বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • সারাদেশ
  • কেমন আছে চিতলমারী হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প
স্বাধীনতার ৪৬ বছর

কেমন আছে চিতলমারী হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প

কেমন আছে চিতলমারী হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প

বাগেরহাট, ০৬ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ। পিরোজপুর ক্যাম্পের পাকসেনারা বলেশ্বর নদী পথে। আর বাগেরহাট ক্যাম্পের পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় সড়ক পথে আক্রমন করে বর্তমান চিতলমারী উপজেলা। চারিদিকে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। শুরু হয় খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও নারকীয় তান্ডব। আর সেদিন থেকেই বিদ্রোহের দানা বাধে এ অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের মনে। সেই প্রমত্তা বলেশ্বর নদী আজ আর নেই। যে নদী দিয়ে দুটি ইষ্টিমার এক সাথে চলত। চর পড়ে নদী শুকিয়ে মরে গেছে। গড়ে উঠেছে নতুন বসতি। তবুও রয়ে গেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় কিছু স্মৃতি। যে স্মৃতি গুলো আজও স্মরণ করে দেয় পাকসেনাদের বর্বরোচিত ধংসযজ্ঞের ইতিহাস। তেমনি এক স্মৃতি এখনও জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের চিতলমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের হালদার বাড়ি ক্যাম্পটি।

যে ক্যাম্প থেকে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা পিরোজপুর, মোল্লাহাট, ফকিরহাট ও বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। প্রতিরোধ করে হটিয়েছে শত্রু সেনাদের। আজ সেই হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পটির জৌলুস আর নেই। রয়েছে নানা ইতিহাস। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হতে চললেও সংরক্ষণ হয়নি চিতলমারীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও প্রকৃত ইতিহাস। হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে হানাদার বাহিনী চিতলমারী আক্রমন করে। পিরোজপুর ক্যাম্পের পাকসেনারা বলেশ্বর নদী পথে। আর বাগেরহাট ক্যাম্পের পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় সড়ক পথে আক্রমন করে চিতলমারী। জ্বালিয়ে দেয় সন্তোষপুর, শ্যামপাড়া, দূর্গাপুর, খড়মখালী, খলিশাখালি, বাবুগঞ্জ বাজার ও চিতলমারী সদর বাজারসহ ১০-১৫ টি গ্রামের শতশত ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট। চারিদিকে আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। পিরোজপুর থেকে আসা খানসেনারা গানবোর্ট থেকে নিক্ষেপ করে শেল। শুরু হয় হত্যা, লুটপাট ও ধংসযজ্ঞ।

এদিন খানসেনা ও রাজাকারদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত হন খড়মখালী গ্রামের মান্ধার মল্লিক, সদু আগাসন, আড়–য়াবর্নীর আফজাল মোল্লা, পিঁপড়ারডাঙ্গার অমলগুহ, তার স্ত্রী ও দূর্গাপুর গ্রামের কাঁলাচান রায়সহ ৩৯২ জন নিরীহ মানুষ। চারিদিকে শুরু হয় খুন, ধর্ষণসহ নারকীয় তান্ডব। দেশত্যাগ করতে শুরু করে মানুষ। অনেকেই মেয়ে-গৃহবধুদের সম্ভ্রম ও জীবন বাঁচাতে রাতের আধারে পালিয়ে যায় মিত্রদেশ ভারতে। আর তখন থেকেই মূলত বিদ্রোহের দানা বাধে এ অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষের বুকে। শুরু হয় শত্রু প্রতিরোধের প্রস্তুতি।

এমন সময় তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর আলী সরদার পিচ (শান্তি) কমিটি গঠন করতে আসে চিতলমারীর মুসলমানদের কাছে। তখন প্রবীন ব্যাক্তিত্ব গনি খান, শের আলী মোল্লা, আউয়াল শেখ ও কাউয়ুম শেখসহ অনেকেই পিচ কমিট প্রতিরোধ করেন। ওই সময় তারা বলেন,-‘যে কমিটি খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও নারকীয় তান্ডব চালায়, সে কমিটি শান্তি কমিটি বা পিচ কমিটি হতে পারে না। আর এ কমিটি চিতলমারীর মাটিতে হবে না।’ তারই প্রেক্ষাপটে খানসেনাদের প্রতিহত করতে চিতলমারীতে কথিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রবেশ করেন ব্যাসরগাতির হবি। সেই সময় তার বিরুদ্ধে হিন্দুস¤প্রদায়ের বাড়িতে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ও লুটতরাজের অভিযোগ ওঠে। তার হাতে নির্যাতিত হয় বুদ্ধ কর্মকারের স্ত্রীসহ অবলা মেয়ে ও গৃহবধু।

এরপর মুক্তিবাহিনী নিয়ে চিতলমারীতে প্রবেশ করেন ল্যান্স কর্পোরাল সামছুল হক মল্লিক। শতাধিক ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গড়ে তোলেন হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প। আর এর জন্য অনেক ত্যাগ ও ভূমিকা রেখে ছিলেন ক্যাম্প ভবনের মালিক ষষ্ঠীচরন হালদার। সে ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীনের জন্য রেখে ছিল অগ্রণী ভূমিকা। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন পিরোজপুর, বাগেরহাটের মাধবকাঠি, পানিঘাট, মোল্লাহাটের চরকুলিয়া, ঝালডাঙ্গা, দত্তডাঙ্গা ও ফকিরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে খানসেনাদের সংগে। পিছু হটে যায় শত্রুসেনারা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডর শামছুল হক বাহিনীর হাতে বেসরগাতির হবি নিহত হয়। এভাবেই একাত্তরে এ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা হতে থাকে হালদার বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে। ঘটে যায় বিভিন্ন ঘটনা। আর হালদার বাড়িটিকে ঘিরে সৃষ্টি হয় চিতলমারীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি মুক্তিযুদ্ধে চিতলমারীর স্মৃতি ও ইতিহাস।

তাই কালের বিবর্তনে ভেঙ্গে পড়া একাত্তরের স্মৃতি হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের জৌলুস আজ আর নেই। হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প ভবন সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু তালেব, তৎকালিন ক্যাম্পের বাবুর্চি হারুন শেখ ও ভবনের উত্তরাধিকারী কালিদাস হালদার জানান, ১৯৬৮ সালে ষষ্ঠীচরণ হালদার বসবাসের জন্য দ্বিতল ভবনটি নির্মান করেন। সে সময় প্রতিব্যাগ সিমেন্টের দাম ছিল ৬ টাকা, নন্দি বাটা ইট দাম ছিল প্রতি হাজার ১০০ টাকা, লেবার বিল ছিল ১০ আনা। ভবন নির্মানের জন্য রাজমিস্ত্রী আনা হয়েছিল শ্রীরামকাঠি থেকে। প্রায় লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মান করা হয় দ্বিতল হালদার ভবনটি।

একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হলে ভবনটি তিনি ছেড়ে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। শুধু তাই নয়, আহারও জোগান মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে চলে যান। এরপর ষষ্ঠীচরণ হালদার তার পরিবার নিয়ে ক্যাম্প ভবনে ওঠেন। ১৯৮১ সালে মারা যান তিনি। ষষ্ঠীচরণের উত্তরাধিকারী ৪ পুত্র লাল বিহারী হালদার, নির্মল হালদার, বিমল হালদার ও কালিদাস হালদার। পিতার মৃত্যুর পর ভাইদের মাঝে শুরু হয় সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। শেষ পর্যন্ত ক্যাম্প ভবনে ওঠেন নির্মল হালদার ও কালিদাস হালদার। নির্মল হালদার ২০০৭ সালে মারা যান। তার রয়েছে দুই পক্ষের ছেলে মেয়ে। যাদের মধ্যে চলছে ভাগ বাটোয়ারার রশি টানাটানি। আর মাঝে একাত্তরের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হালদার বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পটি।

এবিএন/এস এস সাগর/জসিম/তোহা

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত