রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo

‘বাধ্যবাধকতা এখন ব্যবসায়িক সম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে’

‘বাধ্যবাধকতা এখন ব্যবসায়িক সম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে’

ঢাকা, ০৫ মার্চ, এবিনিউজ : মামুন-উর-রশিদ এমডি ও সিইও, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড

১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে প্রবেশনারি কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের বর্তমান এমডি ও সিইও মামুন-উর-রশিদের। তিন দশকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে কাজের পর ২০১৩ সালে তিনি উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে যোগ দেন। পারফরম্যান্সের স্বীকৃতিস্বরূপ এক বছরে দ্বিতীয়বারের মতো পদোন্নতি পেয়ে গত অক্টোবরে ব্যাংকটির নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব নেন। নিজ ব্যাংকের ব্যবসায়িক অর্জন ও পরিকল্পনা, ব্যাংকিং খাতের তারল্য পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাত্কার গ্রহণে ছিলেন মাহফুজ উল্লাহ বাবু।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কেমন চলছে?

বিনিয়োগ পরিবেশে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যাংকের ব্যবসায়িক ভিত্তিটিও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি। এজন্য সবার আগে গ্রাহকভিত্তি বাড়াচ্ছি। আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর মোটামুটি পাঁচ মাস হয়েছে। এ সময়টায় ব্যাংকের কর্মীরা মূলত গ্রাহক বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছেন। এর সুফলও দেখা যাচ্ছে। গত পাঁচ মাসে আমাদের গ্রাহক সংখ্যা ৪৯ হাজার বেড়েছে। শতকরা হিসাবে দেখলে গ্রাহক প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ, যা আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে দেখা সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।

আপনারা জানেন, ঐতিহাসিকভাবেই স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যবসায় ১০-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়েছি আমরা। আগামীতে আমানত, ঋণ উভয় ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি আমরা। সম্পদের গুণগত মান ধরে রেখে প্রবৃদ্ধিটা সম্ভব হলে ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে চাই আমরা। তবে সেটি আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হবে না। বরং নতুন নতুন ক্ষেত্রে ব্যবসা সম্প্রসারণের চেষ্টা জোরদার করা হবে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের কর্মীরা সেভাবেই প্রস্তুত হচ্ছেন।

ব্যাংকের বিজনেস পোর্টফোলিও নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

আমরা বড় করপোরেট গ্রাহকদের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছি। বর্তমান পরিবেশে এ গ্রাহকরা অনেক কম সুদে ঋণ চাইছেন। অনেক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানই জামানতের বদলে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের পারসোনাল গ্যারান্টির ভিত্তিতে ঋণ চাইছে। ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়লেও এটিই এখন বাস্তবতা। ব্যবসায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ পোর্টফোলিওর জন্য বড় ঋণ আমাদের অবশ্যই দরকার হবে। তবে আমরা বেশি সম্ভাবনা দেখছি এসএমই, পারসোনাল ফিন্যান্স, কৃষির মতো খাতগুলোয়।

কৃষি, এসএমইর মতো খাতগুলোয় ঋণ বিতরণ উত্সাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে। বলা যায়, এক রকম বাধ্য হয়েই কৃষি বা এসএমইর মতো খাতগুলোয় ঋণ বিরতণ বাড়াতে হচ্ছিল ব্যাংকগুলোকে। এখন আমরা দেখছি, সেসব খাতে ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা অনেক বেড়েছে। আমি বলব, একসময়ের বাধ্যবাধকতাটাই এখন ব্যাংকের জন্য ব্যবসায়িক সম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে।

কৃষির কথাই ধরুন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে, আমাদের ২ শতাংশ ঋণ কৃষি খাতে বিতরণ করতে হয়। বর্তমানে আমাদের লোন পোর্টফোলিওর ৩-৪ শতাংশ কৃষি খাতে। আমি দেখছি, এ হার কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। কৃষি খাতে ব্যাংকঋণের চাহিদা আছে। আমাদের শুধু এ খাতে ঋণ বিতরণ, ব্যবস্থাপনা ও আদায়ের প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।

কৃষি খাতে আমরা আরো ভালো করতে পারি। অত্যাধুনিক কৃষি, বৃহদায়তন উত্পাদন- এগুলোর মাধ্যমে কৃষি খাতের উত্পাদন ও মুনাফা আরো বাড়ানো সম্ভব। এজন্য চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ, সমবায় কৃষি, সামষ্টিক কৃষি উত্পাদন কর্মসূচি- এমন পদক্ষেপগুলো বাড়ানো গেলে কৃষি অনেক এগিয়ে যাবে। এক জায়গায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশের জমিতে সব আল যে স্থান দখল করে, তার মোট আয়তন পটুয়াখালী জেলার চেয়েও বড় হবে।

যথাযথ টিম-আপ ও কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসএমই থেকে ভালো মুনাফা করে দেখিয়েছে দেশের একাধিক ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমরা সেদিকেও জোর দিচ্ছি। এর বাইরে রিটেইল ফিন্যান্সও বেশ সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে। ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমানে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাদের ছোট ছোট প্রয়োজনে ব্যাংকের সাহায্য নেয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পারসোনাল লোন, ক্রেডিট কার্ড এগুলোতেও আমাদের মনোযোগ বাড়ছে।

ব্যাংকিং খাতে তারল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবেন।

তারল্য নিয়ে প্রচলিত বক্তব্যের সঙ্গে আমার কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। আমি দেখছি, ব্যাংকে এত অলস টাকা নেই। আমানতের যে অংশটা এখনো বিনিয়োগ করা হয়নি, সেটিই তারল্য। একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে বিভিন্ন ফরম্যাটে সেখান থেকে ১৯ দশমিক ৫ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে সাড়ে ৬ টাকা নগদে এবং বাকি ১৩ টাকা বন্ডে রাখতে হয়। তাহলে ব্যাংকের কাছে বিনিয়োগ করার জন্য ৮০ টাকা ৫০ পয়সা থাকে। এদিকে ট্র্যাডিশনাল ব্যাংক আমানতের ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে, ইসলামী ব্যাংকগুলো পারে ৯০ শতাংশ। আপনি খোঁজ নিলে দেখবেন, প্রায় সব ব্যাংকের বিনিয়োগই ৮৫ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখা অর্থকে অতিরিক্ত তারল্য হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।

সময়ে সময়ে তারল্যের চিত্রটি বদলাতে পারে। তবে আমাদের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে সাধারণত অস্বাভাবিক উত্থান-পতন দেখা যায় না। বিকল্প বিনিয়োগ ক্ষেত্রগুলোয় ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি থাকায় মানুষ সবসময়ই ব্যাংকে টাকা রেখে আসছে, এখনো রাখছে। গ্রাহকরা আবার ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিতে দুটোরই প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তারল্য নিয়ে আমি চিন্তিত নই।

আপনারা ব্যবসায় উচ্চপ্রবৃদ্ধির পরিকল্পনা করছেন। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কতটা?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম-কানুন কিন্তু অনেক কঠিন। একেকটি ঋণ দেয়ার আগে, বিশেষ করে বড় ঋণে আমরা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সতর্ক। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে মহাব্যবস্থাপক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সবাইকেই এখন অনেক সাইট ভিজিট করতে হচ্ছে। গ্রাহকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে আশা করছি ঋণ ঝুঁকি কমে আসবে। তার পরও ব্যবসায় স্বাভাবিক ঝুঁকির বিষয়টি আমলে রাখতেই হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার ঝুঁকি— এসব শব্দের সঙ্গে এখন ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির নামই বেশি উচ্চারণ হয়। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কী করছে?

গত বছর এটিএম বুথে বিদেশী অপরাধীদের কিছু জালিয়াতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর এ ব্যাপারে সবার উদ্বেগ ও সতর্কতা অনেক বেড়েছে। এ সচেতনতা ইতিবাচক। আমি বলব, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলোও বাড়ছে। আবার তা নিয়ন্ত্রণেরও উপায় বেরোচ্ছে। আমরা আমাদের আইটি বিভাগকে বেশ শক্তিশালী করে সাজিয়েছি। এ টিমে দেশের বাইরে পড়াশোনা ও কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তারাও রয়েছেন। সাইবার ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের সিস্টেমে সেকেন্ডারি লেয়ারের ফায়ারওয়াল বসানো হচ্ছে।

শেয়ারবাজারে আপনাদের অপারেশন্স আছে। সাবসিডিয়ারিগুলো কেমন করছে?

শেয়ারবাজার নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের একটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও একটি ব্রোকারেজ সাবসিডিয়ারি রয়েছে। তাদের ব্যবসায়িক ফলাফল সন্তোষজনক। এর বাইরে নিজস্ব পোর্টফোলিওতেও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। আপনারা জানেন, বর্তমান আইনে ব্যাংকের জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ আগের মতো নেই। আমরা কোনোভাবেই এক্সপোজার লিমিট ছাড়িয়ে যেতে চাই না। সময়ে সময়ে শেয়ার কেনাবেচা করে সবসময়ই নিট বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখছি।

সৌজন্যে: বণিক বার্তা

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত