রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo
  • হোম
  • সাক্ষাৎকার
  • রূপকল্প যেন রাজনৈতিক দাবা খেলার ঘুঁটি না হয় : ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

রূপকল্প যেন রাজনৈতিক দাবা খেলার ঘুঁটি না হয় : ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

রূপকল্প যেন রাজনৈতিক দাবা খেলার ঘুঁটি না হয় : ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

ঢাকা, ২০ মে, এবিনিউজ : রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ‘রূপকল্প’। ২০০৮ সালে রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে নির্বাচনে বাজিমাত করেছিল আওয়ামী লীগ। এর বিপরীতে ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ স্লোগানের গতানুগতিক ইশতেহারে তখন ধরাশায়ী হয়েছিল বিএনপি। সেই ভরাডুবি থেকে শিক্ষা নেয়নি দলটি। পরবর্তী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশও নেয়নি বিএনপি। এর মাশুলও দিচ্ছে দলটি। তবে দেরিতে হলেও ভুল বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগের মতো করে ঘোষণা করেছে রূপকল্প ২০৩০। তাদের রূপকল্পে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় ভারসাম্য’ আনার প্রস্তাবটি। অতীতে বড় কোনো রাজনৈতিক দল এমন প্রস্তাব করেনি। এর সঙ্গে এককেন্দ্রিক সংসদীয় ব্যবস্থায় বিএনপি উচ্চকক্ষের পরিকল্পনার কথাও বলেছে। ৩৭টি বিষয়ে ২৫৬টি দফার সমন্বয়ে প্রণীত বিএনপির এই রূপকল্প কতটা বাস্তব ও বাস্তবায়নযোগ্য? এ নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক আলমগীর স্বপন।

প্রশ্ন : নির্বাচনের এখনো প্রায় দেড় বছর বাকি। এর অনেক আগেই বিএনপি ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছে। কীভাবে দেখেন তাদের রূপকল্পকে?

হোসেন জিল্লুর রহমান : বিএনপির সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে এই রূপকল্পকে দেখা যেতে পারে। প্রতিযোগিতামুলক নির্বাচন বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রয়োজন। সকল দলের অংশগ্রহণে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এখন সব মহলেরই চাওয়া। নির্বাচনী সেই লড়াইয়ের প্রতিযোগিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী বিএনপি। এখানে আমার মনে হয় শাসক দল একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তারা দেশের সামনে একটা দিক নির্দেশনা বা কোথায় নিয়ে যেতে হবে দেশকে এর একটা রূপকল্প উপস্থাপন করেছিল। এটা রূপকল্প ২০২১ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই রূপকল্প একটা ইতিবাচক সংযোজন ছিল। এটা প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রলুব্ধ করেছে। দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এর একটা ভিশন দেখাচ্ছে। এখানে বিএনপিও যুক্ত হয়েছে সেটাও ইতিবাচক। অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিযোগী হিসেবে তারাও দেখাতে চায় আগামী দিনের ভিশন। তবে বছরের সীমারেখা, যেমন আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ বা ২০৪১ অথবা বিএনপির ২০৩০ এগুলো হচ্ছে দলগুলোর নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য। আমি মনে করি এখানে বছরের সীমারেখা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে লক্ষ্যগুলো রূপকল্পে উচ্চারিত হয়েছে। এখানে আরো গভীরভাবে পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে। যে রূপকল্প তারা দিয়েছে সেটা কী শুধু একটা কাগুজে প্রচেষ্টা নাকি এর মধ্যে লক্ষ্য বাস্তবায়ণের বিষয় আছে। এখানে ভেতরে কি আছে সেটা দেখার বিষয়।

প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১-এর ৯ বছর পর বিএনপি প্রায় একই ধরনের রূপকল্প দিয়েছে। এর মধ্যে পার্থক্য করতে গেলে কী বলবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে একটা জিনিস খুব চোখে পড়েছে, আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১-এ উন্নয়নের বিষয়টা বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। হয়তো এর সঙ্গত কারণও ছিল তখন। দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নটা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তখন দেখিয়েছিল। আর বিএনপি যে রূপকল্প ২০৩০ দিয়েছে সেখানে কিন্তু সুশাসনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। হয়তো মাঠ বাস্তবতার কারণে এটাই প্রাধান্য পাওয়াটা জরুরি ছিল। যদিও তারাও উন্নয়নের বিষয়টাও বলেছে। মধ্যম আয়ের দেশের কথাও বিএনপি বলেছে।

প্রশ্ন : বিএনপির রূপকল্প ২০৩০-এর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায়’ ভারসাম্য আনার বিষয়টি। আপনি এই প্রস্তাবকে কীভাবে দেখছেন। বিষয়টি নিয়ে এর আগে সুশীল সমাজ সোচ্চার ছিল। যতদূর মনে পড়ে বড় কোনো রাজনৈতিক দল এমন প্রস্তাব কখনও দেয়নি?

হোসেন জিল্লুর রহমান : আমি বলব, বিষয়টিকে আরো বড় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য হিসেবে দেখল হয়তো পুরো জিনিসটাকে দেখা হবে না। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য দরকার, শুধু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য না। ক্ষমতার ভারসাম্যের মধ্যে আমি কমপক্ষে তিনটি মাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বিএনপির রূপকল্পের একটি জায়গায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় এককেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের ভেতরে তো বটে মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদের অবস্থানটা যদি দেখি, এর সত্যতা আছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বলয়টাকে একটু ভারসাম্যের জায়গায় নিয়ে আসাটা অন্যতম বিষয়। কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হলে আরো দুটি বিষয়কে সমগুরুত্ব দিতে হবে। এর একটি হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা নিয়ে এখন কথাবার্তা হচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য অন্যতম একটি স্তম্ভ হিসেবে দেখতে হবে।

প্রশ্ন : ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপের কথা বলছিলেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : সে বিষয়েই আসছি। তৃতীয় আরেকটি জিনিস আছে যেটা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে আলোচনা কম আবার বিএনপি যে ভিশন দিয়েছে সেখানেও বিষয়টি সেভাবে আসেনি। সেটা হচ্ছে স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা বলতে একেবারে স্বাধীন করে দেয়া সেটা বলছি না। এখন বাস্তবতা হচ্ছে স্থানীয় সরকার এমপিদের ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে একটা অধস্তন সংস্থা হিসেবে পরিণত হয়েছে। স্বশাসিত এবং তৃণমূলের প্রতিনিধিত্বকারী ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার এটাও কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্যের একটা অন্যতম স্তম্ভ। বিএনপির ভিশনের মধ্যে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা কিছুটা বলা আছে। কিন্তু তা ক্ষুদ্রভাবে এসেছে। এখানে বলতে চাই, স্থানীয় সরকার একটি মৌলিক জায়গা, এটা খাতওয়ারি কোনো জায়গা না। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় আরো ভারসাম্য আনা মানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকারকে আরো স্বশাসিত করা। এসব যদি করা যায় তাহলেই ক্ষমতায় ভারসাম্য আসবে। তাই আলোচনাটা হতে হবে ক্ষমতার ভারসাম্য, শুধু প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় ভারসাম্য না।

প্রশ্ন : অনেকের অভিযোগ ‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য’ নিয়ে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে তা অস্পষ্ট ?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এটা স্পষ্টের বিষয় না। একটা ডকুমেন্টে সবই সুস্পষ্ট করতে হবে এ রকম কোনো কথা নেই। মূল বিষয় হলো লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও জন চাহিদার জায়গা থেকে একে আরো শানিত করা। এখন আমরা ভিশন দিয়ে দিয়েছি, সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব- এ রকম আপ্তবাক্য আউড়িয়ে কাজ করা বিএনপির উচিত হবে না। এটাকে একটা প্রস্তাব হিসেবে চিন্তা করে জনগণের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনার ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে দলটিকে তাদের উপস্থাপিত রূপকল্পকে আরো পরিবর্ধন, পরিমার্জন করে উন্নত একটা অ্যাকশন প্লান হিসেবে তৈরি করতে হবে।

প্রশ্ন : আমাদের দেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা স্বপ্ন দেখানো হয়, রূপকল্প দেয়া হয়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সেসব প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই ‘কল্প’ হিসেবেই থেকে যায়? তাই ঘর পোড়া সিঁদুরে মেঘ দেখলে যেমন ভয় পায়, তেমনি বিএনপির রূপকল্প নিয়েও জনগণের আস্থার সংকট রয়েছে ?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে দুটো জিনিস আছে। একটা হচ্ছে ভিশন দেয়া। আর একটা হচ্ছে এই ভিশন অনুযায়ী চালিত হওয়া এবং এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া। এক্ষেত্রে জনমনে আস্থা তৈরি করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ভিশন দিয়েছেন একটা পদক্ষেপ কিন্তু জনমনে আস্থা তৈরি করতে হবে যে এগুলো কোনো কাগুজে ব্যাপার নয়। শুধু রাজনৈতিক দাবাখেলায় এগিয়ে থাকার জন্য একটা পদক্ষেপ হিসেবে রূপকল্প দেয়া হয়নি এটা প্রমাণ করতে হবে। রাজনৈতিক দাবা খেলায় অন্য দল ভিশন দিয়েছে, আমরাও একটা দিয়ে দিলাম-এইভাবে যদি দেখা হয় তাহলে ঠিক হবে না। রূপকল্প ঘোষণাকে জনমনে আস্থা তৈরি করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে হবে। আস্থা তৈরি করতে হলে এই বিষয়ে ব্যাপক আকারে একটা জাতীয় আলোচনা শুরূ করা যেতে পারে। সেই আলোচনা শুধু বিএনপির প্রয়োজনে নয়। এই আলোচনা সব দলেই প্রয়োজন। কারণ বিষয় হলো ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া-এগুলো কোনো একটা দলের বিষয় না। এটা সব দলের বিষয় এবং সর্বোপরি জনগণের বিষয়। এগুলো নিয়ে একটা বড় ধরনের আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা, এ নিয়ে দলটি এখনো অবস্থান পরিষ্কার করেনি। কিন্তু ভিশন-২০৩০ ইঙ্গিত দিচ্ছে দলটির নির্বাচনী প্রস্তুতির ?

হোসেন জিল্লুর রহমান : বিএনপির রূপকল্প-২০৩০ হলেও আগামী নির্বাচনই তাদের লক্ষ্য। আগামী নির্বাচন যদি অর্থবহ বিশ্বাসযোগ্য হতে হয়, তাহলে বিএনপিকে অংশগ্রহণ করতে হবে। কারণ তারা দেশের অন্যতম একটি বড় দল। তবে এই নির্বাচনকে অর্থবহ এবং বিশ্বাসযোগ্য করার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক করা দায়িত্ব কিন্তু ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের। এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাই বড়।

প্রশ্ন : এক্ষেত্রে ২০১৪ সালের অভিজ্ঞতা সবারই জানা। বিএনপি তখন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে। আবার আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেই জায়গা থেকে দুই দলের কথাবার্তায় এবার অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের আবহ দেখছেন কি?

হোসেন জিল্লুর রহমান : বিএনপি তার অতীত অবস্থান থেকে সড়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের ঘোষিত রূপকল্পকে আগামী নির্বাচনের ইশতেহারও বলা যেতে পারে। তবে আমি যেটা বলব, শুধু নিছক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা না করে ভিশনের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে একটা বৃহৎ আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। ক্ষমতার রাজনীতির নির্বাচন নয়, নির্বাচনের মাধ্যমে জনচাহিদাগুলো আরো প্রতিফলিত করতে হবে। তা না হলে, এটা নিছক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দাবা খেলা, গুটি চালাচালি হিসেবে চিহ্নিত হবে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের কিছু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে আমি যেটা বারবার বলার চেষ্টা করছি যে, নির্বাচনের মাধ্যমে পুরো বিষয়টাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে এবং এতে জনগণের এক ধরনের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত