ঢাকা, ২২ এপ্রিল, এবিনিউজ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এ কে এম নাসির উদ্দিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
রোগীদের আস্থার জায়গা হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সব বিশেষায়িত হাসপাতালই ঢাকা শহরে। এর অধিকাংশেই দুপুরের পর চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় না। বেশির ভাগ হাসপাতাল থেকেই নির্দিষ্ট সময়ের পর রোগীদের ফেরত আসতে হয়। ফিরে আসা এ রোগীদেরই আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। পাশাপাশি মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত সারা দেশের রোগীদের চাপ তো আছেই। আমাদের দায়বদ্ধতা হলো ঐতিহ্যগতভাবে কোনো কিছুকে কোনোদিন না বলি না। এটি কঠিন হলেও গৌরবের। পৃথিবীতে এমন হাসপাতাল কম আছে, যেখানে যেকোনো ধরনের রোগীকে যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়। শয্যা থাকুক বা না থাকুক রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে ও তাদের জন্য কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা হচ্ছে।
রোগীর চাপ সামলে মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেয়াটা সহজ নয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সেটা কতটা পারছে?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর মানুষের অগাধ আস্থা, আবার অনেক মানুষের কোনো উপায়ও থাকে না। সারা দেশের মানুষ এখানে আসে। শয্যা না থাকলেও বারান্দায়, মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। আমাদের এখানে গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে আর সেবা নিয়ে চলে যাচ্ছে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জন। গড়ে মৃত্যুর হার ৮ শতাংশের মতো। এখান থেকে নিশ্চিতভাবে ৯২ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এ মানুষগুলো বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে এখানে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যার একটা বিশাল অংশ টার্মিনাল কেস। যারা অন্য কোথাও সুযোগ না পেয়ে এখানে আসছেন। এখানে ৩ হাজার ৮০০ রোগী আর প্রত্যেক রোগীর বিপরীতে গড়ে ৩ জন অ্যাটেনডেন্ট থাকেন। আমরা হিসাব করে দেখেছি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করেন। এ চাপ সামলে বিপুল সংখ্যক রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছি। খুব জটিল কেস ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক, ইঞ্জেকশনসহ বেশির ভাগ সেবা রোগীকে বিনামূল্যে দেয়া হয়। এছাড়া হতদরিদ্রদের বিভিন্নভাবে পুরো চিকিৎসা বিনামূল্যে দেয়া হয়। সমাজকল্যাণ ফান্ডের অনুদানে ১ কোটি টাকার মতো বিভিন্ন ধরনের সাপোর্ট আমরা বিনামূল্যে দেই।
সরকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অত্যাধুনিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুসারে আমরা অত্যাধুনিক না হলেও অন্তত আধুনিক পরিবেশে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা দেয়ার জন্য কাজ করছি। আমাদের যে জায়গা আছে, এর মধ্যে আমাদের আর্কিট্যাক্টরা মডেল তৈরি করেছেন। আমরা হাসপাতাল পাঁচ হাজার শয্যার করার প্রস্তাবনা দিয়েছি। এখানে পাঁচ থেকে ছয়টি কমপ্লেক্স করা হবে। একেকটি কমপ্লেক্স হবে ১৬ তলার। একেকটা ভবন প্রায় এক হাজার রোগী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। এ ছয়টা ভবন হবে মূল হাসপাতাল কমপ্লেক্স, এর সঙ্গে মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ থাকবে। কিছু ইমার্জেন্সি চিকিৎসক ও নার্সের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। এটি এমনভাবে করা হবে, যাতে হাসপাতালের কার্যক্রম ও উন্নয়ন একসঙ্গে চলে।
প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য বিপুলসংখ্যক রোগী বিদেশে চলে যান। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছা ও আর্থিক সামর্থ্যের ওপর। কারো যদি আর্থিক সামর্থ্য থাকে, তাহলে দেখা যায় একই রোগের জন্য তিন-চারজন চিকিৎসক দেখান, কয়েকটি জায়গা থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। যার সামর্থ্য নেই তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা বলবেন, সেটিই উত্তর। মানুষ মুমূর্ষু হয়ে বিদেশে যাচ্ছেন এমন সংখ্যা খুব কম। চিকিৎসার জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের বিষয়টি ভিন্ন বলে আমি মনে করি।
ঢাকা মেডিকেলের ওপর থেকে রোগীর চাপ কমাতে করণীয় কী?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশ করে রোগী বাড়ছে। এখন যদি সে সংখ্যা ৩ হাজার ৮০০ হয়, পাঁচ বছর পর সেটি পাঁচ হাজারে চলে যাবে। আমাদের নতুন ভবন হতে ছয় বছর লাগবে। ছয় বছর পর এটিও ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এটা কিন্তু একটা সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে ঢাকায় আমাদের আরো হাসপাতাল প্রয়োজন। কেননা ঢাকা আমাদের কেন্দ্রস্থল। এখানে মানুষ আসবেই। ঢাকার মতো একটা শহর তৈরি করতে আমাদের অনেক বছর লাগবে। এত বছর আমরা কী করব? এ বোঝা সামাল দিতে আমাদের হাসপাতাল বাড়াতে হবে। সেজন্য আমরা পূর্বাচল ও কেরানীগঞ্জে হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবনা দিয়েছি। রেলওয়েতে আমাদের বিশাল একটা হাসপাতাল করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া কুর্মিটোলার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কার্যক্রম বাড়ানোর কাজ চলছে।
২০১৭ সালের সেরা হাসপাতাল র্যাংকিংয়ে আপনারা আগেরবারের তুলনায় পিছিয়েছেন। কেন?
প্রথমবার র্যাংকিংয়ের ধরন অন্যরকম ছিল। এখন আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ছয়টা এরিয়া ও সাব-এরিয়া দেখে র্যাংকিং করা হয়। কিন্তু এটি যে সুষমভাবে করা হচ্ছে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আপনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালকে কোন দিক দিয়ে তুলনা করবেন? ওরা অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুধু এটিই? রোগী কম হলে, ভবন নতুন হলে পরিচ্ছন্ন রাখাই যায়। আমার এ ভবন ১০০ বছরের পুরনো, ধারণ ক্ষমতার আড়াই গুণ বেশি মানুষ এখানে আসে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি নেতৃত্বস্থানীয় হাসপাতাল। অস্ত্রোপচার, জটিল ও আনকমন রোগ সামলানোর দিক থেকে আমাদের ধারেকাছেও কেউ নেই। এ হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করতে হলে ওই বিষয়গুলো আনতে হবে অথবা দুই হাজার শয্যার ঊর্ধ্বে যেসব হাসপাতাল আছে, তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করুক। এবারের র্যাংকিংয়ে রোগী ব্যবস্থাপনা অটোমেশনের মাধ্যমে এমআইএসের কাছে পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা পেরে উঠিনি। কারণ এ খাতে একজন লোকও আমাদের নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পরিসংখ্যানবিদ নেই। এ র্যাংকিংয়ের জন্য এখন যে ফরম্যাট আছে, সে অনুযায়ী নিয়মিত তথ্য দিতে হলে আমাদের একটি পৃথক সেকশন দরকার। এ জায়গাটা খুবই দুর্বল হওয়ায় আমরা পিছিয়ে পড়েছি।
কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে?
উন্নত সেবা ও মানুষের সন্তুষ্টির মতো আপেক্ষিক বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। এগুলো নিশ্চিত করা আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য পর্যাপ্ত জায়গা ও জনবল প্রয়োজন। আমাদের ২ হাজার ৬০০ শয্যার হাসপাতালের অনুকূলে যে জনবল প্রয়োজন, সেখানে ৫০০ জনের ঘাটতি আছে। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমরা চাইলেই দ্রুততম সময়ে কোনো যন্ত্র মেরামত করতে পারি না। এখানে ইলেকট্রো মেডিকেল সেক্টর নেই। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে একটি যন্ত্র নষ্ট হলে তা মেরামতে আমাদের সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। তার পরও সে যন্ত্র আদৌ ঠিক হবে কিনা আমরা জানি না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাজার হাজার ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট আছে কিন্তু সেগুলো দেখভালের জন্য টেকনিশিয়ান মাত্র একজন। যাকে আমরা ১৮ বছর ধরে সংযুক্ত করে ময়মনসিংহ থেকে এনে কাজ চালাচ্ছি। এ রকম একটা বিপত্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিটি মুহূর্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এখন অস্ত্রোপচার চলাকালে যদি লাইট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে টর্চ দিয়ে অপারেশন করতে হবে। কারণ লাইট ঠিক করার মতো কেউ নেই। আমরা মনে করি এখানে জরুরিভিত্তিতে ইলেকট্রো মেডিকেল সেক্টর চালু করা প্রয়োজন। আমরা মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে যুদ্ধ করি সারাক্ষণ। আমাদের যদি সে অনুযায়ী অস্ত্র না থাকে এবং এ অস্ত্র জরুরিভিত্তিতে মেরামতের সুযোগ না থাকে, তাহলে প্রতি মুহূর্ত অনিরাপদভাবে রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। (বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)
এবিএন/সাদিক/জসিম