ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) , ০১ মার্চ, এবিনিউজ : সুনামগঞ্জ ধর্মপাশা উপজেলার হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজের নির্ধারিত সময় গত বুধবার শেষ হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ছিল ৭০ ভাগ। ধর্মপাশা উপজেলার ৭টি হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ এখনো শেষ হয়নি।
এই প্রকল্প কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলীদের দাবি বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত প্রকল্প কাজগুলোতে গড়ে ৭৫ থেকে ৮০ভাগ মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বাঁধগুলোতে গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে- বাঁধের পুরো কাজ শেষ হতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। এখনও শতভাগ কাজ শেষ হয়নি।
গেল বছর পাহাড়ি ঢলে হাওরের বাঁধ ভেঙে সম্পূর্ণ বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপজেলার প্রায় ৪৭ হাজার কৃষক পরিবার। ফসল হারানোর ধকল হাওরপাড়ের কৃষকরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সরকারি সাহায্য ও ধার-কর্জ করেই দিন কাটছে তাদের।
পাউবোর সূত্রে জানা গেছে, বাঁধের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)র মাধ্যমে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। হাওর এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত, নদী/খাল পুনঃখননের জন্য স্কীম প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ অনুযায়ী স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকল্পে জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়। জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে জেলা কমিটি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়। প্রত্যেক কমিটিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিকে সদস্য সচিব করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে করা হয় উপদেষ্টা।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল, সোনামড়ল, ধানকুনিয়া, কাইলানী, জয়ধনা, ঘোড়াডোবা, গুরমা ও গুরমার বর্ধিতাং হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ বাস্তবায়ন করে আসছে। তবে কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী শুরুতেই পিআইসি কমিটি গঠন নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। নির্ধারিত তারিখ পেরুনোর পর একটি পিআইসিও গঠন করা যায়নি। পরে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত প্রকল্প কাজ শুরু করে তা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু হাওর থেকে দেরিতে পানি নামায়, জরিপ, প্রাক্কলন তৈরিসহ অন্যান্য কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় এ উপজেলায় ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত প্রকল্প কাজ শুরু হয় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে। টাকা সমস্যা না থাকলেও এ উপজেলায় বাঁধের কাজের ধীরগতি লক্ষ করা গেছে শুরু থেকেই। এছাড়াও কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গোড়া থেকে গর্ত করে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, হাওরে জমি না থাকা সত্ত্বেও পিআইসি কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি, বাঁধে বাজেট থাকার পরও দুরমুজ না করা, বাঁধের স্লোপ,বাঁধ থেকে ৫০ ফুট দূর থেকে মাটি না আনা ,কমপেকশনসহ অন্যান্য কাজ সঠিকভাবে এখনো করা হয়নি।
এছাড়া এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ উপজেলার নতুন ২৮টি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় এনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করার দাবি জানিয়ে আসলেও এখনো এ নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এতে করে পানি ঢুকে হাওরের বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবী করছেন স্থানীয় কৃষকরা। এদিকে এসন বাঁধে অনিয়মের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলীরা দায়িত্ব পালনে চরম গাফিলতি করেছেন। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় বোরো ফসল নিয়ে কৃষকদের শঙ্কা রয়েই গেছে।
চামরদানী গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়া ও আব্দুল আলিম, গুরমার হাওরের কৃষক আব্দুর নূর, আনিছ উজ্জামান ও শামসুল হক,ধানকুনিয়া হাওড়ের কৃষক মাহমুদ নগর গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাঁধের কাজ তেমন ভাল হয়নি। বাঁধের কাজ এখনও শেষ হয় নি। তবে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
কৃষকরা আরও জানান,অনেক বাঁধে বালু,কালামাটি মিশ্রিত মাটি দিয়ে বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। বাঁধগুলো টেকসই না হলে আগামী বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। সর্বোপরি বাঁধ নির্মাণ কাজে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেনা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা। ফলে বাঁধ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তবে পিআইসির সভাপতিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তারা বলেন কাজে কোন অনিয়ম হয়নি।
ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোসাহিদ তালুকদার বলেন, যথাসময়ে পিআইসি কমিটি গঠন, ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ কাজ শুরু হলে বুধবারের ভেতরের সব হাওরের কাজ শেষ হয়ে যেত। যেহেতু পিআইসি গঠন ও কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে তাই অন্য বছরের মত এবারও কৃষকরা তাদের ফসল নিয়ে শঙ্কিত। যদি আগাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল আসে তাহলে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাঁধের স্লে¬াপ, দুরমুজ না করা ও কমপেকশন সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী বাঁধের ৫০ ফুট দূর থেকে মাটি আনতে হবে কিন্তু অনেক বাঁধ আছে যেখানে বাঁধের কাছ থেকে মাটি তুলে সেই মাটি বাঁধে ফেলা হয়েছে। এই কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলীরা দায়িত্ব পালনে চরম গাফিলতি করেছেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী ও ধর্মপাশা উপজেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব মাহমুদুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টিসহ কিছু কারণে বাঁধের কাজে সমস্যা হয়েছে। তাই কাজ শেষ হতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে আশা করছি দ্রুতই কাজ শেষ হবে। বাঁধের তদারকির কাজে কোনো গাফিলতি করা হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. মামুন খন্দকার বলেন, নানাবিধ কারণে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ যথাসময়ে শুরু করা যায়নি এ উপজেলার ১৩৪টি প্রকল্পের মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ৯৬টি পিআইসির সভাপতি কাজ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে আমার কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছেন। বাঁধের কাজ সঠিকভাবে শেষ করা হয়েছে কী না তা সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা হবে। বাঁধের কাজ নিয়ে কেউ গড়িমসি করলে তা বরদাস্ত করা হবে না। দ্রুত সবগুলো বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য ধর্মপাশা উপজেলায় হাওরে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে এ বছর ১৩৪টি প্রকল্পের অনুকূলে প্রায় ২৫ কোটি ৫৭লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে।
এবিএন/মোঃ ইমাম হোসেন/জসিম/নির্ঝর