বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • শিক্ষাঙ্গন
  • ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়; ‘দৃশ্যমান উন্নয়ন’ দেখতে চায় শিক্ষার্থীরা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়; ‘দৃশ্যমান উন্নয়ন’ দেখতে চায় শিক্ষার্থীরা

ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়; ‘দৃশ্যমান উন্নয়ন’ দেখতে চায় শিক্ষার্থীরা

কুবি (কুমিল্লা), ০৪ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা’র ময়নামতি সংলগ্ন লালমাই পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয় (কুবি)। দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে ২০০৬ সালে এটি যাত্রা শুরু করে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, বিভিন্ন পরিবার থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে যেন নতুন একটি পরিবার খুঁজে পান। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করেই জমে উঠে আড্ডা-গান আর কৌতুকের আবহ। সময়ের পরিক্রমায় প্রাণোচ্ছলতা ও তারুণ্যের দীপ্যমান শিখায় শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলছেন নতুন অন্যরকম এক ভুবন।

ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার ১২ বছরে ছোট ক্যাম্পাসের এই আনন্দ মেলায় ছন্দপতন ঘটিয়েছে একাধিক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ‘রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস’ উল্লেখ থাকলেও সেই রাজনীতির বলি হয়েই ২০১৬ সালে প্রাণ দিয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা, মার্কেটিং বিভাগের ৭ম ব্যাচের ছাত্র সাইফুল্লাহ খালিদ। এই ঘটনার কোনও বিচার পাইনি-বলে দাবি তার পরিবারের। এছাড়াও রাজনীতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রতিষ্ঠার এক যুগে বিভিন্ন সময়ে আহত হয়েছেন কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মী।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ৬জন অধ্যাপক। এদের মধ্যে মাত্র ২জন তাদের পূর্ণ মেয়াদকাল (৪ বছর) শেষ করতে পেরেছেন। রাজনীতিক অসন্তোষ, শিক্ষকদের মধ্যে ‘গ্রুপিং’, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধর্মঘট ইত্যাদির বলি হয়ে বাকি অধ্যাপকরা তাদের উপাচার্যের দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সর্বশেষ ও সদ্য বিদায়ী উপাচার্য, অধ্যাপক ড. মো: আলী আশরাফের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের (০৩ ডিসেম্বর ২০১৩-যোগদান) প্রথম ২ বছর অনেকটা নিষ্কণ্টক কাটলেও শেষ ২বছর তাঁর জন্য সুখকর হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ নিয়ে বিভক্তি; শিক্ষক সমিতি কর্তৃক উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি, দুর্নীতি, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে লাগাতার আন্দোলন ও একাধিকবার উপাচার্যকে বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা; উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক এসব বিষয়ের কোনও সুষ্ঠু মীমাংসা না হওয়ায় বারবার ব্যাহত হয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। লাঞ্ছিত হয়েছেন একাধিক শিক্ষক; সেশনজটে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা; দুশ্চিন্তায় ভুগেছেন অভিভাবকবৃন্দ।

পেছনে তাকালে দেখা যায়, গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ অনুষ্ঠিত কুবি শিক্ষক সমিতি নির্বাচন-২০১৭ কে কেন্দ্র করেই মূলত দু’পক্ষের (উপাচার্যপন্থী ও উপাচার্যবিরোধী) দ্বন্দ্ব শুরু হয়। উক্ত নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পরিষদ ঘোষিত ‘নীল দল’ পূর্ণ প্যানেলে জয় লাভ করে। ‘নির্বাচনে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ উপাচার্যের অনেকটা প্রকাশ্য মদদেই নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটায় পৃথক ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ নামধারী সংগঠনের মাধ্যমে’-বলে দাবি করেছিলেন শিক্ষক সমিতি। জবাবে নতুন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী দাবি করেছিলেন, ‘যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ‘কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল বর্তমান বঙ্গবন্ধু পরিষদ এখন আর সে জায়গায় নেই বলে আমরা নিজেরা নতুন করে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ গঠন করতে বাধ্য হয়েছি।’

এসব ঘটনায় শিক্ষকদের মাঝে স্পষ্টত বিভাজন চলতে থাকে। সময়ের পরিবর্তনে গত এক বছরে বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য ও মতভেদের সৃষ্টি হয় দু’পক্ষে। বিভিন্ন সরকারি দিবসগুলোতে শহিদ মিনার ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে গিয়ে তুমুল বাকবিত-া ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে এই ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’কে কেন্দ্র করে। এছাড়াও শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন দাবি-দফা উপাচার্য বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। শিক্ষক সমিতি বিভিন্ন ঘটনার বিচার না পেয়ে উপাচার্যকে কয়েক দফা ক্যাম্পাসে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছে। একাধিকবার তালাবদ্ধ হয়েছে উপাচার্য কার্যালয়, প্রশাসনিক ভবন। শিক্ষক সমিতি-উপাচার্যপন্থীদের বিরোধে ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ ছিলো বেশ কয়েকদিন। এতে করে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৈকি! এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে দিনের পর দিন বিভিন্ন প্রতিবেদন আসলেও উর্ধ্বতন প্রশাসন থেকে কোনও ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়াতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে।

সবশেষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও নিপীড়ণমূলক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলে গত ১৬ অক্টোবর ২০১৭ থেকে উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দিয়ে, তার কার্যালয় তালাবদ্ধ করে আন্দোলন করেছে শিক্ষক সমিতি। এতে উপাচার্য তার বাসভবনে একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন তার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত (২ ডিসেম্বর ২০১৭)। উপাচার্য ড. মো: আলী আশরাফের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দু’মাস পর বিশ^বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’-খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী। নতুন উপাচার্যের সম্মুখে শিক্ষকদের মধ্যকার এই বিভেদ মিটিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা।

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা সমস্যায় জর্জড়িত। প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত কোনও সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোহায় দিয়ে প্রশাসন আমাদেরকে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ^বিদ্যালয়-ইত্যাদি) যেখানে আকাশচুম্বী ভবন ও যাবতীয় আধুনিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে সেই তুলনায় আমরা ‘কিছুই’ পাচ্ছি না। সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ের সকল বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই। নেই কোন সেন্ট্রাল অডিটরিয়াম। সেন্ট্রাল মাঠের কাজ যেখানে অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা সেখানে এটি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখনও। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ কয়েক দফা পিছিয়ে এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪৩৮জন শিক্ষার্থীর তুলনায় হল আছে মাত্র ৪ টি যেখানে সর্বোচ্চ ৭শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী হিজিবিজি করে থাকছেন। ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে নেই কোনও ওয়াইফাই-নেটওয়ার্ক সুবিধা। প্রশাসনিক ভবনের পাঁচতলায় ছোট পরিসরে যে লাইব্রেরি রয়েছে তা প্রয়োজনের সিকিভাগও পূরণ করে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদভুক্ত ১৯টি বিভগের প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষকের মধ্যে ‘অধ্যাপক’ রয়েছেন মাত্র ৩জন। তারা হলেন- ড. মো: জাকির ছায়াদউল্লাহ খান (অর্থনীতি বিভাগ), ড. মাসুদা কামাল (লোক প্রশাসন বিভাগ) ও ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান (রসায়ন বিভাগ)। ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি ঘটছে, অথচ একজন অধ্যাপকের সংস্পর্শ পাইনি’- বলে অনুযোগ করেছেন অন্যান্য বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সার্ভিসের অবস্থাও নাজেহাল। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের নিজস্ব বাস আছে মাত্র ৪টি। এছাড়া বিআরটিসির ভাড়া করা বাসগুলোরও ফিটিংস ঠিক নেই। ফলে মাঝে মাঝেই রাস্তাঘাটে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় এগুলো।

এরপরও শিক্ষার্থীরা এসব সমস্যা নিয়েই প্রতিদিন জমায়েত হচ্ছেন উচ্চশিক্ষার এই দ্বারে। নতুন উপাচার্যের কাছে তাই তাদের চাওয়া অনেক। সুদূর নেপাল থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের বিদেশি শিক্ষার্থী মো: জাহাঙ্গির আলম বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। তবে আশানুরূপ সুযোগ-সুবিধা তেমন কিছুই পাচ্ছি না। নতুন উপাচার্যের কাছে আমাদের চাওয়া থাকবে ক্যাম্পাসের সার্বিক উন্নতির দিকে যাতে তিনি সুনজর দেন।’ নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা মিতা বলেন, ‘অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ের তুলনায় আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমরা চাই নতুন উপাচার্য স্যার আমাদের অপ্রতুলতা পূরণ করে বিশ^বিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’

নব নিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী তার উদ্বোধনী কার্যদিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি বিধানের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। সেসবের বাস্তব রূপ দিতে আমি সচেষ্ট হবো। তবে আমি একা তা পারবোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের সহযোগিতায় আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সার্থক হব বলে মনে করি।’

এবিএন/নাহিদ ইকবাল/জসিম/তোহা

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত