
ঢাকা, ০৪ মার্চ, এবিনিউজ: ড. সেলিম রায়হান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বাণিজ্যনীতি, দারিদ্র্য ও অসমতা, শ্রমবাজার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ, অর্থনৈতিক মডেলিং প্রভৃতি বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ। পড়ালেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর পিএইচডি অর্জন করেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, ইউএনএসকাপ, আঙ্কটাড, ইফপ্রি, জাতিসংঘ সচিবালয়, এফএও, ইউরোপিয়ান কমিশন, আইএলও, আইডিআরসি এবং ডিএফআইডির মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজ করেছেন। সম্প্রতি সানেমের চলতি কনফারেন্স, প্রবৃদ্ধি, বৈষম্য, অন্তর্ভুক্তি, শ্রমবাজার, বিনিয়োগ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি সাক্ষাত্কার দিয়েছেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন এম এম মুসা
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এবারের কনফারেন্স আয়োজনের থিম কী?
এবারের কনফারেন্সের থিম হলো— ম্যানেজিং গ্রোথ ফর সোস্যাল ইনক্লুশন। আমরা দেখছি, আমাদের দেশের সরকার ও অন্য অনেক দেশের সরকারের একটা বড় এজেন্ডা হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এক্ষেত্রে আমরা বুঝতে চাই যে, প্রবৃদ্ধি আসলে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে কিনা কিংবা প্রবৃদ্ধি হলেই সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হবে কিনা। দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু সমাজের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী এ থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না। তাহলে সেটা নিশ্চিত করা কীভাবে সম্ভব? এর পুরো আঙ্গিক নিয়েই মূলত এ কনফারেন্সের আয়োজন। আমাদের কনফারেন্সের বড় উদ্দেশ্য, দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের উত্সাহিত করা। ছয়টি প্যারালাল সেশনে ১৮টি পেপার উপস্থাপন করা হবে। সেখানে প্রবৃদ্ধি, শ্রমবাজার, এসডিজি, দারিদ্র্য ও অসমতা, খাতওয়ারি অর্থনীতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ হাজির করবেন গবেষকরা।
প্রবৃদ্ধির সমান্তরালে বৈষম্য বৃদ্ধির প্রপঞ্চকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
গত দুই দশকে বাংলাদেশে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তাতে দারিদ্র্য অবশ্যই কমেছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা দুটি জায়গায়। এক. যেভাবে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ হয়, তা খুবই ভঙ্গুর। এমন একটি আয়স্তরে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ করা হয়, যা কখনো শোভন জীবনযাপন করার মতো নয়। কাজেই দারিদ্র্যসীমার আয়স্তরকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্যসীমার কাছে ঘোরাফেরা করছে— এমন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর জন্য আমরা বড় ধরনের সুফল এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। দুই. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমেনি। সেটা বরং বেড়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির প্রতিফলন হচ্ছে, আমাদের গিনি কো-ইফিসিয়েন্ট কমেনি। এছাড়া সামাজিক ক্ষেত্রেও বেশকিছু জায়গায় নানা বৈষম্য ও সমস্যা আছে। সেদিক থেকে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে যেতে বাংলাদেশের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
কোন কোন দিকে নজর দেয়া দরকার বলে মনে করেন?
সম্প্রতি করা গবেষণায় দেখেছি যে, সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের কাছাকাছি। সবচেয়ে নিচে আফগানিস্তান, তার উপরে আছে পাকিস্তান। তার উপরে আছে বাংলাদেশ ও ভারত এবং দুটো দেশই একেবারে কাছাকাছি আছে। এমনকি সামাজিক অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে নেপালও বাংলাদেশের উপরে। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বটে, কিন্তু বিশাল একটি জনগোষ্ঠী বিদ্যুত্, স্যানিটেশন, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং এ বিষয়গুলোও দেখতে হবে। আবার দেখতে হবে পুরো আর্থিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা কতটা আছে। মজার বিষয়, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে অনেক কম। তার মানে কম মাথাপিছু আয় নিয়েও বাংলাদেশ ভারতের কাছাকাছি অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গায় যেতে পেরেছে। কাজেই মাথাপিছু আয় বাড়লে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে— বিষয়টি মোটেই তা নয়।
আমাদের কয়েকটি জায়গায় নজর দিতে হবে। এক. টার্গেটেড নীতি ও কর্মসূচি নিতে হবে। এখনো অনেক মানুষ মৌলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। সুতরাং সরকারি ব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যাতে এসব খাতে ব্যয় হয়, সেজন্য টার্গেটেড কর্মসূচি নিতে হবে। দুই. ভৌত অবকাঠামোর বিশেষ করে বিদ্যুত্, স্যানিটেশন, নিরাপদ পানি ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন প্রয়োজন। তিন. সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্টরগুলোও কাজ করে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আছে কিনা, এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি দেখতে হবে সরকার, গণতান্ত্রিক কাঠামো, আমলাতন্ত্রের চরিত্র কেমন। এসব বিষয়ও দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য করে দেয় যে, কে কত বেশি সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গায় যেতে পারে। কাজেই এক্ষেত্রে নীতি শিক্ষা এই যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে লক্ষণীয় সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে এবং টার্গেটেড কর্মসূচি নিতে হবে। মৌলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তার গুণগত মান উন্নত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়াতে হবে, যাতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে এবং এটা না হলে বিশাল জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগের সুযোগ পাবে না। এবং চূড়ান্ত বিষয় হলো, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি। সেগুলোও অব্যাহতভাবে করতে হবে।
বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও কেন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। এগুলো সমাধানের পথে আমরা আছি কি?
বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন— বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। তবে একটা-দুটো প্রচেষ্টার নিরিখে না দেখে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি দেখা দরকার। এখানে দেখতে হবে, কেন ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা রয়েছে। এক. এখানে একটা বড় সমস্যা, অবকাঠোমোগত সমস্যা। বিদ্যুত্-গ্যাস-জমির বিষয়গুলো সমাধান করতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার কারণ এগুলো। এগুলোর উন্নয়ন করতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবেন না। দুই. প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাব, যার প্রতিফলন হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতি— যা বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সহায়ক নয়। তিন. আমার ধারণা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তির জায়গাটিও এখনো ফিরে আসেনি। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই কিন্তু এক ধরনের অস্বস্তি আছে যে, আবার আগের সংঘাতময় পরিস্থিতি ফিরে আসবে কিনা। আমার মনে হয়, অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটানো অবশ্যই প্রথমে দরকার। এক্ষেত্রে নজর দিতে হবে বাংলাদেশে সবকিছুতে বিদ্যমান ধীরগতি কমানোয়। যত ধীরগতি হয়, তত ব্যয় বাড়ে এবং আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি সরকারের উচিত হবে মানুষের মধ্যকার অস্বস্তির ক্ষেত্রগুলো দূর করা। এবং সেটা করতে না পারলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কোনোটাই সেভাবে সফল হবে না।
বাণিজ্য বৃদ্ধিতে নতুন বাজার খোঁজা ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনার কথা বলা হলেও সেদিকে তেমন নজর দেয়া হচ্ছে না। কেন?
আমাদের রফতানি ঝুড়ি দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এখন মোট রফতানির প্রায় ৮০-৮২ শতাংশ পোশাক খাতের পণ্য। অন্য খাতগুলো সেভাবে এগিয়ে আসছে না। এ খাতগুলোর আসলে বেশকিছু নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। ধরা যাক, চামড়া শিল্প। বলা হয়, পোশাক খাতের পরে চামড়া শিল্পের বড় সম্ভাবনা। অথচ দেখুন, এখনো হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে নেয়া যায়নি। সেখানে নিতে না পারলে এর রফতানিও বাড়ানো যাবে না। বর্তমানে চামড়াজাত পণ্যের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার বা তার কিছু বেশি। সেটিকে সহজেই ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় তা কখনো সম্ভব নয়। নতুন বাজার ও নতুন পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকরা এক ধরনের কমফোর্ট জোনে চলে গেছেন। নতুন বাজার খোঁজার জন্য যে ধরনের পুশ এবং অন্য উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে সহযোগিতা বা সমস্যা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ দরকার, সেটা কিন্তু নেই।
অব্যাহতভাবে গার্মেন্টে প্রণোদনা দেয়া হলেও অন্য শিল্পে খুব একটা দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার মত কী?
গার্মেন্টে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ অনেক ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়, যা অন্য শিল্পে দেয়া হয় না। এজন্য সবাই সেখানেই বিনিয়োগ করে। সহজ কথা, আজকে কারো বিনিয়োগযোগ্য অর্থ থাকলে তা গার্মেন্টেই বিনিয়োগ করা হয়। এর আরেকটি কারণ, গার্মেন্ট একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প। সবাই জানে, এখানে বিনিয়োগ করলে সহজেই রিটার্ন বা সুফল পাওয়া যায়। অন্য খাতগুলোয় বিনিয়োগ করতে গেলে অনেক ঝুঁকি আছে। ঝুঁকিগুলো প্রশমনে সরকারের তরফ থেকে তেমন উদ্যোগ নেই। সম্প্রতি আমরা তিনটি খাত নিয়ে একটি গবেষণা করেছি। এক. চামড়া; দুই. কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও তিন. তথ্যপ্রযুক্তি খাত। গার্মেন্টের পরে এ খাতগুলোর সামনে আসা উচিত। এ তিনটি খাতে নিজস্ব এত সমস্যা আছে যে, সার্বিকভাবে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন করলেও তাতে এ খাতগুলোর খুব একটা উন্নতি হবে না। যতক্ষণ ট্যানারি সাভারে না সরানো হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন পূর্ণোদ্যমে চালু হলে তাতে চামড়া খাত কতটা লাভবান হবে, তা বোধগম্য নয়। এ কথাটি এজন্য বলছি যে, সার্বিক পরিবেশ উন্নয়ন করলে হয়তো সবাই সুফল পাবে কিন্তু সমান মাত্রায় পাবে না। যারা এখন শক্তিশালী, তারা বেশি লাভবান হবেন। যাদের নিজস্ব বেশকিছু সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধান না করলে তারা সার্বিক উন্নয়ন থেকে সেভাবে সুফল পাবেন না। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কয়েকটি বড় সমস্যায় জর্জরিত। সেখানে এখনো বড় ধরনের ওয়্যারহাউজ নেই, হিমাগার নেই এবং প্রক্রিয়াকরণ শিল্প করার মতো বিদ্যুতের সুযোগও নেই। আইটি সেক্টরের বড় সমস্যা হচ্ছে, গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ নেই। কিংবা হাইস্পিড ইন্টারনেটের অবকাঠামো নেই। তাহলে কীভাবে এসব শিল্পকে পরবর্তী ধাপের শিল্পে নিয়ে আসা যাবে? নীতিনির্ধারকরা বড় ক্ষেত্রগুলো দেখেন কিন্তু আসলে সুনির্দিষ্ট ও ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান করা দরকার।
এগুলো কি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে?
অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। এবং প্রতিটি খাতের জন্য কার্যকর টাস্কফোর্স করা দরকার। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। এরই মধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে যে, কী কী ধরনের সমস্যা আছে। সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।
বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুল্ক বা অশুল্ক বিষয়গুলো কতটা প্রতিবন্ধক?
বিশেষ করে শুল্কের চেয়ে অশুল্ক বাধাই বেশি। আমরা বৈশ্বিকভাবে এখন একটা নতুন ধাপে প্রবেশ করছি। গত দু-তিন দশক গেছে একটি ধাপে, উদার বাণিজ্যিকীকরণ। তাতে কিছু দেশ উপকৃত হয়েছে, তবে অন্য কিছু দেশ সেভাবে লাভবান হয়নি। ফলে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। আজকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা ব্রেক্সিটের মাধ্যমে নব্য সংরক্ষণবাদীরা ক্ষমতায় এসেছেন, আরো হয়তো আসবেন। তাদের উত্থানে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। হয়তো কেউ কেউ মনে করতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে টার্গেট করবে। এতে বাংলাদেশের উত্ফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। আজকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবার জন্য ১০ শতাংশ শুল্ক বাড়িয়ে দিলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের তুলনায় চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেশি। হয়তো দেখা যাবে, তারা বিভিন্নভাবে পণ্য দাম কমিয়ে রাখছে। কাজেই দেশটি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের সেই ধরনের সুযোগ নেই। এটি বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। তাই বাংলাদেশে কৌশল নেয়া উচিত যে, দক্ষিণ-দক্ষিণ (সাউথ-সাউথ) দেশগুলোর সঙ্গে আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়া। বিশেষ করে চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আরো কীভাবে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের সুযোগগুলো এগিয়ে নেয়া যায়— সেটাই হওয়া উচিত আমাদের প্রাধিকার।
বাংলাদেশের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি কি সঠিক পথে আছে?
রাজস্ব ও মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক দশক ধরে এক ধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখছে। ফলে দেশে মোটামুটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে। কিন্তু যেটা হচ্ছে না, তা হলো— ব্রেক থ্রু। প্রতিবারই বাংলাদেশ ব্যাংক যখন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, তখন বলে— এবারের মুদ্রানীতি অ্যাকোমোডেটিভ। আমার মতে, এক্ষেত্রে ব্রেক থ্রু টাইপের চিন্তা করা দরকার। এটি দুটো জায়গায়। এক. রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে। ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশের বিপুল রাজস্ব আহরণের ব্যাপার আছে। আমাদের কর রাজস্ব অনুপাত অনেক বাড়াতে হবে। সেটা কীভাবে বাড়ানো হবে? সেটা কি শুধু কর প্রশাসন আধুনিক করে? শুধু তা করলে হবে না, করের আওতা বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে আরো দক্ষ করে তুলতে হবে। যারা কর দেন না, তাদের কর দিতে বাধ্য করতে হবে। তাদের কাছ থেকে কর আদায়ে সরকারের কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া মুদ্রানীতির বিষয়েও বাংলাদেশের ব্রেক থ্রু দরকার। এখনকার মুদ্রানীতি বিচিত্রমুখী খাত বা যারা সামনে আসতে চান, তাদের সেভাবে সাহায্য করতে পারে না। ব্রেক থ্রু কীভাবে হবে, কীভাবে কম সুদে অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া যাবে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাদের কীভাবে মূলধারার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আনা যাবে— সে জায়গায় আমার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব বেশি চিন্তা করেনি।
রাজনৈতিক নেতৃত্বও তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়। আপাতত রাজনৈতিক নেতৃত্ব হয়তো এক ধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রেখে খুশি। কারণ আমরা তো কোনো সংকটে নেই। সত্যিকার অর্থে আমাদের ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু আমার উদ্বেগটা হচ্ছে দুটো জায়গায়। এক. প্রবৃদ্ধি এখনো কিন্তু সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। সে জায়গায় একটা চ্যালেঞ্জ আছে। দুই. বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি আর কত দিন এ মাত্রায় ধরে রাখতে পারব, যদি তার ভিত্তিটা আমরা বহুমুখী না করি। অর্থনীতি বহুমুখী না করলে প্রবৃদ্ধি টেকসই করার বিষয়টি বড় ধরনের ইস্যু হবে। এ বিষয় মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। আমরা দেখছি, একদিকে গার্মেন্টের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে আবার শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। দুটো গল্প কিন্তু মেলে না। আমাদের মেলাতে হবে যে, গার্মেন্টের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে আবার শ্রমিকরাও মনে করছেন, এর সুফলের একটা অংশ তারা পাচ্ছেন।
আমরা এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে আছি। এটি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ প্রস্তুত কি?
আমরা উইন্ডো অব অপরচুনিটিজ ফেইজ পার হচ্ছি। এ ফেইজটা খুব ক্ষণস্থায়ী। বলা হয়, আগামী ১৫ বছর পর্যন্ত আমাদের জন্য এ উইন্ডো অব অপরচুনিটিজ আছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মানে কী? এর মানে হলো, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর অনুপাতে কেমন। আমরা যে ডিভিডেন্ড পাব এবং তরুণ জনগোষ্ঠী যে এখান থেকে আরো প্রবৃদ্ধি এনে দিতে পারবে— সেক্ষেত্রে দুটো চ্যালেঞ্জ আছে। এক. নারী— যারা তরুণ জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ, তাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ খুবই কম। তাদের শ্রমবাজারে এনে উত্পাদনশীল খাতে ব্যবহার করা গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। দুই. কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর শিক্ষা বা কর্মদক্ষতার হার অনেক কম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। কাজেই আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এ দুটো জায়গায় মার খেয়ে যাচ্ছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে হলে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারকে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে।
শ্রমবাজারে দেখা যাচ্ছে, আনুষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বেশি হচ্ছে। এটি কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে?
এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, শোভন কাজের (ডিসেন্ট জব) সুযোগ সৃষ্টি ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। বলা বাহুল্য, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না হলে সমাজে নানা ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। দেখা যাচ্ছে, একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্যের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। একটা অংশ প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে, বিশাল অংশ তা পাচ্ছে না। ফলে এক ধরনের নিম্নমানের জীবন নির্বাহ করছে। এক্ষেত্রে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা না গেলে সামাজিক অস্থিরতা কমানো যাবে না। আর তা করতে হলে আনুষ্ঠানিক খাতে বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির একপর্যায়ে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রবণতা বাড়ে কিনা? অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা কী বলে?
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক সরলরৈখিক নয়। এক অর্থে সম্পর্ক আছে। যদি খারাপ ধরনের প্রবৃদ্ধি হয় তাহলে সেখান থেকে মোটামুটি প্রবৃদ্ধির একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে আসতে গণতন্ত্রের দরকার রয়েছে। কিন্তু ওই পর্যায় থেকে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধিতে যেতে চাইলে সেখানে গণতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রহীনতা খুব বেশি কাজ করে না। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, ৮ বা ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে তেমনভাবে গণতন্ত্রের দরকার হয় না। এ কথায় কিন্তু একটা ফাঁক আছে। ফাঁকটা হচ্ছে, যদিও বড় মাত্রায় প্রবৃদ্ধি আনতে হলে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই কিন্তু ওই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর তা দীর্ঘ সময় ধরে বজায় রাখা এবং প্রবৃদ্ধিটা অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। অন্তর্ভুক্তির জন্য গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জোরালো ভূমিকা রয়েছে। আমাদের একটি ট্রেড অফেরও দরকার আছে। আমরা কি ব্যাপকমাত্রার প্রবৃদ্ধি, নাকি ভালো ও অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই প্রবৃদ্ধি চাই? আমার মনে হয়, দ্বিতীয় পথটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে শ্রম উত্পাদনশীলতা কম। এটি বাড়াতে কী করা উচিত?
কারখানার মালিকরা অনেক সময় অভিযোগ করেন যে, শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা তো কম, তাহলে মজুরি কীভাবে বেশি দেব। শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা কিন্তু কেবল শ্রমিকের ওপর নির্ভর করে না। শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা অবশ্যই তার দক্ষতা ও শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু অনেক সময় আসলে তিনি কী ধরনের মূলধনি যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছেন এবং কী ধরনের কর্মপরিবেশে কাজ করছেন, তার ওপরও উত্পাদনশীলতা নির্ভর করে। উদাহরণ দেয়া যাক। একই ধরনের পণ্য উত্পাদনে চীনে বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মূলধনি ব্যয় হয়। তার মানে হলো, চীনা শ্রমিকরা বাংলাদেশের শ্রমিকদের তুলনায় বেশি আধুনিক যন্ত্র নিয়ে কাজ করেন। একদিকে তার শিক্ষা আছে, তার ওপর তিনি কারখানায় যেসব যন্ত্র নিয়ে কাজ করেন, সেসবের সক্ষমতা বাংলাদেশী কারখানায় ব্যবহূত যন্ত্রের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এটা তার উত্পাদনশীলতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কাজেই এখানে শ্রমিককে শুধু দায়ী করে লাভ নেই। আমাদের এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ হয়তো পুঁজিনিবিড় যন্ত্রপাতির দিকে নাও যেতে পারে। হয়তো নীতিনির্ধারকরা চাইবেন যে, যন্ত্রপাতির চেয়ে মানুষের কর্মসংস্থান বেশি হোক। সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এতে শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা অনেকখানি বাড়বে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতে কী উদ্যোগ নেয়া যায়?
বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতে ১০ টাকায় হিসাব খোলার ব্যবস্থা করেছে। এটি কতটা সফল হয়েছে, জানা নেই। এখানে দেখতে হবে যে, প্রকৃত অর্থে যাদের ঋণ দরকার, তারা আসলে তা পাচ্ছেন কিনা। আমাদের দেশে যা হয় তা হলো, যাদের দরকার নেই, তারা প্রচুর পান এবং যাদের দরকার তারা পান না। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ অনেক দুর্বল। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বড় কথা হলো, ব্যক্তি ও যে খাতগুলোর প্রবৃদ্ধিতে আরো ভূমিকা রাখা সম্ভব, তাদের জন্য ঋণ নিশ্চিত করা। একটি বড় অসঙ্গতি হচ্ছে, ব্যাংকগুলোয় অলস টাকা পড়ে আছে অথচ যাদের দরকার, তারা ঋণ পাচ্ছেন না। তাহলে গ্যাপটা কোথায়? এক্ষেত্রে ব্যাংক মনে করে, যাদের টাকা দরকার, তাদের দেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। আবার যারা বিনিয়োগ করতে চান, তারা কেবল ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াটাই দেখেন। অন্যান্য সমস্যার কারণে তিনি যে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন না, সেটা দেখেন না। এমন হলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কথার কথা হিসেবে থেকে যাবে। অনেকেই মনে করেন, মানুষকে ঋণ দেয়াই বুঝি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। আসলে বিষয়টি তা নয়। বিনিয়োগকারীর অন্যান্য সমস্যাও সমাধান করতে হবে। দেখতে হবে কেন তিনি এগোতে পারছেন না। কাগজে-কলমে দেখা যাচ্ছে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হয়ে গেছে। কারণ ঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তিনি সার্বিকভাবে সুফল পাচ্ছেন না।
সৌজন্যে: বণিক বার্তা