![যাঁর প্রতিমা ভেঙেছিলো ধর্মদানবরা...](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/14/hasan-shantonu_135112.jpg)
যাঁর প্রতিমা ভেঙেছিলো ধর্মদানবরা, ছনে ছাওয়া ঘরটায় আগুন দিলো, দাউ দাউ করে জ্বলে ছাই হলো সব সঞ্চয়। ভিটেমাটিও দখল করে নিলো। সেই বুড়ি মা'র কথা মনে পড়ছে, আরেকটা বছরের বিদায় বেলায়।
অবশ্য 'কাল আমি মা'র সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছি, অদ্ভুত বৃদ্ধা,
একদা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন, সম্ভবত এখন বিশ্বাস হতে চায় না, আমাকে দেখলেন
আমার গরম লাগছিল
বুড়ি হেসে তসবিহ টিপতে লাগলেন,
তোর যেখানে জন্ম হয়েছিল, মনে আছে?
নিম গাছের নিচে ছনের চালায়,
আমি কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললাম,
না মা, কিছু মনে নেই' (কিছু মনে নেই)
বুড়ির বাড়ি জামালপুর সদরের কোনো একটা গ্রামে। নাম শ্যামলী দাশ। ২০০২ সালে ইসলামি সন্ত্রাসীরা তাঁকে ভারতে পাঠিয়ে দিতে চাইলো। নির্যাতন সহ্য করেও দেশ ছাড়েননি। তাঁর কথা, 'দেশটা ত আমরার'।
জীবনকে টিকিয়ে রাখতে বিধবা এ নারী জন্মজেলা ছেড়ে চলে আসেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। সেখানে তিনি এ পাড়া থেকে ও পাড়া ঘুরে পান, পাতার বিড়ি বিক্রি করে বেঁচে ছিলেন।
দুই ছেলে, তাদের বউ, বাচ্চাদের নিয়ে বুড়ি প্রথমে থাকতেন দূর্গাপুরের ছোট্ট একটা ভাড়া ঘরে। হঠাৎ একদিন একদল মৌলভি জানালো, হিন্দুদের নামের গ্রামে থাকলে মুসলমানদের নাকি 'কাফের' হয়ে মরতে হবে! রাতারাতি পাল্টে গ্রামটির নাম হলো-'ইসলামপুর'।
এ গ্রামে হিন্দুরা থাকা 'নাজায়েজ', মৌলভিরা এ ফতোয়া দিলে বাধা দেবে কে? বুড়িরা এ গ্রাম ছেড়ে ঘর ভাড়া নেন টুকেরবাজারে। আমি তখন সাংবাদিকতা ছেড়ে কোম্পানীগঞ্জের একটা বিদ্যালয়ে পড়াতাম, যাকে বলে শিক্ষকতা। সেখান থেকেও মোল্লারা শ্যামলী দাশের বাড়ি দখলের বিষয়ে যুগান্তর, জনকণ্ঠে মতামত লিখেছিলাম।
কাঁচা সুপারি দিয়ে পান চিবানোতে অভ্যস্থ। এক পর্যায়ে বুড়ির সঙ্গে পরিচয়। আমার মায়ের মুখটার সঙ্গে তাঁর মুখের কী অদ্ভুত মিল! আমাকেও তিনি ছেলের মতো মনে করতেন। পান বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে তিনি গানও গাইতেন।
এক সন্ধ্যার পর বুড়ি 'আমার গায়ে যতো দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়' গেয়ে খুব কাঁদেন। আমার মাকেও বোধহয় একদিন কোনো কারণে ঠিক এভাবে কাঁদতে দেখেছি।
মা কেন কেঁদেছিলেন, ওই বুড়িই বা কেন কাঁদছিলেন, জানি না। মানুষের জীবনে এমন কিছু কান্না হয়তো থাকে, এর কারণ আপনজনরাও জানে না। বুড়ি প্রায়ই একটা গান গাইতেন, 'আমার অতি সাধের পোষা পাখি হারিয়ে গেল, নগরবাসী গো, তোমাদের ঘরে নি আইল ...'।
জামালপুর জেলা শহরের দুটি মন্দিরের জমি অধিগ্রহণ করে প্রশাসন 'সাংস্কৃতিক পল্লি' নির্মাণ করছে! দয়াময়ী, রাধামোহন জিউ মন্দির, এগুলো তিনশত বছর আগে নির্মিত। সেখানকার সনাতন ধর্মের অনুসারীরা মন্দিরের জমি রক্ষার দাবি জানাচ্ছেন।
গতকাল শুক্রবার এ বিষয়ে প্রতিবেদন পড়ার পর থেকে ভাবছি, সেই বুড়ি মা'রও কি একই দাবি নয়? তিনি এখন কোথায় থাকেন? জামালপুরে ফিরেছেন? নাকি কোম্পানীগঞ্জেই থাকেন? বেঁচে আছেন তো? তা থাকবেন। দুখিনি, দুর্ভাগারা নাকি বেশিদিন বাঁচেন!
আজ থেকে নতুন বাংলা সন। বুড়ি মা, তোমাকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি না। এসব শুভ কামনায় কি তুমি, তোমরা, আমরা ভালো থাকতে পারি? আমাদেরকে তো প্রকৃত ভালো রাখতে পারে আসলে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ কি রাখছে? নতুন বছর থেকে কি সব বিশ্বাস, পথ, মতের সবাইকে ভালো রাখবে?
হাসান শান্তনু’র স্ট্যাটাস থেকে