা-কবাখালি সড়কও তলিয়ে গেছে।

মধ্যবোয়ালখালি এলাকায় পাহাড় ধসে মো: আলাউদ্দিনের(৫৫), হাজাছড়া এলাকায় মো: ফোয়াদ আলী(৪৮), মো: রাসেলের(৪০) এবং ছোটমেরুং ৪নম্বর কলোনীতে নুরুল ইসলাম(৪২) ও মো: ইউছুফ আলীর(৪৫) ঘর চাপা পরেছে। তবে প্রশাসনের আগাম সতর্কতায় আগেই ঘর থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ায় কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে খাগাড়ছড়ির দীঘিনালায় মাঈনী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার আটটি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাাবিত হয়েছে। এতে ঘরছাড়া মানুষের দূর্ভোগ বেড়েছে। বন্যায় দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নরে মেরুং বাজার, সোবানপুর, হাজাছড়া, ছোট মেরুং, বাদলছড়ি, বড় মেরুং, বাঁচা মেরুং এলাকা পানির নীচে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় গৃহহীন প্রায় শতাধিক পরিবার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। পাহাড় ধসে উপজেলার মধ্য বোয়ালখালিতে ১টি, হাজাছড়ায় ২টি এবং মেরুং ৩নং কলোনিতে ২টি বসত ঘর চাপা পড়েছে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহতী কর্মকর্তা(ইউএনও) মো: মাহফুজুর রহমান বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষগুলো ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

রোববার দীঘিনালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত পরিবারদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে ত্রান দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারকে চাল, ডাল, মুড়ি, তেল, মোমবাতি ও দিয়াশলাই দেওয়া হয়েছে। মোট ১০০টি পরিবারকে ত্রানসহযোগীতা দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত খাগড়াছড়ি জেলার চেঙ্গী, মাইনী ও ফেণী নদী শাসন ড্রেজিং ব্যবস্থা করা হয়নি। এতে করে নদীর গতিপথে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়া একদিনের বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চল প্লাাবিতসহ বন্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।

এবিএন/চাইথোয়াই মারমা/জসিম/নির্ঝর

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত