শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
logo

জন্ডিস থেকে লিভারে ফোঁড়া: কারণ ও প্রতিকার

জন্ডিস থেকে লিভারে ফোঁড়া: কারণ ও প্রতিকার

ডা. প্রধীর বঞ্জন নাথ, ৩০ এপ্রিল, এবিনিউজ : আমরা সবাই কমবেশি জন্ডিস বা পান্ডুরোগের সাথে পরিচিত। বিভিন্ন স্থানে এর বিভিন্ন নাম আছে : যেমন কামলা, কাওলা, পালং ইত্যাদি। রক্তে বিলিরুবিন এর পরিমান বেড়ে গেলে চোখের সাদা অংশ, ঝিল্লি ও চামড়া হলুদ হয়ে যায় এবং রক্তের বাইল পিগমেন্ট বেরিয়ে যাওয়াকে জন্ডিস বলে। অবহেলা করলে এই ব্যাধি হতে অনেক সময় জটিল উপসর্গ সৃষ্টি হতে পারে তখন মৃত্যু ভয় অত্যন্ত প্রকট হয়। জন্ডিস থেকে অনেক সময় লিভারে ফোঁড়া হতে পারে, কখনো কখনো লিভার সিরোসিস্‌ হতে পারে। এমনকি এই জন্ডিস থেকে লিভার ক্যানসার হতে পারে।

জন্ডিসের কারণ :

১. হিমোলাইসিস অধিক মাত্রায় রক্তের লোহিত কণিকা ভাঙা হলে অধিক পরিমাণ বিলিরুবিন নিঃসরণ ঘটায় এবং সুস্থ লিভার স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ছয়গুণ অধিক বিলিরুবিন সরাতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও অধিক বিলিরুবিন তৈরি হলে তখন জন্ডিস আকারে দেখা যায়। তবে স্বভাবতই এক্ষেত্রে জন্ডিস হয় মৃদু (মাইল্ড)। এ ধরনের জন্ডিসে অতিমাত্রায় লোহিত কণিকা (আর. বি. সি) ভাঙা হয় বলে রক্তশূন্যতাও প্রকট হয়, ফলে এ ধরনের রোগীকে একত্রে হিমোলাইটিক জন্ডিস বলা হয়।

২. লিভারের বিলিরুবিন নিঃসরণ করার ক্ষমতা কম হলে স্বাভাবিক মাত্রায় উৎপন্ন বিলিরুবিনও এক সময় রক্তে জমা হতে হতে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। এগুলো শিশুদের ক্ষেত্রে অধিক দেখা যায়।

৩. লিভারের কোষের রোগ হলে সে স্বাভাবিক অবস্থায় যেভাবে বিলিরুবিন নিঃসরণ ঘটায়, সেটা করতে ব্যর্থ হয়, ফলে রক্তে বিলিরুবিন জমে ওঠে; ফলশ্রুতিতে আমরা জন্ডিস দেখতে পাই। এক্ষেত্রে লিভারের রোগটিই মূল উপসর্গ মাত্র।

৪. সুস্থ লিভার যে বিলিরুবিন নিঃসরণ ঘটায় তা পিত্তনালী বেয়ে ডুয়োডেনামে চলে আসে এবং পায়খানার সাথে পরিবর্তিত অবস্থায় বেরিয়ে যায়। কিন্তু পিত্তনালী যদি কোন কারণে বন্ধ হয়ে যায় যেমন– পাথর, টিউমার হলে বিলিরুবিন নিঃসৃত হতে পারবে না ফলে জন্ডিস দেখা দিবে। এ জন্ডিসকে অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস বলে। আমরা সচরাচর যে জন্ডিস দেখি তার বিশাল অংশের কারণ ভাইরাস জনিত লিভারের কোষের রোগ। অন্যান্য কারণে জন্ডিস অপেক্ষাকৃত অনেক কম।

জন্ডিসের লক্ষণ :

জন্ডিসে প্রায়ই উদরাময় এবং অজীর্ণ রোগের লক্ষণাদি উপস্থিত হয়। প্রথমেই চোখের শ্বেতবর্ণ ভাগ হলদেভাব দেখা যায়, ক্রমে নখের গোড়া ও গলার চামড়া এবং পরিশেষে হাত–পা ও সমস্ত শরীর হলুদবর্ণ হয়ে থাকে। চামড়ার বর্ণ পীড়ার গুরুত্বানুসারে হলুদে–সবুজ বা কালবর্ণ হয়। যেখানে চর্ম পাতলা সেখানে বর্ণ গাঢ় দেখায়। জিহ্বা, ঠোঁট ও দাঁতের মাড়ি গাঢ়বর্ণ বিশিষ্ট হয়। প্রস্রাব সামান্য বা গাঢ় হলুদবর্ণ হয়। কাপড়ে হলুদ দাগ লাগে। বাহ্যে সাদা, পায়খানা দুর্গন্ধযুক্ত ও শক্ত হয়ে থাকে। আলস্যভাব, খিটখিটে স্বভাব, পাকস্থলীতে ব্যথা থাকে। তৈলাক্ত খাবারে অরুচি, মুখে তিক্ত স্বাদ, তিক্তবমি, চর্ম চুলকাম, শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা, অবসাদ, নাড়ী মৃদু ও ধীর, মস্তিস্কের ক্রিয়ার ব্যাঘাত। প্রলাপ, ঘুম ঘুমভাব, আক্ষেপ, অচৈতন্য হয়। সামান্যরূপে জ্বরের লক্ষণ ও দেখা যায়।

জীবাণু মাধ্যম :

জন্ডিস আক্রান্ত ব্যক্তির মলদ্বারা দূষিত পানীয় ও কলুষিত হওয়া, অপরিস্কার হতে বিশেষত শৌচকর্মের পর যথাযথভাবে সাধান বা অন্য কোনো ক্ষারবস্তু দ্বারা হাত ভালোভাবে না ধুয়ে খাদ্য; পানীয় বা বাসন কোসন ধরা, মাছি, দূষিত ইনজেকশনের সূঁচ দ্বারা ইনজেকশন গ্রহণ বা রক্তদান করা। এছাড়া কীট পতঙ্গের কামড়ের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। তরুণ ও শিশুদের এ রোগ হবার প্রবণতা বেশি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্য বিধি না জানা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাব, মাছি নিয়ন্ত্রণে অনীহা, খাদ্যদ্রব্য খোলা অবস্থায় রাখা এবং জীবাণুমুক্ত না করে একই ইনজেকশনের সূচ অধিকার ব্যবহার করা, পানি জীবাণুমুক্ত না করে পান করা প্রভৃতি।

প্রতিরোধ :

খাদ্য ও পানীয় যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও জীবাণু সংক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখা। সামাজিক তথা সমষ্টিগতভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালনে চেতনা ও উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া মাছি ও কীট পতঙ্গের আধিক্য ও উপদ্রব কমানোর আধিক্য ও উপদ্রব কমানোর ব্যবস্থা করার জন্য পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। রোগীকে পৃথক রাখতে হবে। তাঁর মল যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ ও ব্যাপক ব্যবহারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। ইনজেকশন নেবার ও রক্ত দেবার জন্য ‘ডিসপোজেবল’ সিরিঞ্জ ও সূঁচ ব্যবহারের ব্যবস্থা নিতে হবে।

রোগ নির্ণয় :

প্যাথলজী ল্যাবরেটরীতে রক্তের সিরাম বিলিরুবিন পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যায়। এছাড়া রক্তের এসজিওটি, এসজিপিটি এবং এলডিএইচ পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে এসবের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আনুসাঙ্গিক পরিচর্যা ও পথ্য:

শয্যায় পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। শরীর মোটামুটি ভালো বোধ করলে সামান্য হাঁটা–চলা করা চলবে। সহজপাচ্য লঘু ও অনুত্তেজক খাবার দিতে হবে। খাবারের পর পরিমিত পরিমাণ চিনির শরবত বা আখের রস, ডাবের পানি বা গ্লুকোজ ‘শরবত’ খাওয়া যেতে পারে। যথেষ্ঠ পরিমাণ ফলমূল ও সবজি খাওয়া যেতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান:

জন্ডিস নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রয়োগ সংকেত অত্যন্ত কার্যকর। যা অন্যপ্যাথিতে নেই। লক্ষণ সাদৃশ্যে এই রোগে যে ওষুধ বেশি ব্যবহৃত হয় তা নিম্নে প্রদত্ত হল : ১. চেলিডোনিয়াম, ২. হাইড্রাসটিস, ৩. চিয়নোথাস, ৪. কার্ডুয়াস মেরিনাস, ৫. নেট্রাম সালফ, ৬. মার্কসল, ৭. পডোফাইলাম, ৮. ল্যাপটান্ড্রা, ৯. নাক্সভমিকা উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে ওষুধ সেবন করা উচিত। (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ERROR while connect: mysql_error