![নীরবে কেটে গেলো জীবনানন্দ দাশ’র ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/10/22/dancere-pic_106713.jpg)
ঝালকাঠি, ২২ অক্টোবর, এবিনিউজ : আজ ২২ অক্টোবর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ ‘রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ’ এর ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি জেলার ধানসিঁড়ি নদী বিধৌত বামনকাঠি গ্রামের দাশ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর সে মৃত্যুবরন করেন। জেলার ঝালকাঠি-রাজাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী বামনকাঠি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধানসিঁড়ি নদী। নদী তীরের এই গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়ীর ভিটা ও কিছু গাছপালা রয়েছে যেটা স্থানীয় ভাবে এটি ‘দাশের ভিটা’ নামে পরিচিত। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের এটাই পৈতৃক ভিটা। কবি জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোর এমনকি যৌবনের অনেক সময় পার হয়েছে এই বামনকাঠি গ্রামে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ভিটির ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামো কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু গাছপালা এবং একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সিটি কলেজের শিক্ষাকতা চাকুরি করার পর সেখান থেকে জীবনানন্দ বরখাস্ত হন। কিছু দিন বেকার জীবনের পর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির রামযশ কলেজে চাকরি লাভ করেন। ১৯৩০-এর মার্চে রামযশ কলেজ চাকুরি করার কয়েক মাস পর ছুটি নিয়ে বরিশালে ফিরে আসেন জীবনানন্দ দাশ।
২৬ বৈশাখ তারিখে ঢাকা শহরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে জগন্নাথ কলেজের পাশে অবস্থিত ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে কবি জীবনানন্দ দাশ রোহিণীকুমার গুপ্তের কন্যা লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। চাকরি খোঁজার দায়িত্ব এবং বেকার থাকার অনির্বচনীয় মর্মযাতনা সত্ত্বেও অবসর ছিল প্রশস্ত। ১৯৩৫-এর আগস্টে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকরি লাভ করেন জীবনানন্দ। ফলে তার দীর্ঘ বেকার জীবনের অবসান ঘটে।
১৯৪৬ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনানন্দ দাশ বরিশালেই থাকতেন। রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও সাহিত্যে বার বার ধানসিঁড়ি নদীর অরূপ লাবণ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ননা ফুটে উঠে।
তার লিখনীর মাধ্যমে ধানসিঁড়ি নদী পরিচিতি পায় দেশ থেকে বিদেশে। কিন্তু কালের বিবর্তন ও নীদি আগ্রাসনের শিকার হয়ে কবির স্মৃতি বিজড়িত সেই অপরুপ সুন্দর ধানসিঁড়ি নদী এখন একটি মরাখালে পরিনত হয়েছে। ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্ত শেষে সুগন্ধা-বীষখালূ ও গাবখান চ্যানেলের ত্রী-মোহনার গাবখান-ধানসিড়ি ইউনিয়নের বৈদারাপুর গ্রাম থেকে উৎপত্তি হওয়া সেই ধানসিঁড়ির নদী একপ্রকার বিলীন হতে চলেছে।
তিন দশক আগেও আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধানসিঁড়ি নদী ছিল রাজাপুরের সঙ্গে ঝালকাঠির নৌপথে যাতায়াতের একমাত্র সংযোগ সূত্র। এ নদী ধরেই রাজাপুরের লোকজন তখন ঝালকাঠি ও বরিশালে যাতায়াত করতো।
এককালে দারুণ স্রোতস্বিনী এ ধানসিঁড়ি নদীর দু’পাশ দিয়ে ক্রমাগত চর পরে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ ধানসিঁড়ি নদীটিকে তার কাব্য ও সাহিত্যে যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাতে এখনও দেশ-বিদেশের অনেকেই আগ্রহ ভরে একনজর এই নদীটিকে দেখার জন্য ছুটে এসে আশাহত হয়।
সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ধানসিড়ি নদীর উৎস মুখ থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই সময় সাড়ে চার কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজাপুর অংশের পিংড়ি-বাগড়ি-বাঁশতলার মোহনা পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল। নিয়মিত বরাদ্দ না দেওয়ায় পরের সাড়ে তিন কিলোমিটার আর খনন করা হয়নি।
প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধানসিড়ি নদীর রাজাপুর অংশের অবস্থা বড়ই করুন। ধাঁনসিড়ি নদীর রাজাপুর অংশে খননের অভাবে ও বাগড়ি বাজার গরুর হাট এলাকায় দখল হওয়ার কারণে নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। সর্বত্র কচুরিপানা আটকে আছে। ধানসিঁড়ির দুই পারে কয়েক‘শ হেক্টর উর্বর জমি আছে। কিন্তু নদীটি মরে যাওয়ায় সেচের অভাবে তা এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে।
এসব জমিতে বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের আবাদ করতে পারলেও শীত মৌসুমে পানি না থাকায় বোরোসহ শীতকালীন কোনো ফসলের আবাদ করতে পারছেন না কৃষকেরা। জীবনানন্দকে নিয়ে যথাযথ চর্চা ও প্রচার না থাকায় এই এলাকার অনেক মানুষের কাছেই তিনি রয়ে গেছেন বিবর্ন স্মৃতি হিসাবে। কবি জীবনানন্দকে ধারণ করতে না পারাটা এই এলাকাবাসীর জন্য চরম লজ্জার।
১৯৫৪'র ২২ অক্টোবর মৃত্যুর কিছু পূর্বে কলকাতার নাভানা প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছিল জীবনানন্দ দাশের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা'। যে ধানসিঁড়ি নদীর রুপ-সৈন্দর্য নিয়ে কবিতা লিখে কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ্বব্যাপী খ্যাতিম্যান হয়ে ছিলেন, যে ধানসিঁড়ি নদীকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে ছিলেন, সেই ধানসিঁড়ি নদী আজ কবির ন্যায় মৃত। শুধু তাই নয় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের আজীবন স্মৃতি বিজড়িত ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামের নিজ জন্মভূমি, পৈত্রিক বাড়ি আজ অবহেলা-অযন্তে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতে পরিণত হয়েছে। তার অতি প্রিয় স্মৃতি বিজড়িত বিখ্যাত ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার ধানসিঁড়ি নদীটি আজ ভরাট হয়ে ধু-ধু মাঠে পরিণত হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা বেগম পারুল বলেন, রূপসী বাংলার কবিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই মুহুর্তে কোন প্রকল্প না থাকলেও পুনরায় ধানসিঁড়ি নদী খননে ও কবি জীবনান্দন দাসের স্মৃতি সংরক্ষনে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের সার্বিক সহযোগী ও উদ্দোগ একান্ত প্রয়োজন।
এবিএন/আজমীর হোসেন তালুকদার/জসিম/রাজ্জাক