![মে দিবসের চেতনায় উদ্ভাসিত হোক শ্রমিক আন্দোলন](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/05/01/may-day_137602.jpg)
তপন দত্ত, ০১ মে, এবিনিউজ : ১৩ দশকেরও বেশি সময় আগে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে সংঘটিত আন্দোলন বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলন এত জনপ্রিয় ছিল যে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আই.এল.ও. ১নং কনভেনশনটি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পাকিস্তান আমলে শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্য নীতির কারণে বর্তমান বাংলাদেশ মোটেও শিল্পায়িত হয়নি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দ্রুত এক ঝাঁক শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা ছিল হাতে গোনা। কিন্তু ’৭৫ সালের পর সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্প কারখানা লুটপাট করে, ঢালাও ব্যাংক ঋণ নিয়ে দ্রুত শিল্পের প্রসার হয়েছে। ব্যাংক ঋণের অনেক টাকা লোপাট হয়ে গেছে, খেলাপী হয়ে গেছে।
শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্টস দিয়ে বাংলাদেশের শিল্পায়ন শুরু হলেও ক্রমান্বয়ে সিমেন্ট, লৌহজাত শিল্প, সিরামিক, ফার্মসিউটিক্যালস্ কোং, ইলেকট্রনিক্স, ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রেও ডেইরি, পোল্ট্রি, মৎস্য খামার ইত্যাদি কৃষিভিত্তিক শিল্পও দ্রুত প্রসার ঘটেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষ, অদক্ষ প্রায় ১ কোটি শ্রমিক কর্মরত আছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ সেবাখাতের বিরাট ব্যাপ্তি ঘটেছে। ফলে অদক্ষ কৃষি ব্যবস্থা থেকে শিল্প ও সেবা খাতে দেশের উত্তরণ ঘটেছে। দেশে ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটির উপর (সূত্র : বিসিএস)। শ্রম শক্তির একটি অংশ বেকার থাকলেও ৬ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের কারণে পাকিস্তান আমলের স্থবির অর্থনীতির দেশ থেকে বাংলাদেশ একটি সচল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পয়ঃব্যবস্থা, জনশক্তির রপ্তানি, কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও ভোগ্যপণ্য রপ্তানি ইত্যাদি খাতে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। তার জন্য সরকারকে বাহবা দিতে হয়।
দেশে বিশাল বিশাল অবকাঠামো স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে কীর্তিনাশা পদ্মার দুপাড় সেতু দিয়ে যুক্ত করা ও কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ কাজ নিশ্চয়ই একটি অভাবনীয় ব্যাপার। এছাড়া ৪/৬ লাইনের রাস্তা, রেলের সম্প্রসারণ, কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন করে পূর্ব এশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপন করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এ সমস্ত বিশাল বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ, সারা দেশকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় নিয়ে আসা নবায়নযোগ্য জ্বালানি দ্বারা বিদ্যুৎ তৈরির চেষ্টাও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু বাতির নীচে অন্ধকারের মতো এত সব চাকচিক্য উন্নয়ন অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরও দেশের সিকিভাগ লোক দরিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। প্রায় ১২ ভাগ লোক অতি দরিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। শিক্ষিত যুবকদের একটি বড় অংশ বেকার অথবা উপযুক্ত কাজ খুঁজে পায় না। জনগণের আয় বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। উপরের দিকের ১% লোক হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। অথচ সম্পদ সৃষ্টিকারী শ্রমজীবী মানুষণ্ড যাদের শ্রমে–ঘামে দেশের প্রবৃদ্ধি ঘটছে, দেশ উন্নত হচ্ছে, বিদেশে নানা নিপীড়ন অপমান সহ্য করে যে সব শ্রমজীবী মানুষ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে তারা সমাজে অবহেলিত থাকছে।
দেশের নব্য শিল্প মালিকরা শ্রম আইন প্রদত্ত শ্রমিকের নিম্নতম অধিকারটুকুও দিতে নারাজ যদিও বিদ্যমান শ্রম আইনকে মোটেও শ্রমবান্ধব বলা যাবে না।
গার্মেন্টস, স্বাস্থ্যসেবা খাত, জাহাজভাঙা শিল্পে নিয়োজিত লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে একেবারে প্রাথমিক অধিকার একটি নিয়োগপত্র পাওয়া, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বছরে সবেতন ছুটি পাওয়া। কিন্তু এই সব খাতের মালিক–কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের প্রাথমিক অধিকারটুকুও দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কঠোর পরিশ্রম করে দিন–সপ্তাহ–মাস শেষে প্রাপ্ত মজুরীর পরিমাণ এতই কম যে সংসার চালানোর জন্য অধিকাংশ শ্রমিক একই প্রতিষ্ঠানে বা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২ সিফ্টে কাজ করতে বাধ্য হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকরা ‘কাজ নাই বেতন নাই’ ভিত্তিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। তাদের গ্র্যচুয়িটি, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বলতে প্রায় কিছুই নেই। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে কত সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ট্রেনিং হচ্ছে। আইন তৈরি হচ্ছে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই বছরে ৩ মাসে শুধুমাত্র জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে ৯ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে।
কাজেই কম মজুরী, প্রাথমিক অধিকারণ্ড নিয়োগপত্র, সবেতন ছুটি, মাতৃকালীন ছুটি না পাওয়া, গ্র্যচুয়িটি, পেনশন থেকে বঞ্চনা, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে কাজ করা, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কোনো বেতনের মান নির্ধারণ না করে মালিক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারিত বেতনে কাজ করতে বাধ্য হওয়া, সংসার চালানোর জন্য ২ সিফ্টে কাজ করা সর্বোপরি ছলে বলে কৌশলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করাণ্ড আজ যেন বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির বিধিলিপি।
ট্রেড ইউনিয়ন রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে বিভক্ত। ট্রেড ইউনিয়নকে এক শ্রেণির শ্রমিক নেতার ব্যক্তিগত তরক্কীর জন্য ব্যবহার করে। সৎ দক্ষ, শ্রমিক শ্রেণির প্রতি সংবেদনশীল ট্রেড ইউনিয়ন নেতার অভাব ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দুর্বল হওয়ার অন্যতম কারণ। জাতীয় ব্যাধির মতো ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও দুর্নীতি ও শঠতা প্রবেশ করেছে। এই ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন দিয়ে সত্যিকারভাবে সংগ্রামী লড়াকু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়া যাচ্ছে না।
ফলে বর্তমান বাস্তবতায় শ্রমিকরা দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে অনেক অর্জিত অধিকার হারাচ্ছে। ন্যায্য মজুরী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার সিংহভাগ শ্রমিক/কর্মচারী হিসাবে কাজ করে। তাদের শ্রমের ঘামের ন্যায্য পাওনা না দিলে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। একদল শুধু ভোগ করে। তারা শ্রমের তৈরি মুনাফা ভোগ করে, ব্যাংকের ঋণ লোপাট করে, বিদেশে টাকা পাচার করে। মোটা দাগে এরা শুধু শ্রমজীবী উৎপাদনকারী মানুষকে ঠকায় না তারা দেশকেও ঠকায়।
কোটি কোটি মানুষের শ্রমে মেধায় অর্জিত দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির ভোগে লাগছে। বিদেশে পাচার হচ্ছে, সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। অথচ সরকার ও জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের আয় বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য কমানো। এই বৈষম্য না কমালে উন্নয়ন টেকসই হবে না। উন্নয়নের ভিত শক্ত হবে না। যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে। সমাজের বিশাল অংশকে অধিকার বঞ্চিত রেখে উন্নয়নের ভিত মজবুত হয় না। সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে থাকবে।কাজেই ১৩২ বছরের বেশি সময় আগে সংঘটিত মে দিবসের অর্জিত অধিকার ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের অধিকারসহ শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার, বাঁচার মত সম্মানজনক মজুরী, আইনানুগ লভ্যাংশ, সবেতন বিশ্রাম, ছুটি ইত্যাদি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে মালিকদের সহনশীল হতে হবে তেমনি শ্রমিকদের মে দিবসের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ সৎ, স্বচ্ছ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা
(সংগৃহীত)