![শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগেও অসহায়ত্ব আছে কি?](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/12/20/nadim_116190.jpg)
শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগেও অসহায়ত্ব আছে কি?
বেশ কয়েক মাস আগে জাপানের একটি স্কুল পরীক্ষায় এক শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে প্রশ্নপত্র পড়তে সহায়তা করেছিলেন। এ কারণে ওই শিক্ষক, পরীক্ষা কমিটি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেয় জাপান সরকার।
শুধু তাই নয়, ওই শিক্ষার্থীর পরীক্ষাও বাতিল করে দিয়ে তার অভিভাবকদের বলা হয়েছিলো, ‘তাদের সন্তান পরীক্ষার আচরণবিধি ভঙ্গ করেছে। তাই আমরা তাকে স্কুল থেকে আপাতত ছা্ড়পত্র দিচ্ছি।’
ঘটনাটি বছরের শুরুতে ঘটলেও আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে যে অস্বস্থিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার কাছে জাপানের ঘটনা তুচ্ছ। গত কয়েক বছর প্রশ্নফাঁসের যে হরি খেলা চলছে, তার ডামোডালে শিক্ষার শিখা যে নিভে যাচ্ছে, তাতে আমাদের চেঁচামেচিতে কারও কিছু আসে যায় না।
কয়েক সপ্তাহ আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমরা লিখেছিলাম, ‘ফাঁসের রাজ্যে শিক্ষা গদ্যময়’। লেখাটি প্রকাশের পর অনেক পাঠক আমাকে ইমেইল করেছেন। হতাশা ও আক্ষেপের সুর প্রায় সব ইমেইল জুড়েই। এর মধ্যে রয়েছেন বেশকিছু শিক্ষক। যারা বলছে, ক্লাসে পড়াতে তারা আর উৎসাহ পান না। ছেলেরা আগেই বলে দেয়, পরীক্ষার আগের রাতে তো প্রশ্ন আসবে, এতো ক্লাস করে কি করবো?
এসব মেইল দেখে আমি কী উত্তর দেব, তা ভেবে পাইনি। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দেশের শিক্ষকরা যে অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে পাঠদান করছে, তা আমাদের জন্য কখনও সুখকর নয়। তবে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কণ্ঠে যে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, তা সত্যিই মজার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আমাদের কাছে বহু পরামর্শ আসছে। এর মধ্যে পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীরা হলে প্রবেশ করার পর প্রশ্নপত্র পাঠানোর বিষয়টিও আলোচনা হচ্ছে। তবে শিক্ষকই যখন প্রশ্ন ফাঁসকারী, তখন আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্ন পাঠিয়ে কী লাভ?”
আহা! শিক্ষামন্ত্রী! সব দোষ নন্দ ঘোষকে দিয়ে কতোকাল পার হবেন? আপনি সেই শুরু থেকে শিক্ষকদের উপর দায় চাপিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, তা কতোটা নিখাঁদ অভিযোগ?
আপনি যে শিক্ষকদের উপর প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় চাপাচ্ছেন, আপনি কি বলবেন, বাংলাদেশের কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতোজন শিক্ষককে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পেরেছেন? কতোজন শিক্ষকের চাকরি গেছে? কতোজন শিক্ষককে কারাগারে যেতে হয়েছে?
আপনি যদি এখন বলেন, প্রশ্নফাঁসের সাথে বাচ্চাদের অভিভাবকরাও জড়িত। কেনো তারা তাদের বাচ্চাদের সামলাতে পারছেন না? কেনো তারা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পেয়েছে কিনা তা জানতে ছুটছে?
শিক্ষকদের মতো আপনার এই অভিভাবকদের প্রতি অভিযোগও জায়েজ হয়ে যাবে। কারণ, যেহেতু শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র পরীক্ষার সময় নিয়ন্ত্রণ করে, তাই তারা জড়িত! আবার যেহেতু অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের নৈতিক শিক্ষা দেয় না, যে কারণে তাদের সন্তানরা ফাঁস প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়, সুতারাং তারাও প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত?
আচ্ছা, একটা সত্য কথা বলবেন কি, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কোথায় ছাপা হয়? শিক্ষকদের বাড়িতে না শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বাড়িতে? প্রশ্নপত্র কারা সরবরাহ করে, পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যায়? কারা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে?
এখন যদি বলেন, আপনার জড়িত থাকার প্রমাণ নেই, তাহলে আমি বলবো, আপনি ঠিকই বলেছেন। শিক্ষকরা প্রশ্ন প্রণয়ন ও ফাঁস করেছেন, আর আপনি শিক্ষামন্ত্রী তা চেয়ে চেয়ে দেখছেন।
আমি বলছি না, শিক্ষকরা ধোয়া তুলশি পাতা। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে পরীক্ষা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আপনার। গণমাধ্যমগুলো কতোটা আপনাকে নির্লজ্জতার প্রমাণ দিলে আপনি বলবেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়িত্বটি আপনার?
এই যে কয়েকদিন আগে বেসরকারি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’-ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার যে মহা উৎসব সারা দেশের মানুষের কাছে উন্মুক্ত করেছে, তা দেখেও তো আপনার আত্মপলব্ধি হওয়া উচিত ছিল। আপনার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও দাবি করে আসছিল, কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। জোর গলাবাজি করে এই বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করলেও থলের বেড়াল বের হওয়ার পর মনে হয়েছে, যারা অপরাধী তারা একটু গলাবাজি বেশিই করেন।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতরা সবাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের। কতোটা ভয়ানক ব্যাপার, যেসব শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসে, তারা হয়তো ২০১৪-১৫ কিংবা ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। যা ওই সময়গুলোতে আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষা ভবনের গড়া ফাঁস প্রশ্নপত্রে অভিযোগ মাথায় নিয়ে তারা পাশ করেছে। ধারণা করছি, তারা এইচএসসি, এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারাবাহিকতা বিশ্ববিদ্যালয়েও অক্ষুন্ন রেখেছে।
অভিনন্দন তাদেরকে দিতে হয়। এরা যখন দেশের সবোচ্চ শিক্ষালয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেছে, তখন ধরে নিতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দিয়ে এরা দেশের মহামূল্যবান সম্পদ হয়ে যাবে। যাতে করে আপনাদের গদিগুলো আরও বেশি আরামদায়ক হবে।
আমরা সত্যিই আপনার নোংরা চাপাচাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে শিক্ষার চৌদ্দটা বাজানোর জন্য নেহাত আপনার শিশুসুলভ মন্তব্যই যথেষ্ট।
সমস্যা যখন হয়েছে, তার সমাধানও রয়েছে। সমাধান খুঁজতে আপনাকে আপনার মন্ত্রণালয়ের সহকর্মীদের বিভূঁইয়ে পাঠাতে হবে না। দেশের অনেক শিক্ষাবিদ ও প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন। তাদের সহায়তা যে পাবেন না, তা তো নয়।
মাত্র দুইটা আইন করে দিন, দেখবেন দেশে আর কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে না। প্রথমত, যেসব কর্মচারী-শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে, তাদেরকে যাবজ্জীবন শাস্তি দিন কিংবা যেসব শিক্ষার্থী এই ঘটনায় থাকবে তাকেও তাদের অভিভাবকদের দশ-পনেরো বছর জেলে থাকার আইন পাশ করান। দেখবেন, আপনি যদি প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে তাদের বাসায় দিয়েও আসেন, এরপরও তারা আর তা দেখবে না। যদিও বিষয়টি দৃষ্টিকটু কিংবা অবাস্তব। তারপরও আপনার মতো মন্ত্রীর জন্য অসহায়ত্ব শব্দ চয়ন করতে হবে না।
আপনার অসহায়ত্বের কথা আমরা জানতে চাই না। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে অপরাধীদের আরও বেশি শক্তিশালী করার প্রয়োজন পড়ে না। আপনার এই অসহায়ত্বের খবর শুনে আমাদের বড় Leena Pervin আপা ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘‘পদত্যাগে আর অসহায়ত্ব নাই’।
আপনার পদত্যাগে হয়তো সত্যিই কোনো অসহায়ত্ব নেই কিংবা থাকবে না। কিন্তু আপনার পদত্যাগেই তো সমাধান নয়। সমাধান করতে হলে আপনার অসহায়ত্ব মুছতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসে আপনি যদি কঠোর না হোন, আপনার পদত্যাগই শ্রেয়।
নাদিম মাহমুদ’র স্ট্যাটাস থেকে