মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২
logo

তিস্তার চুক্তি না হওয়ায় সব ম্লান হয়ে গেছে : হেমায়েত উদ্দিন

তিস্তার চুক্তি না হওয়ায় সব ম্লান হয়ে গেছে : হেমায়েত উদ্দিন

ঢাকা, ১২ এপ্রিল, এবিনিউজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আবার তিস্তার মতো বহুপ্রতীক্ষিত চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। একটি দৈনিকে প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত সফরকে তাৎক্ষণিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হেমায়েত উদ্দিন।

প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান দিল্লি সফর নিয়ে আপনার তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন কী? যদিও যখন এই প্রশ্ন করছি, তখনো তাঁর সফর শেষ হয়নি?

হেমায়েত উদ্দিন : বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে পর্যায়ে আছে, অতীতে তা কখনো ছিল না। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভ্যর্থনায়ও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনেকটা নিয়ম ভেঙে যেভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে বিমানবন্দরে ছুটে গিয়েছেন, তা সচরাচর ঘটে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের এই নবযাত্রা সূচিত হয় ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের যে উদ্বেগ ছিল, বাংলাদেশ তার পুরোটি নিরসন করেছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দীর্ঘস্থায়ী ছিটমহল সমস্যারও সমাধান হয়েছে।

দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর ৬২ অনুচ্ছেদের যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দুই দেশের বিদ্যমান সম্পর্ক সুদৃঢ় করার পাশাপাশি সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের নতুন দিগন্ত খোলার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সফর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কেননা স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন, বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি এবং সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে দুই দেশের মধ্যে ট্রেন ও বাস যোগাযোগ সম্প্রসারণ, বিচারিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সহযোগিতা, পরমাণু জ্বালানির বেসামরিক ব্যবহার, সীমান্ত হাট ইত্যাদি সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু এত সব ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও একটি ঘটনাই সবকিছু ম্লান করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনমনীয় অবস্থানের কারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। ভারতের অবস্থান যা–ই হোক না কেন, তিস্তা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর ওপর আমাদের ন্যায্য পাওনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দিতে পারি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যার সমাধানে যে দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন, তা কত দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, আমরা সেদিকেই তাকিয়ে আছি। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও অনুপ্রেরণামূলক।

প্রশ্ন : জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াবে কি না?

হেমায়েত উদ্দিন : আমি এটা মনে করি না যে এ ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারি না। আমাদের নিজেদের জ্বালানি সম্পদ কাজে লাগানোর পাশাপাশি বাইরে থেকে সম্পদ আসারও পথ খোলা রাখতে হবে। ভারতও একইভাবে এই উপমহাদেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এনে কাজে লাগাচ্ছে।

প্রশ্ন : ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের কৌশলগত দক্ষতা বাড়বে বলে মনে করেন কি?

হেমায়েত উদ্দিন : শখ হাসিনার এবারকার ভারত সফরে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কেড়েছে তা হলো, ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারকে সই। প্রতিরক্ষা নিশ্চিতভাবেই একটি স্পর্শকাতর বিষয় এবং এ বিষয়ে যেকোনো নথি বা দলিলে সই স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ বাড়াতে পারে। যা হোক, যে কয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার মধ্যে আমার দৃষ্টিতে পাঁচটিই খুব সাধারণ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি যদি ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, স্টাফ কলেজ ও কোস্টগার্ডের মধ্যে সহযোগিতার বিনিময় হয়, তাহলে এটাও খুবই সাদামাটা ব্যাপার হবে।

বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দুই দেশের সামরিক প্রতিষ্ঠান এমন হবে না, যাতে একটিকে অপরটির প্রতিপক্ষ মনে হতে পারে। বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র এবং আমরা নিজেদের ভারত বা অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে চাইব না। একই সঙ্গে আমাদের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে এবং প্রতিরক্ষার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমাদের থাকবে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমরা আমাদের অপরাজেয়তা প্রমাণ করেছি এবং বন্ধুসুলভ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত না। একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ভারতের ৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা। আশা করি, অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত থাকবে না এবং বাংলাদেশ তার চাহিদামতো যেকোনো দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে।

প্রশ্ন : তিস্তা কি শেষ পর্যন্ত ঝুলে গেল? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত?

হেমায়েত উদ্দিন : ভারত সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তিস্তার পানির সমস্যার সমাধানের আশ্বাস পাওয়ার পরও এ নিয়ে উদ্বেগ শুধু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর জেদ বজায় রাখছেন এবং বিকল্প প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তু এতে তো আমাদের ন্যায্য দাবি মিটবে না। ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তার পানির ভাগ পাওয়াটা আমাদের ন্যায্য দাবি। তাই যদি না হবে, তাহলে বাংলাদেশে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় এ–সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হতো না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা–ই বলুন না কেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা আশা করছি তিনি তা রক্ষা করবেন। (প্রথম আলো)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত