![দৃষ্টির নীরব ঘাতক গ্লুকোমা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/26/glucoma_132205.jpg)
ডা. এম এ করিম, ২৬ মার্চ, এবিনিউজ : নীরব অন্ধত্বের প্রধান কারণ গ্লুকোমা একটি মারাত্মক চোখের রোগ। এই জটিল রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য বিশ্ব গ্লুকোমা সমিতি প্রতি বছর বিশ্ব গ্লুকোমা দিবস ও বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ আয়োজন করে থাকে। মার্চ মাসের ১১ থেকে ১৭ তারিখ পালিত হয়েছে বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ। এই বছর সমিতির শ্লোগান হচ্ছে Beat invisible Glaucoma অর্থাৎ উপসর্গহীন গ্লুকোমা প্রতিরোধ করুন। অন্ধত্বের প্রধান কারণ হলেও সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সারাজীবন স্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব।
অন্ধত্ব একটি অভিশাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে সারা পৃথিবীতে সাত কোটিরও বেশি মানুষ এই ভয়াবহ গ্লুকোমা রোগের অভিশাপে অন্ধত্ব বরণ করছে যার অর্ধেক শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে বিদ্যমান। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জরিপে দেখা গেছে আমাদের দেশের অন্ধত্বের শতকরা ১.২ ভাগ গ্লুকোমা রোগী এবং শতকরা ৩.১ ভাগ মানুষ গ্লুকোমা রোগে ভুগছে।
গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ। এই রোগকে দৃষ্টির নীরব ঘাতক বলা হয়। এই রোগের ফলে মানুষের দৃষ্টি তুষের আগুনের মতো ধীরে ধীরে কোনো কিছু বুঝার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। চোখের অভ্যন্তরীণ উচ্চ চাপই এই রোগের প্রধান কারণ, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখের স্বাভাবিক চাপেও এই রোগ হয়ে থাকে। চোখের এই অভ্যন্তরীণ চাপ চোখের অতি সংবেদনশীল অপটিক নার্ভ, যার মাধ্যমে চোখ মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়, ফলে মানুষ অন্ধত্ব বরণ করে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ উপসর্গবিহীন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে পার্শ্ব দৃষ্টিশক্তি কমে যায় বলে মানুষ তার রোগের উপস্থিতি বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে তখন বেশিরভাগ দৃষ্টিই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। গ্লুকোমা রোগ যেকোনো মানুষের যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে বৃদ্ধ বয়সে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি।
শিশুদের গ্লুকোমা আরো ভয়ঙ্কর। কিছু কিছু শিশু জন্মগ্রহণ করে গ্লুকোমা নামক একটি দৃষ্টিবিধ্বংসী জটিল রোগের অভিশাপ নিয়ে। এই সমস্ত শিশুরা স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বড় চোখ নিয়ে জন্মায়। তারা আলোতে তাকাতে অসুবিধা বোধ করে এবং চোখ দিয়ে পানিপড়া নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে। বাবা-মায়েরা খুশি হয় সন্তানের বড় বড় চোখ দেখে, কিন্তু এই বড় বড় সুন্দর চোখের আড়ালে থাকে শিশুদের গ্লুকোমা। সময়মতো নির্ণয় হলে এবং সফল অপারেশনের মাধ্যমে এই সব শিশুদের দৃষ্টি সংরক্ষণ করা সম্ভব, অন্যথায় অন্ধত্ব অনিবার্য।
পরিবারের কোনো সদস্য গ্লুকোমা রোগে ভুগলে অন্য সদস্যদের হওয়ার সম্ভাবনা চার গুণ বেশি। তা ছাড়া যারা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, গলগণ্ড রোগ ও ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন তাদের ক্ষেত্রে গ্লুকোমা রোগ বেশি দেখা যায়। সময়মতো ছানি অপারেশন না করা এবং ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহার করার ফলেও এই রোগ হতে পারে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্লুকোমা রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। যার ফলে এই রোগকে দৃষ্টির নীরব ঘাতক বলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকেলবেলায় হালকা মাথাব্যথা, ঘন ঘন চশমার পাওয়ার পরিবর্তন হওয়া, চোখ লাল হওয়া ও চোখে ব্যথা নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসে।
গ্লুকোমা রোগ নির্ণয়ের প্রায় সব রকম ব্যবস্থাই আমাদের দেশে বিদ্যমান। যার মাধ্যমে গ্লুকোমা রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা সম্ভব। এইসব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে OCT, Visual Field Analyzer, VEP and Tenometer সহ সব রকমের আধুনিক যন্ত্রপাতি। একজন গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ চোখের ডাক্তারের পরামর্শ ও পরীক্ষার মাধ্যমে এই জটিল রোগের ভয়াবহ ছোবল থেকে নিজের দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করতে পারে।
গ্লুকোমা রোগ নির্ণয় জটিল হলেও এই রোগের চিকিৎসা তুলনামূলক সহজ। যেহেতু এই রোগ নিরাময় হয় না, সেহেতু চিকিৎসার উদ্দেশ্য হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করা, যাতে আরো খারাপ হয়ে না যায়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে গ্লুকোমা রোগীর দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ নির্ণয় সম্ভব হলে এবং সঠিক চিকিৎসা অব্যাহত রাখলে এই রোগ থেকে অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ নিয়ন্ত্রণই এই রোগের প্রধান চিকিৎসা। চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক মাত্রার ওষুধ নিয়মিত সেবন করা, বিশেষ ক্ষেত্রে লেসার রশ্মির ব্যবহার অথবা অনিয়ন্ত্রিত চোখের চাপ অপারেশন এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
যেহেতু গ্লুকোমা উপসর্গবিহীন একটি রোগ এবং দৃষ্টির নীরব ঘাতক সেহেতু মানুষ সাধারণত সহজে বুঝতেই পারে না যে গ্লুকোমা রোগে ভুগছে। নিয়মিত গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ দ্বারা চক্ষু পরীক্ষার মাধ্যমেই এই রোগ নির্ণয় সম্ভব। যাদের পরিবারের কোনো সদস্য গ্লুকোমা রোগে ভুগছে তাদের সবাইকে পরীক্ষা করানো উচিত। যারা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, গলগণ্ড রোগ অথবা ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন তাদেরও পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। মাথাব্যথা, ঘন ঘন চশমার পাওয়ার পরিবর্তন ও চোখে ব্যথা থাকলেও তাদের চোখ পরীক্ষা করা প্রয়োজন এই রোগ নির্ণয়ের জন্য। যেহেতু বৃদ্ধ বয়সে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি সেহেতু চল্লিশ বছর হওয়ার সাথে সাথে সবাইকে গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
দৃষ্টিহরণকারী এই মারাত্মক রোগ গ্লুকোমা প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করা সম্ভব। শিশু জন্মের পর অস্বাভাবিক চোখের গঠন দেখে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং চক্ষু পরীক্ষার মাধ্যমে তাকে রক্ষা করতে হবে জন্মগত গ্লুকোমার অন্ধত্ব থেকে। সময়মতো ছানির চিকিৎসা করে ছানিজনিত গ্লুকোমা থেকে দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব। অ্যালার্জি জাতীয় চোখের চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকারক র্ওণরমধঢ জাতীয় ওষুধ পরিহার করে দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব। এই রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বেতার, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করা সম্ভব। এলাকাভিত্তিক জরিপের মাধ্যমে বাছাইকৃত বয়স্ক লোকদের পরীক্ষার মাধ্যমেও এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। (সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি