
ঢাকা, ২৩ মে, এবিনিউজ : ফারুক চৌধুরী। একজন দক্ষ ও পেশাদার কূটনীতিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছেন। দেশ-বিদেশ সফর করেছেন একসঙ্গে। অনেক কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে। আবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে। ১৯৭৫-এ তিনি লন্ডনে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৬ সালের আগস্টে দেয়া সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট আপনি কোথায় ছিলেন? কীভাবে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের খবর পেলেন?
আমি সে সময় লন্ডনের ডেপুটি হাইকমিশনার। তখন লন্ডনে ভোর। আমার বিছানার পাশের ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে বলছিলেন, ‘এটা কি মিস্টার চৌধুরী?’ আমি ‘ইয়েস’ বলার পর ওপাশ থেকে বলা হলো, ‘আমি বিবিসি থেকে বলছি। আপনাকে একটা খারাপ খবর দেয়ার আছে, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছেন।’ প্রথমে আমার কথাটি বিশ্বাস হয়নি। তবে বিবিসির ওই সাংবাদিকের সঙ্গে আরো বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর নিশ্চিত হই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক, নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটে গেছে।
এর পর কী করলেন?
খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও আসলে ঘটনাটি আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। এরপর বিষয়টি আমি দূতাবাসের অন্য কর্মকর্তাদের জানাই। তাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়। সে সময় আমার মাথায় ছিল বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনার কথা। তারা দুজন তখন ইউরোপে ছিলেন। বর্বর এ হত্যাকাণ্ড থেকে তারা যে বেঁচে গেছেন, বিষয়টি ভেবে একটু হলেও আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার অনেক স্মৃতি, অনেক কাজ, অনেক দেশ সফর করেছেন। আপনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শেষ কথা কী হয়েছিল?
সাড়ে তিনটি ঘটনাবহুল বছরে আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছি। উষ্ণ, সাহসী, হূদয়বান মানুষটিকে দেখেছি অনেক কাছ থেকে। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ৬ মে ১৯৭৫, জ্যামাইকার কিংসটনে। এটা ছিল কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। সে সময়ের একটা বিশেষ স্মৃতি আজো আমার মনে পড়ে। আমরা ছিলাম প্যাগাসাস হোটেলে। ওই হোটেলে বঙ্গবন্ধুর স্যুটে গিয়ে তাকে বললাম, ‘আমার মেয়ে একটা ক্যামেরা দিয়েছে আপনার ছবি তোলার জন্য।’ বঙ্গবন্ধু খুবই উত্সাহিত হয়ে বললেন, ‘আরে তোলো তোলো। তোমার মেয়ে বলে কথা। চলো বাইরে যাই, তোমার ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ নেই। বাইরে ভালো ছবি উঠবে।’ তখন তিনি আরো বললেন, ‘তোমার মেয়েকে বলো, শেখ মুজিবের প্যান্ট-শার্ট পরা ছবি খুব কম, যার একটা তোমার মেয়ের জন্য তোলা।’ সেদিন তার ছবি তুলতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, আমি তার অধস্তন কোনো কর্মচারী নই, বরং একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
কয়েক দিন ধরেই আমরা ছিলাম শোকাহত। দেশে কী ঘটছে, দেশের পরিস্থিতি কী, সে বিষয়ে আমরা বিস্তারিত কিছু জানতে পারছিলাম না। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া না জানালেও আমরা দূতাবাসে শোকাহত মানুষের চিঠি পাচ্ছিলাম। তেমনি এক চিঠিতে ব্রিটেনের এক সাধারণ নাগরিক লিখেছিলেন, তিনি রাজনীতি ভালো বোঝেন না। তার পরও তিনি জানতে চান কেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো? কেন তার শিশুপুত্র রাসেলকে হত্যা করা হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা ছিল না। এ চিঠিগুলো আমাদের শোক, হতাশা আর অপরাধবোধ শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবের অত্যন্ত উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। এ ঘটনা ইন্দিরা গান্ধী কীভাবে নিয়েছিলেন? ভারতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানতে পেরেছিলেন?
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে র’ তথা ভারতের বেশ তত্পরতা ছিল। যত দূর জানি, বঙ্গবন্ধু বিষয়টি ভালো চোখে দেখতেন না। ভারতীয় কূটনৈতিক বন্ধুদের কাছ থেকে জানা তথ্য থেকে বলতে পারি, তিনি ’৭৫-এর শুরুতে ভারতীয় শীর্ষ নেতাদের ঢাকায় র’-এর তত্পরতা বন্ধের কথা বলেছিলেন। এর পরই ভারত ঢাকায় তাদের গোয়েন্দা তত্পরতা কমিয়ে দেয়। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ভারতীয়রা কতটুকু জানত বা তারা বঙ্গবন্ধুকে কতটা সতর্ক করতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ইন্দিরা গান্ধীর মনোভাব কেমন ছিল, তার খানিকটা আমি জেনেছিলাম আমার বন্ধু ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জিতেন্দ্রনাথ দীক্ষিতের (জেএন দীক্ষিত নামে পরিচিত) কাছ থেকে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। খোঁজখবর নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও রেহেনার। পরে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্য তিনি কতটা করেছেন, তা সবারই জানা।
এতে পাকিস্তান বা ভুট্টোর দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তান বা ধূর্ত ভুট্টো যে খুশি হয়েছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে এ হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানের খুব বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না। নতুন করে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠন ছিল একেবারেই অবাস্তব, অযৌক্তিক চিন্তা। যদিও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্ব এমনটা আশা করেছিলেন বলে শোনা যায়। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের কর্মকাণ্ডে কিছু পাকিস্তানি লক্ষণ ধরা পড়ে (বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা, বেতার বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন, টুপিকে জাতীয় পোশাক ঘোষণা ইত্যাদি)। তবে পাকিস্তানিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মোশতাক কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেননি। তখনকার বাস্তবতায় সেটা সম্ভবও ছিল না।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এটা শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বের ইতিহাসে এক নিষ্ঠুর ঘটনা। এর আগেও অনেক দেশে ক্যু হয়েছে। অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা বদল হয়েছে। কিন্তু এত রক্তপাতের ইতিহাস নেই বললেই চলে। বলশেভিক বিপ্লবের সময় দ্বিতীয় জার নিকোলাস সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডে বিশেষ করে শিশুপুত্র রাসেলকে হত্যা করা সারা বিশ্বে বাঙালিদের এক নিষ্ঠুর ও নৃশংস জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম এক খুনি জাতি হিসেবে। এটা আমাদের জন্য ছিল বড় লজ্জার। এছাড়া খুনিদের আস্ফাালন আর বিচারহীনতা আরো এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। যদিও খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে তার কলঙ্ক কিছুটা হলেও মোচন হয়েছে।
সৌজন্যে: বণিক বার্তা