![...চাপিয়ে দেয়া সত্যকে আমরা মগজের আশপাশেও ঠাঁই দেবো না](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/01/25/hasan-shantanu_122486.jpg)
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সেতু আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল- দুজনেই সৎ। মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ব্যর্থতা থাকতে পারে, তাঁদের সততা প্রমাণিত।
আইনের শাসন কোনো রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত কী না, তা বিচারের অন্যতম মাপকাঠি সেখানকার সংখ্যালঘুদের জীবন। কয়েক দশক ধরে এদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলোর কয়টার বিচার হয়েছে? কেন হয়নি?
ওই দুজন মন্ত্রী থাকাকালে ‘অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির’ ভিত্তিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। এতে বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে। যাঁর সংসদীয় এলাকায় এ বর্বর তাণ্ডব, তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে ছিলেন সততায় অনন্য দৃষ্টান্ত। সদ্য প্রয়াত এ মন্ত্রী বেঁচে থাকাকালে হামলায় দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে জোরালো কোনো ভূমিকা রেখেছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। কেন পারেননি? তাহলে কি নিরেট সততায়ও সবকিছু সম্ভব নয়? বাধাটা কোথায়?
‘Is therer anybody there? said the Traveller/Knocking on the moonlit door.’ ওয়াল্টার ডি লা মেয়ারের ‘দ্য লিসনারস’ কবিতাটি বহুলপঠিত। মানুষ নেই, এমন একটা প্রাসাদের সামনে একজনের আকুল আহ্বান। তার সামনে জমাটবদ্ধ নিরুত্তর নির্জনতা নিয়ে লিখেছিলেন মেয়ার। আলবেয়ার কাম্যুর উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’র মূল চরিত্র ম্যেরসোলের বক্তব্য অনেকটা এরকম- ‘Tell them I came, and no one answer'd/That I kept my word, he said.’ নিস্তব্ধ পৃথিবী, রাষ্ট্র, সমাজে ‘আমি মানব একাকী ভ্রমি’, তা কাম্যু বলেছেন, মেয়ারও লিখেছেন।
তফাত হয়তো এই, মেয়ার উত্তর আশা করেছেন, কাম্যু করেননি। পৃথিবীর পুরোটাই অর্থহীন, মানুষের জীবনও তা-ই, যুক্তিহীন এক অস্তিত্বে আমরা বন্দি হয়ে আছি, বিষয়টি কাম্যুর লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে। কাম্যুর জন্মের একশো বছর পরও কি তাঁর কথারই জয়? আমরা বন্দি যুক্তিহীন অস্তিত্বে?
আমাদের রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়ারের মতো উত্তর আশা করি। আমাদের সামনে অসংখ্য প্রশ্ন, দু’চারটা উল্লেখ করছি মাত্র। আধুনিকতার সবচেয়ে ‘ফ্রেশ’ শিক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে জঙ্গি, ধর্মান্ধ হচ্ছে কেন তরুণ প্রজন্ম? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার লোকরা কথিত ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ীকে বিনা বিচারে একটা সভ্য সমাজে একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চালিয়ে হত্যা করছে কেন?
প্রশ্নগুলোর যুক্তিসঙ্গত উত্তর আমরা পাচ্ছি না। যা মিলবে তা হয়- দলবাজিতে বন্দি দলদাসদের চিৎকার; না হয় স্বঘোষিত ‘বুদ্ধিজীবীর’ বিষয়বস্তুটা ভাসা ভাসা জেনে অগভীর বিশ্লেষণ! এ ধরনের ‘বুদ্ধিজীবীর জ্ঞানের’ দৌড়টা কতোটুকু পর্যন্ত, তা আঁচ করতে বিলেতি ডক্টরেট লাগে না।
বুদ্ধিজীবীদের যে অংশের কাছ থেকে আমরা উত্তর পাবো, তাঁরা চুপ আছেন, অথবা আমরা থামিয়ে রেখেছি তাঁদেরকে! যাঁরা বলছেন, তাঁদের সব বক্তব্য গুরুত্ব পাচ্ছে না রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে। যাঁরা যেচে, বা কোনো কোনো গোষ্ঠীর হয়ে জাতীয় প্রশ্নের ‘উত্তর’ দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার ‘জনপ্রিয়তার জোয়ারের জলে’ ভাসছেন! জোয়ারের পানি নেমে গেলে দেখা যাবে কে কে ন্যাংটা হয়ে সাতরাচ্ছিলেন! এজন্যই কি কাম্যু উত্তর আশা করেননি? তাঁর দর্শনের চোখ কি অনেক আগেই আজকের বাংলাদেশকে পাঠ করেছিলো?
১৯৬০ সালে প্যারিসের বাইরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় কাম্যু মারা যান। তখন তাঁর পকেটে ছিল অব্যবহৃত ট্রেনের টিকিট। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের সঙ্গে ট্রেনে কোথাও বেড়ানোর কথা ছিলো। শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে এক প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে যাচ্ছিলেন। যে মানবজীবনের লক্ষ্য, স্বরুপ নিয়ে তাঁর এতো ভাবনা ছিলো, সেই জীবনই জিতে গেলো তাঁর সঙ্গে লুকোচুরি খেলায়!
জগৎনন্দিত লেখক কাম্যুর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ না হয় ‘অ্যাবসার্ড’ দর্শনের উদাহরণ, যেখানে বিশ্বজগৎ একেবারে অর্থহীন। তাঁর লেখা ‘দ্য ফল’ তো অস্তিত্ববাদের কথা বলছে। এখানে চরম অর্থহীনতার মধ্যেও রক্তমাংসের মানুষের একটা অর্থপূর্ণ ভূমিকা আছে। যেমন, আমাদের রাষ্ট্রের শোষিত, নির্যাতিত, গরিব, ছা-পোষা মানুষেরা। রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা অর্থহীন। সংবিধানে লেখা আছে, তাঁরা রাষ্ট্রের মালিক! অথচ তাঁদের মধ্যে অনেকে সরকারি হাসপাতালে একটা শয্যা, চিকিৎসা না পেয়ে মরার আগে জেনে যাওয়ার জন্য প্রশ্ন করেন- ‘আমার মালিকানায় কি একটা শয্যা, দুইটা প্যারাসিটামলও নেই?’ উত্তর পান না।
টি এস এলিটীয় নিয়মে আমরা জানি, সৌন্দর্য খুঁজে নিতে হবে সিগারেটের টুকরোয়। আরো জানি, দুনিয়া একদিন শেষ হবে আপনাকে, আমাকে নিয়েই, ‘নট ইউথ আ ব্যাং বাট আ হুইম্পার’। কাম্যুর জীবনের দিকে তাকালে দেখি, দামি একটি গাড়ি ভুল জায়গায় ধাক্কা খেলে শেষ হয়ে যায় যে জীবন, তা যে যুক্তিহীন বিশ্বকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলো... এটুকুই টিকে থাকে।
ওই হিসাবে আজকের ‘পোস্ট মর্ডানিস্ট’ সময়ে আমরা বিশ্বাস করি, সত্য এক ‘সোস্যাল কনস্ট্রাক্ট’, আমার মন আমার চারপাশকে কীভাবে দেখছে, এর চেতনা ও বর্ণনার মিলনই আমার সত্য। কোনো গোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া সত্যকে আমরা মগজের আশপাশেও ঠাঁই দেবো না।
হাসান শান্তনু’র স্ট্যাটাস থেকে