শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • সারাদেশ
  • চট্টগ্রামে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া!
৫২ একর জায়গার তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অর্থায়নে বিদেশী সংস্থা! বন্দরের টাকা থাকা সত্ত্বেও বিদেশী কোম্পানীর সম্পৃক্ততা, কতটা যুক্তিযুক্ত?

চট্টগ্রামে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া!

চট্টগ্রামে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া!

চট্টগ্রাম, ০৫ মার্চ, এবিনিউজ : চট্টগ্রামে লালদিয়া মাল্টিপারপাস কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে। পতেঙ্গা নৌবাহিনীর বোট ক্লাব সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর পাড়ে টার্মিনালটি নির্মিত হলে জাহাজ জট ও পণ্য খালাসে ভোগান্তি নিরসন হবে দাবি বন্দর কর্তৃপক্ষের। তবে বন্দরের অর্থায়নে না করে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ পিপিপি’র আওতায় টার্মিনাল নির্মানের এ উদ্দ্যেগে অসোন্তষ প্রকাশ করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তাদের প্রশ্ন বন্দরের আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন বিদেশী কোম্পানীকে লিজ দেওয়া হবে? অন্যদিকে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ হলে যানজট ও জনভোগান্তি বৃদ্ধি পাবে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। তার মতে লালদিয়া কিংবা পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মান না করে দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা দরকার। তাছাড়া কর্ণফুলী নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিদেশী কোম্পানীকে ২৫ বছরের জন্য টার্মিনালের দায়িত্ব দেয়া কতুটুকু যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের আমদানী রপ্তানী প্রক্রিয়া সহজ করা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের উদ্দ্যেগ নেয় চবক। বন্দরকে যুগোপযোগী করে নগরীর বিমানবন্দর রুটের লালদিয়া চর এলাকায় ৫২ একর জায়গার উপর প্রস্তাবিত টার্মিনাল নির্মাণ কাজ আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ফ্রান্সের ৫টি কোম্পানী ইতোমধ্যে পিপিপি’র অধীনে টার্মিনাল নির্মানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দুবাই এর ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতীয় আদানি পোর্টস এন্ড স্পেশাল ইকোনোমিক জোন লিমিটেড, ফ্রান্সের ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড, চীনের চায়না হারবার এবং সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল পোর্ট সার্ভিসেস। এগুলোর মধ্যে যে কোন একটি প্রতিষ্ঠানের সাথেই চুক্তি করবে চবক।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল খালেদ ইকবাল সম্প্রতি তার দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রতিবেদককে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বন্দরকে সর্বাধুনিক সুবিধায় উন্নীত করার বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্দ্যেগ। যা একটা একটা করে বর্তমানে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। এ টার্মিনাল নির্মিত হলে ১৯০ মিটারের বৃহৎ আকার চারটি জাহাজ আসতে পারবে। যা দিয়ে কন্টেইনার ও কার্গো দুটোই হ্যান্ডিলিং করা যাবে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনালটা শুরু থেকে বিভিন্ন পাবলিক পার্টনারশিপ পিপিপি প্রক্রিয়ায় গিয়েছি।

তিনি বলেন, লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের যাবতীয় পর্যবেক্ষন কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। দরপত্রও আহবানও সম্পন্ন হয়েছে। ৭টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে ৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে চুড়ান্ত অবস্থানে। এর মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে শীঘ্রই এ টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। সুতরাং যাদের টাকা আছে তারা এসে বানিয়ে দিয়ে যাবে। এতে করে তারাও যেমন এখাত থেকে লভ্যাংশ পাবে,পাশাপাশি আমরাও এ টার্মিনাল ব্যবহার করে লভ্যাংশ পাবো।

এদিকে বিদেশী কোম্পানীকে টার্মিনাল নির্মান ও ব্যবস্থাপনা লিজ দেয়ার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ। তার প্রশ্ন বন্দরের হাজার হাজার কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও এ টাকা সিন্দুকে ভরে রেখে আমরা এর-ওর কাছে কেন হাত পাতছি? তিনি বলেন, পত্রিকায় নিউজ হয় বন্দরের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় রিক্যুজিশন দিয়ে অন্যান্য খাতে টাকা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বন্দরের উন্নয়ন কেন হয়নি? তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, বন্দরের উন্নয়ন কি বন্দরের নাকি দেশের জন্য? অর্থনীতির জন্য, যদি তাই হয়ে থাকে তবে এ টাকাগুলো আমরা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে রেখে দিয়ে কেন এ দুযার টু ওই দুয়ার ঘুরছি? মাত্র তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে যে লোকগুলো আগ্রহ প্রকাশ করছে তাদের কাছে কি বন্দরের চাইতেও বেশি অর্থ বিত্ত আছে? কারো নেই, কোন একটা ব্যাংকের কাছে চুক্তিভিত্তিক টাকা নিয়ে তার এ প্রকল্প কাজ করবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় স¤পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এম এ লতিফ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশে^র সর্বাধুনিক সুবিধা পাওয়া বন্দরগুলোর মতো গড়ে তোলা কোন ব্যাপার নয়। তবে বিদেশিদের নিকট ধর্ণা না দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এ টার্মিনাল নির্মাণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বন্দর সিবিএ সভাপতি আবুল মনসুরও সাংসদ লতিফের সুরেই সুর মিলিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারে বন্দরের টাকা থাকা স্বর্ত্তেও লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ করতে বিদেশীর দ্বারস্থ কেন? তিনি লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও অপারেশনাল কার্যক্রম নিজেরা করার দাবি জানান।

তবে এই প্রকল্পকে চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে প্রথম পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প উল্লেখ করে বিদায়ী বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, এটি বেসরকারি কোন পোর্ট হবে না, নির্দিষ্ট চুক্তি ও শর্তের ভিত্তিতে ২৫/৩০ বছরের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ টার্মিনাল পরিচালনা করবে। আমরা ল্যান্ডলর্ড পোর্টের ভূমিকায় যাচ্ছি। পরবর্তীতে এটি চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নেবে।

এদিকে গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, লালদিয়ার চরে কন্টেইনার টার্মিনাল হলে যানজট আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, অফডকগুলোর কারণে এমনিতেই নগরীতে যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে। তার উপর কন্টেইনার টার্মিনাল হলে বিমান যাত্রীসহ এ পথে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়বে বলে মনে করেন মেয়র। তিনি অফডকগুলো সরিয়ে দিয়ে পোর্ট ও সিটি ট্রাফিক আলাদা করে তিনি দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা দরকার বলে মত দিয়েছেন।

অন্যদিকে বন্দর এলাকায় বিদেশী কোম্পানীকে টার্মিনাল নির্মান ও নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব দেয়া দেশের জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ও নাগরিক উদ্দ্যেগের প্রধান উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সুজন বলেন, বিভিন্ন মাফিয়া গ্রুপ এই নাম সেই নামে বিদেশী চটকদার নাম বলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে চাইছে। আমরা কোন অবস্থাতেই আমাদের স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক একটা জায়গায় বিদেশী কেউ আসুক তা চাই না। জাতির পুজি রক্ষার জন্য কিংবা অর্থনীতি রক্ষার জন্য হলেও আমরা বিদেশী কারো হাতে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে পারি না। যদি বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা ঘটে কিংবা জাহাজ ডুবির মত ঘটনা ঘটে তবে একটা জাহাজের জন্য পুরো বন্দরটাই অচল হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরে চট্টগ্রাম কাস্টমস সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বাচ্চু জানিয়েছেন, বন্দরটি যত দ্রুত নির্মাণ হবে ততই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রসার এবং বাণিজ্যিক আমদানি রপ্তানী পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে খালাসের ব্যবস্থা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এ টার্মিনাল ব্যাপক ভুমিকা রাখবে। তিনি বলেন, বর্তমানে মাল্টি জাহাজগুলি আউটারে গিয়ে আউটার থেকেই পণ্য খালাস করছে যা অনেক সময়ের ব্যাপার। লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি নির্মিত হলে জাহাজগুলি সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারবে, কম সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস হবে।

এবিএন/রাজীব সেন প্রিন্স/জসিম/জেডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত