![কুটির শিল্প রক্ষায় দরকার সরকারি পৃষ্টপোষকতা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/23/kuthir_abnews_136480.jpg)
কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা), ২৩ এপ্রিল, এবিনিউজ : বাংলাদেশের কুটির শিল্প ও বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশে দলিত জনগোষ্ঠীর বিশেষ অবদান রয়েছে। কালের আবর্তনে বিদেশী শিল্প ও বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে কুটির শিল্প ও বাঙালি সংস্কৃতি।
এছাড়া অসা¤প্রদায়িক চেতনার লোক কমে যাওয়া বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ না নিলে এসবের পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
প্রবীণরা জানান, অবিভক্ত বাংলাদেশে জমিদার আমল থেকেই সংখ্যালঘুদের একাংশের সঙ্গে দলিত জনগোষ্টী বাঁশ, বেত, চামড়া, কাঠ ও মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করে বাঙালী সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। দলিত জনগোষ্টীর তৈরি ধানের গোলা, ঢোল, খোল, খঞ্জনী, ঢোলক, জুতা, চামড়ার ব্যাগ, কোমরের বেল্ট, ঝুঁড়ি, কুলো, ধামা, চেঙারী, চাঁচ, পালকি, দাঁড়ি পাল্লা, মাদুর, চাটাই, শীতলপার্টি, তাল পাখা, পেকে ,টোকা, দোলনা, শোফা, আঁটল, পাটা, ফুলদানি, লক্ষীর আঁড়ি চেয়ার, টেবিল,ঢেঁকি, গরুর গাড়ি, কলস, ভাঁড়, নাদা, খোপ,শানুক, থালা, গ্লাস, চায়ের ভাড়, ভা-ার, মাটির মুর্তি, দা, বটি, ছুরি, কাঁচি, কার্পেট, চটের ব্যাগ, শপিং ব্যাগসহ বিভিন্ন কুটির শিল্প সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেলা প্রাঙ্গনকে আলোকিত করতো। গ্রাম গঞ্জের বিভিন্ন হাট ও বাজারে বিক্রি হতো এসব পণ্য।
অনেক ক্ষেত্রে উন্নত মানের রঙবাহারী পণ্য কোলকাতা ও ঢাকা শহর ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতো। জমিদাররা দলিত জনগোষ্টীর তৈরি পাদুকা ব্যবহার করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতেন। তাদের তৈরি গোলা, লক্ষীর আঁড়ি প্রতি ঘরে ঘরে শোভা পেতো। পুজা পার্বন ছাড়াও যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঢাঁক ও ঢোলের ব্যবহার ছিল যথেষ্ট। ঢোল ও ব্যা- বাজতো বিয়েতে। তারা জানান, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, দোল উৎসব, রাস মেলা, বনবিবি পুজা, কালীপুজা, সরস্বতীপুজা, শারদীয় দুর্গা পুজা, বাসন্তী পুজা, বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা, গঙ্গাস্নান উপলক্ষে বারুনি মেলা,নবান্ন উৎসব, ঘুড়ি উড়ানো উৎসব, মনষা পুজা, গুড় পুকুরের মেলা, ভাসান গান, ধর্মীয় যাত্রাপালা, বালক কীর্তন, শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা, শ্রী শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ও কার্তিক পুজা বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। এসব অনুষ্ঠানে দলিতদের তৈরি বিভিন্ন পন্য বিক্রি হতো। দেশীয় ছাড়াও বিদেশের অতিথিরা মেলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত স্টল থেকে এসব পন্য কিনতেন।
এসব পণ্যে তৈরিতে যেসব উপাদানের প্রয়োজন হতো তার অধিকাংশই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যেতো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পতিত জমিরপরিমান কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদন কমতে শুরু করে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সিডোর, আইলাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নদী ও সুন্দরবন উপকুলবর্তী এলাকার বনভূমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কুটির শিল্পে ব্যবহৃত বাঁশ, বেত, মেলে, শন, এঁটেল মাটি ও পাটের উৎপাদন কমতে থাকে। একইসাথে কম উৎপাদিত এসব উপাদানের বাজার দামও বাড়তে থাকে। বেশি দাম দিয়ে নির্মাণ সামগ্রী কিনে বাজারে ন্যয্য দাম না পাওয়ায় অনেকেই হতাশ হয়ে পেশা পরিবর্তণ করতে বাধ্য হন।
এ সুযোগে চটকদারি প্লাস্টিক, নাইলন ও স্টীলের পণ্য সামগ্রী বাজার দখল করে নেয়। বাঁশ ও বেতের তৈরি দীর্ঘস্থায়ী জিনিসের চেয়ে ওইসব পণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় ক্রেতারাও বেশি করে উৎসাহিত হয়। ফলে কালের বিবর্তনে প্লাষ্টিক সামগ্রী, চিনা মাটি, কড়ি, স্টীল, পলিথিন, ফাইবার গ্লাস নির্মিত সামগ্রী বাজারে আসতে শুরু করায় ঐতিহ্যবাহি বাঙালী কুটির শিল্পের কদর কমতে শুরু করে। অসম এ প্রতিযোগিতায় একদিন হারিয়ে যাবে প্রাচীন কুটির শিল্প ও শিল্পীরা।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুকুমার দাস মনে করেন, বাঙালী সংস্কৃতি, দলিত জনগোষ্টী ও তাদের নির্মিত কুটির শিল্প অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। বাঙালী সংস্কৃতি না থাকলে থাকবে না কুটির শিল্প ও দলিত জনগোষ্টী। তাই কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত দলিত শিল্পীদের সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহজ ও সরল সুদে বা বিনা সুদে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের সুব্যবস্থা করতে হবে। দলিতদের উৎপাদিত কুটির শিল্প বাজারজাতকরণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বিপনন ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় ও জেলায় ওইসব পণ্য কেনা বেচার জন্য বাজার বা হাট সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন মেলায় স্টল দেওয়ার ক্ষেত্রে দলিত জনগোষ্ঠীকে সহজ শর্তে সূযোগ দিতে হবে। হাট, বাজার ও মেলায় দলিত জনগোষ্টীর উৎপাদিত কুটির শিল্পের ন্যয্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যক্ষ প্রফেসর সুকুমার দাস আরো বলেন, ধমীয় কুসংস্কারের কারণে দলিত জনগোষ্টীকে কোথাও কোথাও ধমীয় অনুষ্ঠানে অচ্ছুৎ ঘোষণা করা হয়। ঢাক ও ঢোল বাজানো ছাড়া তাদেরকে মূল অনুষ্ঠানে শরীক হতে দেওয়া হয় না। তাই মানব সভ্যতা রক্ষায় ধমীয় কুসংস্কার ভুলে দলিত জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেমন বনবিবি পুজা, ভাষান গান, ধমীয় যাত্রাপালা, দোল উৎসব, নামযজ্ঞসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারি পৃষ্টপোষকতা থাকতে হবে। থাকতে হবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিদেশীদের কুটির শিল্প কিনতে আগ্রহী করতে সরকারিভাবে প্রদর্শণীর আয়োজন করতে হবে।
এছাড়া তাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিগুলোতে পুনঃরুদ্ধারে দল, মত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে সহায়তা করতে হবে। বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব মুক্ত করে বিদেশী পণ্য বর্জন করতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দলিতরা যাতে মৌলবাদিদের দারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে ন্যয়বিচার বঞ্চিত দলিত জনগোষ্ঠী পেশা পরিবর্তন করে জন্মভুমি ছেড়ে ভিন্ন স্থানে বা দেশ ত্যাগে বাধ্য হবে। বিপন্ন হবে কুটির শিল্প ও বাঙালী সংস্কৃতি। ২০০৫ সালে গুড়পুকুরের মেলা চলাকালিন জেএমবির বোমা হামলা চালানোর পর ওই মেলাসহ বৈশাখীমেলার জৌলুস হারিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্পনগরী ও শিল্প সহায়ক কেন্দ্রের উপ-ব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বলেন, এক সময় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়ে দলিত জনগোষ্ঠীকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হলেও তারা পরবর্তীতে আর পরিশোধ করেনি। এসব কারণে চলতি বছরে দলিত জনগোষ্ঠীর কুটির শিল্প উৎপাদনে কোন সরকারি বাজেট বা প্রকল্প নেই। তবে যে সমস্ত এলাকায় দলিতদের নির্মিত কুটির শিল্প পাওয়া যায় সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে সরকারিভাবে বাজারজাত করণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
একই সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শিল্পের মান উন্নয়নে সরকারিভাবে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এজন্য দলিত জনগোষ্ঠীর বসতি খুঁজে তাদের সঙ্গে কথা বলা হবে।
এবিএন/রফিকুল ইসলাম/জসিম/এমসি