![গোবিন্দগঞ্জে বাহা পরবে উৎসবে মেতে উঠলো সাঁওতালরা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/07/abnews24.bbbbbbbbb_134120.jpg)
গাইবান্ধা, ০৭ এপ্রিল, এবিনিউজ : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল সম্প্রদায় নিজস্ব ঐতিহ্যে নেচে-গেয়ে আনন্দের সাথে বরণ করলেন ঋতুরাজ বসন্তকে। নিজস্ব কৃষ্টি বাহা পরবে মাতলো গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পল্লী বাগদা বাজার কাটাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন মাঠে বাহা পরব বা বসন্ত উৎসবে মেতে ওঠে আদিবাসী সাঁওতালরা। আজ শনিবার বাহা পরব উদযাপন কমিটি, এনডিএফ ও পারগানা পরিষদের আয়োজনে উৎসবে ইউএনডিপি-হিউম্যান রাইটস্ প্রোগ্রাম ও অবলম্বন পৃষ্ঠপোষকতা করে। নেচে-গেয়ে আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতিতে বাহা পরবের মাধ্যমে বরণ করেন ঋতুরাজ বসন্তকে।
দিনভর ধর্মীয় পুজা-অর্চনা ও উত্তর জনপদের জনপ্রিয় সাঁওতাল সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক সাঁওতাল নারী-পুরুষ-কিশোরী অংশ নেন। বিভিন্ন বর্ণের আদিবাসী-বাঙালিদের আগমনে মিলন মেলায় পরিণত হয় গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী। পরে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের পাশাপাশি আমন্ত্রিত সাঁওতাল সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা দর্শকদের মুগ্ধ করেন। এতে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ৬টি ইউনিয়নের ৮টি সংস্কৃতিক দল অংশগ্রহণ করে।
গত বছরের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল হত্যা ও তাদের বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদের দেড়বছর পর উৎসবের আয়োজন করা হলো। দীর্ঘদিন পর এ ধরনের উৎসবের সুযোগ পেয়ে সাঁওতালরা সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উৎসবের মহড়া দিতে থাকে। উৎসবের জন্য কেনা হয় নতুন কাপড়। উৎসবস্থল আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া সম্বলিত ফেস্টুনে সুসজ্জিত করা হয়।
এতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র পাঠ করে আদিবাসী যুবক আন্দ্রিয়াস মুরমু ও মানবাধিকার সনদ পাঠ করেন প্রিসিলা মুরমু। সকালে পুজা-অর্চনার পর বাহা পরবের প্রথম অংশে আলোচনা সভা ও পরে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল, বক্তব্য রাখেন, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) রাফিউল আলম, গাইবান্ধা জেলা উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদের আহবায়ক এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু, কাটাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক, এনডিএফ এর নির্বাহী পরিচালক ভিক্টর লাকরা, অবলম্বনের নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী, পারগানা পরিষদের সভাপতি রুসন কিসকু, আদিবাসী গবেষক কেরিনা হাসদা প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন বাহা পরব উদ্্যাপন কমিটি আহবায়ক ফিলিমন বাস্কে।
বসন্ত ঋতু আসলেই গাছে গাছে নতুন ফুলের সমারোহ প্রকৃতি প্রিয় মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। শিমুল, পলাশে শোভায় প্রকৃতি নিজেকে নতুন রূপে প্রকাশ করে। আদিবাসী সাঁওতালরাও বসন্তকে বরণ করে নেয় তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য দিয়ে। এসময় সাঁওতাল তরুনীরা নতুন নতুন ফুল তাদের খোঁপায় গেঁথে আনন্দে নাচে-গানে মেতে ওঠে। সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে চলে আনন্দ উৎসব। বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় হাঁড়িয়া। সবাই হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দে বিভোর হয়ে মাদলের তালে তালে গাইতে থাকে, নাচতে থাকে। আর সেই আনন্দ-উৎসবের নাম ‘‘বাহা পরব’’।
আদিবাসী সাঁওতালদের অন্যতম একটি প্রধান পার্বণ হচ্ছে ‘‘বাহা উৎসব’’ বা বাহা পরব। বাহা অর্থ ফুল। তাই বাংলায় বাহা পরবকে ‘‘ফুল উৎসব’’ বলা হয়। মূলত, নববর্ষ হিসেবে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী-সাঁওতালরা। উত্তরাঞ্চলে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে উড়াও, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়ী, রাজওয়ারসীসহ মোট ৩৮ টি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী এই বাহা উৎসব পালন করে থাকে।
বাহা পরবের মূল কথা হচ্ছে এই পরব না করা পর্যন্ত সাঁওতাল মেয়েরা সারজম বাহা (শাল ফুল), ইচাক বাহা, মুরুপ বাহা এগুলো খোঁপায় দিতে পারেনা। এই পরবের মধ্য দিয়েই নতুন বছরের ফুল, ফল, পাতাকে সাঁওতাল আদিবাসীরা ব্যবহার করতে শুরু করে।
বাহা পরব উদ্্যাপন কমিটি আহবায়ক ফিলিমন বাস্কে বলেন, আমরা প্রকৃতিকে ভালোবেসে সাঁওতাল আদিবাসীরা বাহা উৎসব পালন করি। এই বাহা উৎসবের পুজা পার্বন করলে আমাদের সমাজ ও পরিবারের উন্নয়ন হবে। বাহা পুজা না করা পর্যন্ত আমাদের আদিবাসী সাঁওতাল নারীরা বাহা ফুল অর্থাৎ শাল ফুল ছিড়েও না মাথায় পরেও না। বছরের শুরুতে যেই নতুন ফুল ফুটে বা যেই এলাকায় যেই ফুল পাওয়া যায় সেই ফুল দিয়েই এই বাহা উৎসব পালন করা হয়। আর নতুন প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে শিখবে ও দেখবে এবং যাতে ভবিষ্যতে এই ঐতিহ্যবাহী বাহা পরব নষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল বলেন, আদিবাসীরা আদিবাসীরা আমাদের এ’দেশেরই নাগরিক। তাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য এ’দেশের সংস্কৃতিরই অংশ। তাদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।
এবিএন/আরিফ উদ্দিন/জসিম/তোহা