
ঢাকা, ১২ মার্চ, এবিনিউজ : আজ ১২ মার্চ। বিশ্ব গ্লুকোমা দিবস। এ উপলক্ষে আজ সোমবার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে সকাল ৯ টায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সচেতনতার উদ্দেশ্যে রালি করা হয়। এবারের স্লোগান “পরিহারযোগ্য অন্ধত্ব প্রতিরোধ করি- বিস্ময়কর পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করি । জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গ্লুকোমা বিভাগের প্রধান ডা. ইফতেখার মনির আরো বলেন, আজ থেকে শুরু হয়েছে এবং চলবে ১৭ মার্চ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, সঠিক সময় চিকিৎসা নিতে পারলে গ্লুকোমা প্রতিরোধ করা যায় এবং এই রোগ নিয়ে সারা জীবন ভালো থাকা যায়।
গ্লুকোমায় আসলে কী হয়? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- গ্লুকোমায় চোখের নার্ভ (অপটিক নার্ভ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নির্ণয় করে চিকিৎসা চালিয়ে গেলে অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
গ্লুকোমা আসলে চোখের এক নীরব ঘাতক। এটি চোখের একটি জটিল রোগ, যাতে চোখের স্নায়ু (অপটিক নার্ভ) ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দৃষ্টি কমে যায়। অনেক সময় রোগী অন্ধত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নির্ণয় করে, ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করালে অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরীণ উচ্চচাপ এর জন্য দায়ী। চোখের অভ্যন্তরীণ এই চাপ ইন্ট্রা অকুলার প্রেশার বা আইওপি নামে পরিচিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে চোখের এই চাপ না বাড়লেও গ্লুকোমা হতে পারে।
চোখের স্বাভাবিক চাপ ১২ থেকে ২২ মি.মি./মারকারি। এই চাপ ২২-এর বেশি হলে তা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যদি কোনো রোগীর চোখের চাপ ২২-এর বেশি থাকে কিন্তু তার গ্লুকোমা না হয়, সে ক্ষেত্রে রোগটি অকুলার হাইপারটেনশন।
শুধু উচ্চ অভ্যন্তরীণ চাপই গ্লুকোমার জন্য দায়ী নয়। তবে যাদের চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বেশি, তাদের নিয়মিত চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এবার গ্লুকোমার ধরন ধরন সম্পর্কে কিছু কথা। সাধারণভাবে গ্লুকোমাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ওপের অ্যাঙ্গল বা ওয়াইড অ্যাঙ্গল গ্লুকোমা। অ্যাঙ্গল ক্লোজার গ্লুকোমা বা ন্যারো অ্যাঙ্গল গ্লুকোমা। আরেকভাবেও গ্লুকোমাকে ভাগ করা হয়। প্রাইমারি গ্লুকোমা ও সেকেন্ডারি গ্লুকোমা।
যদি জানতে চান, গ্লুকোমা কেন হয়? এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অদ্যাবধি চোখের উচ্চচাপই এই রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে স্বাভাবিক চাপেও কারো কারো এই রোগ হতে দেখা যায়। অনেক সময় চোখে আঘাত পেলেও পরবর্তীতে গ্লুকোমা হতে পারে। তাই চোখে আঘাত পেলে বা আঘাতের ইতিহাস থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এবার জেনে নেয়া যাক- যারা গ্লুকোমায় আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে। পরিবারের অন্য কোনো নিকটাত্মীয়ের (মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা, মামা, খালা, ফুপু) গ্লুকোমা থাকলে আপনিও ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এছাড়া ঊর্ধ্ব বয়স; অর্ধাৎ ৪০ বা তদূর্ধ্ব হলে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, মাইগ্রেন ধরনের মাথা ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ রাতে সেবন করা, দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ওষুধ সেবন করা, চোখের ছানি হলে ও তার অপারেশন না করালে বা দেরি করলে, চোখের জন্মগত ত্রুটি থাকলে আপনি গ্লুকোমার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
গ্লুকোমার লক্ষণ কিভাবে বুঝবেন? ব্যাপারটি সুখপ্রদ না হলেও সত্যি যে, অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এই রোগের কোনো লক্ষণ অনুধাবন করতে পারে না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার সময় হঠাৎ করেই চিকিৎসক এই রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে- ঘন ঘন চশমার পাওয়ার পরিবর্তন হওয়া। চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা। ঘন ঘন মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হওয়া। দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে আসা বা দৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাপ্তি কমে আসা। যেমন- সামনে দেখা, কিন্তু পাশে ঠিকমতো না দেখা। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় চলতে গিয়ে দরজার পাশে বা অন্য কোনো পথচারীর গায়ে ধাক্কা খায়। মৃদু আলোতে কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভূত হওয়া। ছোট বাচ্চাদের চোখের কর্নিয়া ক্রমে বড় হয়ে যাওয়া বা চোখের কর্নিয়া সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি।
কেন আপনার গ্লুকোমা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি? আমাদের দেশে ও পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ নীরব ঘাতক গ্লুকোমা। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ রোগী বুঝতে পারার আগেই চোখের স্নায়ু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই রোগে দৃষ্টির পরিসীমা বা ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে। তবে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি অনেক দিন ঠিক থাকে বিধায় রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে অনেক দেরি করে ফেলে।
গ্লুকোমা চোখের অনিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব তৈরি করে। এ রোগে দৃষ্টি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
গ্লুকোমা হলে রোগীকে সারা জীবন চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকতে হয় এবং নিয়মিত ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এর ব্যতিক্রম হলে রোগী অন্ধত্বের শিকার হতে পারেন।
তাহলে কী এর চিকিৎসা? এ রোগের প্রচলিত তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে-
১, ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা : সাধারণত চোখে ড্রপ হিসেবে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এতে চোখের অভ্যন্তরীণ তরলের চাপ অপসারণে সহায়তা হয়। তবে ওষুধটি কারো কারো ক্ষেত্রে অ্যালার্জির সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
২, লেজার চিকিৎসা : উভয় ধরনের গ্লুকোমার চিকিৎসায়ই লেজার চিকিৎসা করা যায়। সাধারণত লেজারের মাধ্যমে ট্রাবেকুলোপ্লাস্টি করা হয়। এর মাধ্যমে চোখের অভ্যন্তরীণ যে তরল চাপ সৃষ্টি করে, তার যথাযথ ড্রেইন করা সম্ভব হয়।
৩, শল্য চিকিৎসা বা সার্জারি : সাধারণত ট্রাবেকুলেকটমি নামের মাইক্রো সার্জারি করা হয়। এটিও চোখের অভ্যন্তরীণ তরলের চাপ কমিয়ে অপটিক নার্ভ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
যেহেতু চোখের উচ্চ চাপ এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই ওষুধের মাধ্যমে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে একাধিক পদ্ধতিও প্রয়োগ করার দরকার হতে পারে। তাই যাদের গ্লুকোমা আছে, তাদের তিন মাস অন্তর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে এ রোগের নিয়মিত কিছু পরীক্ষা করিয়ে দেখতে হবে- রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে কি-না।
এ ক্ষেত্রে আপনাকে পরীক্ষা করাতে হবে- দৃষ্টিশক্তি, চোখের চাপ, দৃষ্টির ব্যাপ্তি বা ভিজ্যুয়াল ফিল্ড, চোখের নার্ভ।
যদি গ্লুকোমা রোগী হন তাহলে কী করবেন? এ ক্ষেত্রে আপনার করণীয় হবে- চিকিৎসক চক্ষু পরীক্ষা করে চোখের চাপের মাত্রা নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন, তা নিয়মিত ব্যবহার করা।
দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে এর কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। তাই নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
অল্প আলোতে পড়ালেখা বা কম্পিউটারে কাজ না করা।
খুব সূক্ষ্ম কাজ; যেমন- সেলাই এড়িয়ে চলা।
একসঙ্গে বেশি পরিমাণ পানি পান না করা (চল্লিশোর্ধ্ব যে কারো একসঙ্গে এক লিটারের বেশি পানি পান না করাই ভালো।)
পরিবারের অন্যদেরও চোখ পরীক্ষা করিয়ে গ্লুকোমা আছে কি-না তা নিশ্চিত হওয়া।
তবে আশার কথা হচ্ছে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা হলেও ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করে ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে একজন গ্লুকোমা রোগী তার স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে বাকি জীবন সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে পারে।
এবিএন/জনি/জসিম/জেডি