বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

হুমকির মুখে ভোলার চরাঞ্চলের নারী ও শিশুরা

হুমকির মুখে ভোলার চরাঞ্চলের নারী ও শিশুরা

ভোলা, ২৮ মার্চ, এবিনিউজ : জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের অন্যতম বাংলাদেশ। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপজেলা ভোলা।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এই জেলার নদী ভাঙনসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত ৪৭ বছরে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারনে ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, পানির লবণাক্ততার কারনে ফসলের উৎপাদন হ্রাস, বনায়নে বৃক্ষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিশুরা ও নারীরা। প্রান্তিক এলাকার শিশু ও নারীরা বিভিন্ন রোগ, মহামারী, দুর্ঘটনা ইত্যাদির শিকার হচ্ছে। মা ও শিশুর অপুষ্টি এবং মাতৃমৃত্যু হার বেড়ে চলছে। পরিবারে মহিলারা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে খাদ্য প্রস্তুত, জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে।

অনেকে কিশোরীরা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেনা। এছাড়াও জীবন-জীবিকা হুমকীর মুখে পড়ে অনেক পরিবার উদ্বাস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই নদী ভাঙ্গন সহ নানা কারনে এলাকা ছেড়ে রাজধানীতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে উদ্বাস্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাই সময়ের প্রয়োজনে এখনই সরকারি ও বেসরকারিভাবে সকলের সম্মলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করার আহবান সচেতন মহল।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এ জেলায় শীতের দিনে গরম, ঘন ঘন দুর্যোগ ও অতিবৃষ্টির কারণে জনজীবনে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা। তারা আরো বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন উপকূলবর্তী এলাকার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।

এর মধ্যে আবার নতুন করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা ও আতঙ্ক।

পাউবোর হিসাব অনুযায়ী, গত ৪৭ বছরে জেলার ৬০ কিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়ে লাখের বেশি মানুষ ঘর-বাড়ী হারিয়ে বাস্তুহারা হয়েছেন। ঠিকানাহারা হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

উপকূল ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও মহাসেনর ভয়াবহতার পরেও যেন মানুষের সংকট কিছুতেই কাটছে না। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বহু মানুষ। বর্তমানে জলবায়ুর প্রভাবে মাছের সংকট, খেতের ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়া ও বনায়নে মারা যাচ্ছে বৃক্ষ। হুমকির মুখে ভোলার চরাঞ্চলের নারী ও শিশুরাসংরক্ষিত বনে খাদ্য ও মিঠা পানির সংকট দেখা দেওয়ায় লোকালয়ে ছুটে আসছে হরিণ। বন্য পশু-পাখিদের আবাসস্থলে বিচরণ করতে অনেকটাই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট মহল।

উপকূল নিয়ে কাজ করা বেসরকারি (এনজিও) সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মিজানুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টির সময় বৃষ্টি হচ্ছে না, শীতের সময়েও সকালে শীত আবার বিকেলে গরম পড়ছে। তিনি বলেন, আগে জেলেরা সারাদিন নদীতে থাকলেও তাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হতো না। কিন্তু এখন সামান্য সময় নদীতে থাকলেই তারা নানা অসুখ-বিসুখে ভুগছেন। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

ভোলা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহাবুব আলম বলেন, ভূগোল বিভাগের বায়ূমন্ডলে কার্বন নি:সরনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ূ পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নারী ও শিশুরা।

বিশেষ করে ভোলার উপকূলীয় জনপদের নারীরা বিপর্যস্ত। প্রান্তিক এসব এলাকার শিশু ও নারীরা বিভিন্ন রোগ, মহামারী, দুর্ঘটনা, পুষ্টিহীনতাসহ নানা ধরনের সমস্যার শিকার হচ্ছে। শিশুরা ঠিকমত বিকশিত হতে পারছে না। তাদের পড়ালেখায় মারাত্মক বেঘাত ঘটছে। পুষ্টিহীনতায় অনেক মা ও শিশু মারা যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে দক্ষিণাঞ্চলের নারী ও শিশুরা হুমকির মুখে পড়বে।

আজকের ভোলা সম্পাদক আলহাজ্ব মু. শওকাত হোসেন বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি ভোলায় গত কয়েক বছর ধরে শীত, গরমের ভারসাম্যহীনতা ও নদী ভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে চরাঞ্চলের সাধারন মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টি বেশি হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এসব এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং গো খাদ্যের অভাবে পুশু পালন হুমকির মুখে পড়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের চরকুরী-মুকরী, ঢালচরসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে সবুজ বেষ্টুনী প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দ্বীপবাসীকে অনেকটা রক্ষা করছে। তবে জলবায়ূর পরিবর্তনের কারণে আমরা খুবই শঙ্কিত। এজন্যই আমরা মনে করছি, আগামীতে আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য এখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও ডুবোচরের সৃষ্টি হওয়ায় সাগর থেকে মাছ নদীতে আসতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। দিন দিন এ সমস্যা বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে মৎস্য বিভাগ উদ্বিগ্ন।

ভোলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক প্রশান্ত কুমাড় সাহা বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ফসলের খেতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধান ও গম চাষ হুমকির মুখে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কৃষক তাদের জমিতে ধান ও গমসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করতে পারবেন না। এ সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মজবুত বেড়িবাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ করতে হবে, যাতে লবণাক্ত পানি ফসলের খেতে প্রবেশ করতে না পারে। এছাড়াও খাল খনন করাও জরুরি।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. বাবুল আক্তার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভোলা সদর, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ৩৯ কিলোমিটার ও চরফ্যাশন উপজেলা তেঁতুলিয়ায় বিভিন্ন পয়েন্ট ১০ কিলোমিটার বিলীন হয়ে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদী ভাঙন ও পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে উল্লেখ করে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিয়া বলেন, ম্যানগ্রোভ বনের চারা লবণাক্ত পানির কারণে মরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। জলাশয়গুলো শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে লোনা পানির দখলে চলে যাচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যের বিচরণ হুমকির মুখে পড়ছে। এদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বিশ্ব উষ্ণায়ন আর গ্রিন হাউজ এফেক্টের ভয়াল ছোবল থেকে ৩ হাজার ৪৪৮ বর্গকিলোমিটারের এ ভোলাকে রক্ষার দাবি সর্বমহলের।

ভোলার জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক বলেন, ভোলা একটি উপকূলীয় দ্বীপজেলা। এ জেলায় অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে মিঠা পানির এলাকাগুলো লবনাক্ত হয়ে পড়ছে, কৃষক তার কৃষি জমি হারাচ্ছে। নদী ভাঙনের সাথে সাথে দ্বীপজেলা ভোলার আয়তন ছোট হয়ে আসছে। নারী ও শিশুরা চরম স্বাস্থ্য ঝূঁকি ও জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বাস্ত মানুষের সংখ্যা। এর জন্য চাই সময় উপযোগী পদক্ষেপ।

ইতিমধ্যেই জলবায়ু ট্রাস্টের আওতায় বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রভাবে যেন ব্যাপক ক্ষতি না হয় সেজন্য জলবায়ু মোকাবেলায় বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু প্রজেক্ট বিভিন্ন চরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

এবিএন/আদিল হোসেন তপু/জসিম/এমসি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত