বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • মুক্ত মতামত
  • ইস্তাম্বুল ভ্রমণ স্মরণীয়, কিন্তু তোপকাপি প্রাসাদের হারেম লজ্জাজনক

ইস্তাম্বুল ভ্রমণ স্মরণীয়, কিন্তু তোপকাপি প্রাসাদের হারেম লজ্জাজনক

ইস্তাম্বুল ভ্রমণ স্মরণীয়, কিন্তু তোপকাপি প্রাসাদের হারেম লজ্জাজনক

ড. মইনুল ইসলাম, ২৯ এপ্রিল, এবিনিউজ : গত ১৬ এপ্রিল বিকেলে বিমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ১৭ এপ্রিল ভোররাত ১:২০ মিনিটে কুয়াইত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে আমি এবং আমার স্ত্রী লাভলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম। আমাদের এবারের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের উদ্দেশ্য আমাদের একমাত্র কন্যা সিফাত শারমীন মইন ঈশিতা এবং আমাদের জামাতা ইয়াসির তাসিফ খানের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের ‘কমেন্সমেন্ট সেরিমনি’তে অংশগ্রহণ। তারা দুজনাই এবার বিশ্বখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলী থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং–এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করতে যাচ্ছে। এই পরম আনন্দময় সময়ে তাদের সাথে থাকার জন্যেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে হাজির হয়েছি ২১ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে। আসার পথে আমরা ইস্তাম্বুলে চার দিনের একটা যাত্রাবিরতি নিয়েছি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন নগরীর অন্যতম হিসেবে খ্যাত এই নগরী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কুয়াইত এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি কুয়াইত এয়ারপোর্টে পৌঁছাল ভোর চারটায়। এয়ারপোর্টে ছয় ঘন্টা যাত্রাবিরতির পর সকাল সাড়ে দশটায় কুয়াইত থেকে আরেকটি প্লেনে ইস্তাম্বুল রওনা দেওয়ার পর ১৭ এপ্রিল বিকেল পৌনে পাঁচটায় ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছুলাম আমরা। দু’মাস আগেই অন–লাইন টার্কিশ ভিসা নিয়ে নেয়ায় ইমিগ্রেশনে তেমন কোন ঝামেলা হলো না, বিকেল পাঁচটায় আমরা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে টেক্সি নিয়ে আগে থেকে বুকিং দেওয়া হোটেলের পানে রওনা দিলাম। মারমারা সাগরের পাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া প্রশস্ত মহাসড়ক দিয়ে ছুটে চলা টেক্সিতে প্রায় পঁচিশ মিনিট লাগলো হোটেলে পৌঁছাতে। সুলতান আহমেত নামের এই জায়গায় এবং এর আশেপাশে ইস্তাম্বুলের প্রায় সব দর্শনীয় পর্যটন স্পটগুলো অবস্থিত হওয়ায় সাধারণতঃ পর্যটকদের বেশির ভাগই এই এলাকার হোটেলগুলোতেই অবস্থান করে থাকে। আমরা অন–লাইনে প্রায় দু’মাস আগেই হোটেল বুক করায় এ–ব্যাপারে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি।

আমাদের এক আত্মীয়া তুরস্কের আংকারায় উচ্চতর ডিগ্রির জন্যে পড়াশোনা করছে। তার মাধ্যমে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনায় রত ওমর ফারুক হিলালী নামের এক ছাত্রের সাথে ঢাকা থেকেই যোগাযোগ হয়েছিল। সন্ধ্যার আগেই ফারুক হোটেলে এসে হাজির। ইস্তাম্বুলে এখন সন্ধ্যা হয় আটটায়, অতএব তখনো সন্ধ্যা হতে যেহেতু দু’ঘন্টারও বেশি বাকি তাই সে প্রস্তাব দিল পায়ে হেঁটে ‘ব্লু–মস্ক’ বা সুলতান আহমেত মসজিদ এলাকাটি ঘুরে আসা যাবে। আমরাও সোৎসাহে রওনা দিলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পরই পৌঁছে গেলাম ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে। সংস্কারের জন্যে মসজিদের প্রধান অংশ বন্ধ থাকায় শুধু বহিরাঙ্গনটা দেখার সুযোগ পেলাম আমরা। ‘ব্লু–মস্ক’ এর এই সামান্য অংশ দেখার পর রওনা দিলাম হাজিয়া সোফিয়া বা আয়া সোফিয়ার দিকে, জায়গাটা চিনে নেয়াই প্রথম দিনের প্রধান উদ্দেশ্য। ফারুক সবিস্তারে বর্ণনা করছিল পরদিন সকালে কোথায় কী করতে হবে, যাতে আমরা কোন বিভ্রান্তিতে না পড়ি। পুরো এলাকা জুড়েই অদ্ভুত সুন্দর বাগানের পর বাগান, টিউলিপে টিউলিপে সয়লাব বছরের এই সময়টায়। হাজিয়া সোফিয়ার ঠিক সামনে প্রায় দু’শ ফুট দৈর্ঘ্য এবং এক’শ ফুট প্রস্থের একটা কার্পেট রচনা করা হয়েছে শুধু বিভিন্ন জাতের টিউলিপের বাগানের মাধ্যমে। শত শত পর্যটক যাতে এই বাগানের ছবি তুলতে পারে তার জন্যে বাগানের দু’দিকেই উঁচু প্লাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। মনের সুখে আমরাও অনেকগুলো ছবি তুললাম এই অতুলনীয় সুন্দর বাগানটির স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে। সেখান থেকে আমাদেরকে নেয়া হলো তোপকাপি প্রাসাদের প্রান্তবর্তী একটা পার্কে, ওখানেও টিউলিপের বাগানের পর বাগান। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমি প্রস্তাব দিলাম, ফারুকের বিবেচনায় ইস্তাম্বুলের সেরা কাবাব যে দোকানে পাওয়া যায় সেখানে আমরা রাতের ডিনার করব। ওখানে দু’ধরনের কাবাব অর্ডার দিলাম আমরা, একটা গরুর গোশতের শিক কাবাব (ওদের ভাষায় শিষ কেবাপ), আরেকটা মুরগীর গোশতের শিক কাবাব (ওদের ভাষায় তাবুক শিষ)। প্রচুর রুটি, সালাদ, মরিচের চাটনী যত ইচ্ছে খাওয়া যায়। সাথে আমাদের দেশের মাঠা বা ঘোলের মত পানীয় আইরান কিনে নিলাম পানির পরিবর্তে। বড়ই তৃপ্তির সাথে খাওয়া সারলাম।

পরদিন ১৮ এপ্রিল সকালে সাড়ে আটটায় রওনা দিলাম তোপকাপি প্রাসাদের টিকেটের লাইন দেওয়ার জন্যে। ভাগ্যক্রমে লাইনটা তখনো খুব বেশি বড় হয়নি সকালে লাইন দেওয়ায়। নয়টার মধ্যেই শুরু করতে পারলাম তোপকাপি প্রাসাদ দর্শন। অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ইস্তাম্বুলের যাত্রা শুরু ১৪৫৩ সালে, ৪৫৯ বছর পর ১৯২২ সালে এই সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন আধুনিক তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল পাশা, যাকে আতাতুর্ক (মানে তুরস্কের পিতা) উপাধিতে ভূষিত করেছিল তাঁর অনন্য নেতৃত্বের অবদানে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কৃতজ্ঞ তুর্কি জাতি। এর আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সম্রাট কায়জারের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ অটোম্যান সম্রাটের সাম্রাজ্যকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল বিশ্বযুদ্ধে জয়ী গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। সারা মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান রাষ্ট্রগুলোকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত অটোম্যান সাম্রাজ্যের ভগ্ন স্তূপের উপর গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত বৃটেন এবং ফ্রান্সের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন–উদ্ভূত খামখেয়ালীর ফসল বলা চলে। অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বৃটেন এবং ফ্রান্সের এই আগ্রাসন শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে বলকান যুদ্ধের মাধ্যমে। ঐ বলকান যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের পূর্ব–ইউরোপীয় অধিকৃত অঞ্চলসমূহকে স্বাধীনতা প্রদানের নামে ইঙ্গ–ফরাসী প্রভাবাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে। সামরিক দিক থেকে দুর্বল অটোম্যান সাম্রাজ্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ঐ সুপরিকল্পিত আগ্রাসন ঠেকাতে পারেনি, যার ফলে আজকের দিনের পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো একে একে অটোম্যান সাম্রাজ্যের হস্তচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিভিন্ন রাষ্ট্র দখল–বেদখলের এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ–যুদ্ধ খেলাকেই ইতিহাসে ‘বলকানাইজেশান ইরা’ আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। মানবেতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আঞ্চলিক যুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে ১৮৭০–১৯১৪ পর্বে, এবং উপনিবেশ নিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর এই সাম্রাজ্যবাদী কাড়াকাড়ির সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক রাজ্য হারাচ্ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। এরই ধারাবাহিকতায় ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশ্বের অন্যতম বড় সাম্রাজ্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত অটোম্যান সাম্রাজ্য উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে একের পর এক পরাজয়ের শিকার হয়ে রাজ্য হারাতে হারাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ১৯১৮–২২ সালে এসে খোদ রাজধানী ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি অঞ্চলে ইঙ্গ–ফরাসী আগ্রাসনের অসহায় লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু, ১৯২২ সালে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী ইঙ্গ–ফরাসী আগ্রাসী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে তুরস্কের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে সমর্থ হওয়ায় ঐ সাম্রাজ্যবাদী খেলা অটোম্যান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত বিলোপে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। এর মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছিল ‘রিপাবলিক অব টার্কি’র– যেখান থেকে শুরু আধুনিক তুরস্কের অগ্রযাত্রার কাহিনী। এই ইতিহাসের একজন ভক্ত পাঠক হিসেবে কামাল আতাতুর্কের স্মৃতি–বিজড়িত ইস্তাম্বুল ভ্রমণের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন লালন করে চলেছিলাম আমি, এবার তোপকাপি প্রাসাদে প্রবেশের মাধ্যমে সে স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারলাম।

১৪৫৩ সাল থেকে প্রথম কয়েক বছর অটোম্যান সম্রাট ইস্তাম্বুলের অন্যত্র বসবাসের পর তোপকাপি প্রাসাদ অটোম্যান সাম্রাজ্যের সম্রাটের বাসভবন এবং হেডকোয়ার্টার হিসেবে নির্মিত হয়েছিল ১৪৬০ সাল থেকে ১৪৭৮ সালে। তোপকাপির এই ভূমিকা অক্ষুন্ন ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত। এই কয়েক’শ বছরে বহুবার সংস্কার এবং পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে সম্প্রসারিত নবরূপ লাভ করেছে তোপকাপি প্রাসাদ। প্রায় সাত লক্ষ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদটির তিনদিকে রয়েছে মারমারা সাগর, বসফরাস প্রণালী এবং গোল্ডেন হর্ণ। স্থলভাগের দিকে প্রাসাদটি বেষ্টন করে আছে প্রায় ১৪০০ মিটার দীর্ঘ সুউচ্চ রাজকীয় প্রাচীর। প্রাসাদটির তিনটি প্রধান ফটক এর বহির্ভবন এবং অন্দরমহলের বিভিন্ন স্থাপনাকে আলাদা করে রেখেছে, এবং প্রতিটি অংশেই অনেকগুলো সুপরিকল্পিত বাগান পুরো প্রাসাদকে এক অনন্য সৌন্দর্যে সাজিয়ে তুলেছে। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে প্রায় চার’শ বছর ধরে ব্যবহৃত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানের সিরামিক বাসন–কোসন এবং কাটলারী দ্রব্যের অদ্বিতীয় কালেকশানটিকে। অবশ্য, ইসলাম ধর্মের ইতিহাসের নানা অমূল্য নিদর্শনে সমৃদ্ধ তোপকাপির অনন্য যাদুঘরটি নিঃসন্দেহে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।প্রাসাদটি ঘুরে দেখতে আমাদের প্রায় পাঁচ ঘন্টা সময় লেগেছে, প্রকৃত সমঝদারদের হয়তো আরো বেশি সময় লাগবে। কারণ, প্রায় সাড়ে চার’শ বছরের বিশ্ব–ইতিহাসকে ধারণ করে রয়েছে এই প্রাসাদ। এত সমৃদ্ধ কালেকশান অন্য কোন যাদুঘরে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার, যদিও বিশ্বের অনেকগুলো দেশে ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে অটোম্যান সম্রাটদের বাসভবন তোপকাপি প্রাসাদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় বসফরাস প্রণালীর তীরবর্তী দোলমাবাহচে প্রাসাদে। কিন্তু, সম্রাটদের বাসভবন সরিয়ে নেয়ার পরও বড়সড় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো তোপকাপিতেই অনুষ্ঠিত হতো। বিশেষত, পবিত্র নিদর্শনগুলো, সাম্রাজ্যের খাজাঞ্চিখানা ও রত্নাগার এবং রাজকীয় সংগ্রহশালা এখানে রয়ে যাওয়ায় এর গুরুত্ব ১৯২২ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্তই অব্যাহত ছিল বলা চলে। ১৯২৪ সালের এপ্রিলে কামাল আতাতুর্কের আদেশে তোপকাপি প্রাসাদ একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়।

তোপকাপি প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আবারও সুস্বাদু বিভিন্ন কাবাব দিয়ে লাঞ্চ সেরে প্রবেশ করলাম হাজিয়া সোফিয়ায়। বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান–১ এর সময় ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত সেন্টা সোফিয়া বা আয়া সোফিয়া ১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে আসার পর একটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল। কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসার পর এই মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করে দিয়ে এটাকে একটি যাদুঘরে পরিণত করেন। ৫৩৭ খৃস্টাব্দে এত উঁচু এই গীর্জাটি নির্মাণের প্রযুক্তি মানবজাতির আয়ত্তের মধ্যে ছিল ভাবতেই অবাক লাগে। এখন অবশ্য ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে অন্তর্ভুক্ত এই জাদুঘরটিকে নিয়মিত সংস্কার কর্মসূচির অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে দেখে ভাল লাগল। যাদুঘর হলেও ভবনটির বিভিন্ন অংশে আল্লাহু, মুহাম্মদ, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং হাসান–হোসাইনের বিশাল নাম–ফলক টাঙ্গানোর ব্যবস্থা রয়েছে দেখা গেল।

তৃতীয় দিনের শুরুতে আরেকটি বাইজেন্টাইন নির্মাণশৈলীর নিদর্শন ভ্যাসিলিকা সিস্টার্ন দেখে নিলাম। ৫৪২ সালে নির্মিত এই সিস্টার্নটা মাটির নিচে নির্মাণ করা বিশাল একটি জলাধার, দৈর্ঘ্যে ১৪৩ মিটার এবং প্রস্তে ৬৫ মিটার। অনেকগুলো স্তম্ভের উপর দাঁড় করানো এই জলাধার থেকে পুরো বাইজেন্টাইন রাজধানীর পানি সরবরাহ করা হতো। এরপর আধুনিক ট্রামে চড়ে ইমিনুনু গিয়ে বোটে চড়ে বসফরাস প্রণালী ভ্রমণ, ইস্তাম্বুল ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আইটেম এই প্রমোদভ্রমণ। প্রায় দু’ঘণ্টার এই নৌবিহার যে কোন পর্যটকের জন্যে ইস্তাম্বুল নগরীকে দেখার এক অনন্য সুযোগ, গোল্ডেন হর্ণ থেকে বসফরাস প্রণালীর বেশ কিছুদূর পর্যন্ত যাওয়া–আসার পথে ঐতিহাসিক সবগুলো টুরিস্ট স্পট সবার নজরে পড়বেই। ফেরার পথে ট্রামে নগরীর আরেক প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে ইস্তাম্বুলের প্রধান আকর্ষণগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নেবার সুযোগ পেয়ে গেলাম আমরা। তারপর কয়েক’শ বছর পুরানোগ্র্যান্ড বাজারের নিকটবর্তী ট্রাম স্টেশনে নেমে লাঞ্চ সেরে ঢুকে পড়লাম বাজারে।

চতুর্থ দিনে ট্রামে চড়ে গেলাম অটোম্যান সম্রাটদের সর্বশেষ বাসভবন দোলমাবাহচে প্রাসাদে। এটাতে উনবিংশ শতাব্দীর বিশ্বসেরা সকল সাজসজ্জা, আসবাবপত্র, জীবনোপকরণ, বাসন–কোসন, কাটলারী এবং স্থাপত্য নিদর্শনের বিপুল সমাহার ঘটানো হয়েছে। বসফরাস প্রণালীর তীরবর্তী এই বিশাল রাজপ্রাসাদটির প্রতিটি হল এবং গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ এত সুন্দর কারুকার্যখচিত যে ওগুলোর মনোমুগ্ধকর শোভার দিক থেকে চোখ ফেরানোই কষ্টকর। আর, যেহেতু এই প্রাসাদের ভেতরের কোন কিছুই ক্যামেরায় ধারণের সুযোগ নেই তাই চোখে দেখার মাধ্যমে মনের মধ্যে সৌন্দর্য উপলব্ধি করাই শুধু সম্ভব এই প্রাসাদের অভ্যন্তরের এবং প্রাসাদ–সংলগ্ন একাধিক জাদুঘরের বিপুল কালেকশানের আইটেমগুলোর। উপরি হিসেবে প্রাসাদের ঐ কক্ষটিতেও ঢোকার সুযোগ পেলাম যেখানে বহুদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকার পর কামাল আতাতুর্ক মৃত্যু বরণ করেছিলেন। এক কথায় বলা চলে, চোখ ধাঁধাঁনো অভিজ্ঞতা ঘন্টা তিনেকের এই প্রাসাদ ভ্রমণ। প্রাসাদ পরিদর্শন শেষে গেলাম ইস্তাম্বুলের বিশ্বখ্যাত আরেক বাজার—স্পাইচ বাজারে, যেটাকে ঈজিপশিয়ান বাজারও বলা হয়। ইস্তাম্বুলের জনগণ বুক ফুলিয়ে দাবি করে, বিশ্বের তাবৎ দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য মশলাপাতির এত বড় সমাহার নাকি বিশ্বের আর কোথাও নেই। আমরা এখান থেকে আমাদের জন্যে এবং আত্মীয়–স্বজনদের জন্যে টোকেন হিসেবে দামী ইরানী জাফরান কিনলাম শ’খানেক ডলারের, হরেক রকম চকলেট এবং ভাকলাবা নামের ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত কনফেকশনারীও কিনতে হলো সামান্য কিছু। আমার সারা জীবনের লালিত আরেকটি সাধ তখনো অপূর্ণ– সোলাইমানীয়া মসজিদ দেখার সাধ না মিটিয়ে কিভাবে ইস্তাম্বুল ত্যাগ করব? অতএব, চতুর্থ দিনের বিকেলে কষ্ট হলেও ঐ সাধ পূরণ করলাম। তারপর গ্র্যান্ড বাজারে আরো টুকটাক শপিং সেরে চতুর্থ রাতের ডিনার সারলাম ফারুক এবং আরো দুজন বাঙালি ছাত্রের সাথে নূতন ধরনের আরেক কাবাব সহযোগে।

এই চারদিন স্বপ্নের মত কেটে গেল। শুধু একটাই আফসোস, উচ্চদামের টিকেট কেটে তোপকাপি প্রাসাদের হারেম এবং দোলমাবাহচে প্রাসাদের হারেম পরিদর্শন না করলেই মানসিকভাবে আমি অনেক বেশি তৃপ্ত হয়ে ইস্তাম্বুল ভ্রমণ শেষ করতে পারতাম! এই দুটো হারেমে কয়েক শত রক্ষিতার এবং তাদের খোজা পাহারাদারদের বঞ্চিত জীবনের যে দীর্ঘশ্বাস জমা হয়ে আছে তা আমাকে হয়তো বহুদিন তাড়া করে ফিরবে। বিশেষত, তোপকাপি প্রাসাদের হারেম তো বলতে গেলে একটা কারাগার, যেখানে সূর্যের আলোরও ভাল প্রবেশাধিকার নেই। মধ্যপ্রাচ্যের রাজা–বাদশা–সম্রাট–শেখদের এই হারেম–কালচার মুসলিম হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি লজ্জা দেয়। ইসলামের সবচেয়ে বেশি বদনাম কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে হারেমের এই যৌনদাসী পোষণের কালচার। এই বর্বর অসভ্যতা থেকে মুক্তি পেতে মুসলিম সমাজকে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, আর কতদিন? ২৫ এপ্রিল ২০১৮

লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত