![অটিজম নিয়ে মানুষের ধারণা কতটা বদলেছে](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/02/otizim-home_133316.jpg)
ঢাকা, ০২ এপ্রিল, এবিনিউজ : মানিকগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা ঘিওর। সেখানকার সরদর ইউনিয়নের একজন তরুণ আব্দুল পারিশ।
ছোটবেলা থেকেই তার আচার-আচরণে বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেতে থাকে। এ অববস্থাতেই কেটে যায় বছরের পর বছর।
এই দীর্ঘসময় আব্দুল পারিশকে কোনো ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পরিবারটি প্রথমদিকে বুঝতেই পারেনি তার সমস্যা মূলত কী।
পরবর্তী সময়ে তারা পাবনার মানসিক হাসপাতালে গেলেও সেখান থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। পারিশের ভাই অহিদুল ইসলাম জানান, স্বাভাবিক মানুষের যে চলাফেরা, মানুষকে সঙ্গ দেয়া, পারিশ এমন কিছু করত না। সবসময় একা একা থাকত। খাবার খেতো না। মায়ের সাথেও খারাপ ব্যবহার করতো।
আব্দুল পারিশের বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বে থাকেন আরেক যুবক রঞ্জন চন্দ্রের পরিবার। সেখানে গিয়ে দেখা গেল রঞ্জনের পা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা।
৫ বছর ধরে একই অবস্থায় রাখা হয়েছে তাকে। দুই-তিন মাস পর পর তার পায়ের শিকল খুলে দেয়া হয় বলে জানান তার বাবা রুপন চন্দ্র।
কিন্তু শেকল দেয়ার কারণ কী- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তার ছেলে আশে-পাশের বাড়িঘরে যায়, লোকজনকে বিরক্ত করে। পরে সবার চাপে তিনি পায়ে শিকল দিয়ে রেখেছেন।
ছেলেকে স্কুলেও ভর্তি করলেও অন্য ছাত্ররা অভিযোগ দেয়ায় ফিরিয়ে আনতে হয়।
পরে রঞ্জনকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে জানতে পারেন তার ছেলের ‘অটিজম’।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এখনো অনেক পরিবারই আছে যারা অটিজম সঠিকভাবে বুঝতে বা শনাক্ত করতে পারেন না। ফলে সেসব পরিবারের জন্ম নেয়া বিশেষ শিশুটিকে বছরের পর বছর সমাজের সবার কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
সামাজিক কোনো আচার অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রে সমাজের মানুষেরাও তাদের দূরে সরিয়ে রাখে এক ধরনের কুসংস্কার থেকে।
বাংলাদেশে ঠিক কতজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত-সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান এখনো নেই।
তবে বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ অনুসারে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে অটিজম শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজার। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে বহু পরিবার আছে যেখানে অটিজম আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার ব্যাপারে পুরনো মানসিকতা খুব একটা বদলায়নি।
চিকিৎসকরা বলছেন, অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত এক ধরনের সমস্যা যার কারণে একটি শিশু সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনা। কিন্তু দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলে এই শিশুরাও অন্যান্য শিশুদের মতো উন্নতি করতে পারে।
২০০৯ সালের এক হিসাব অনুযাযী, দেশের ১ শতাংশ শিশু অটিজমে আক্রান্ত। এর পর ২০১৩ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ঢাকা শহরে ৩ শতাংশ শিশু অটিজমে আক্রান্ত।
তবে বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ অনুসারে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে অটিজম শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজার।এবং মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার জন।
দেশে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বর্তমানে অনেক কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ সীমিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অটিজম সংক্রান্ত ইনস্টিটিউট ইপনাতে চিকিৎসার পাশাপাশি রয়েছে অটিজম স্কুল। এখানে প্রতিদিনই গড়ে একশ থেকে দেড়শ রোগী আসেন আউটডোরে চিকিৎসা নিতে।
অটিজম নিয়ে মানুষের ধারণা কতটা বদলেছে এ বিষয়ে ইনস্টিটিউটের প্রধান শাহীন আখতারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, গ্রামের দিকে অনেকেই জানেননা অটিজম কি, সেটা যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয় সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। অনেকে এখনো বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের পাগল মনে করে, আবার অনেকে মনে করে যে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, মানে বোকা। কিন্তু এসব ধারণার কোনটাই ঠিক না।।
বহুদিনের প্রাচীন ধারণা মোতাবেক বেশিরভাগ পরিবারই তাদের অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা বা শিক্ষার বাইরে রাখছে। তবে সে অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
শাহীন আখতার বলেন, ‘এখন অনেক বাবা মা-ই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চিকিৎসার জন্য ছেলেমেয়েদের এখানে নিয়ে আসছেন।’
দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর ১৬টিতে শিশু-বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোয় অটিজম শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহর বা গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে কেবল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী সাহায্য ও সেবাকেন্দ্র।
ফলে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগগুলো শহরে ঘরে ঘরে যতটা পৌঁছে যাচ্ছে, শহরের বাইরের পরিবারগুলোর কাছে তা অনেকটাই দূরবর্তী সুযোগ-সুবিধার মধ্যে আটকে আছে।
এবিএন/সাদিক/জসিম