রবিবার, ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩১
logo

‘প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি’

‘প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি’

ঢাকা, ২৭ জুলাই, এবিনিউজ : দেশের ৫৭তম ব্যাংক সীমান্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মুখলেসুর রহমান। ৩২ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে এর আগে কাজ করেছেন এনআরবি, ইবিএল, ইউসিবি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে। সীমান্ত ব্যাংকসহ সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন তিনি।

সীমান্ত ব্যাংক কেন?

বিজিবি হলো সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী। দেশের পুরো সীমান্তই তারা পাহারা দিচ্ছে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংক নেই। এসব এলাকায় কর্মরত সদস্যদের বেতন নেয়ার সময় নগদ অর্থে বেতন নিতে হতো। এর ফলে তাদের সঞ্চয় হতো না। তাদের বেতন যদি ১০ হাজার টাকাও হয় এবং সে টাকা যদি তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেন, তাহলে হয়তো অন্তত ১ হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে রেখে দিতেন। এটা তাদের একটা সঞ্চয় হতো। কিন্তু ব্যাংক না থাকায় সে সঞ্চয়প্রবণতাটি তৈরি হচ্ছিল না। আরেকটি বিষয় হলো, সারা বাংলাদেশে বিজিবির প্রায় সাড়ে আটশর মতো বিওপি (বর্ডার আউটপোস্ট) রয়েছে। সেখানে কোনো আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নেই। সেখানে মানুষকে পরিচালিত করছে বিভিন্ন এনজিও বা সরকারি দু-একটা ব্যাংক। সীমান্ত ব্যাংকের পক্ষে তদানীন্তন ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজিজ আহমেদ, বর্তমান ডিজি মেজর জেনারেল আবুল হোসেন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিন্তা করেছিলেন যে, সীমান্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি তৈরি হবে, আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারব। বিভিন্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এক্ষেত্রে যেহেতু বিজিবির অফিস আছে, লোকবল আছে, তাই সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টও আমরা খুব সহজেই পাব। সৈনিকরা যারা এত দিন আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ছিলেন না, তারা বাড়ি নির্মাণ, জমি ক্রয় বা অবসরের পর ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে ঋণ সুবিধা পেতেন না। এসব বিবেচনা থেকেই তাদের আর্থিক উন্নতি ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্যই সীমান্ত ব্যাংক।

তাহলে আপনাদের বেশির ভাগ শাখাই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় হচ্ছে?

আমরা শহরেও ব্যাংকের শাখা রাখব। এক্ষেত্রে ঋণ সুবিধা ও ব্র্যান্ড ইমেজেরও একটি ব্যাপার রয়েছে। সাধারণ মানুষ যেন এ ব্যাংককে চিনতে পারে। কেউ যেন না ভাবে এটা শুধু বিজিবির ব্যাংক। এটা একটা তফসিলি ব্যাংক। ট্রাস্ট ব্যাংক যেমন শুধু আর্মিদের ব্যাংক নয়, তেমনি সীমান্ত ব্যাংকও শুধু বিজিবির নয়। এ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো, রিটেইল ব্যাংকিং ও এসএমই ব্যাংকিংয়ে ফোকাস করা। কোর ব্যাংকিংও করা হবে ব্যাংকের মুনাফার জন্য, তবে সেটা ক্ষুদ্র পরিসরে। আমাদের মূল লক্ষ্যই থাকবে অটোমেশনের মাধ্যমে রিটেইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড ও এসএমই ব্যাংকিং। আমরা প্রযুক্তির দিকটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলে দিয়েছেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে যতটা অটোমেশন করা সম্ভব, তার সবটুকুই যেন করা হয়। ব্যাংকে গিয়ে সময় নষ্ট না করে স্মার্টফোন বা টেলিফোনের মাধ্যমে যতটা সমৃদ্ধ প্রযুক্তিতে ব্যাংকিং সেবা দেয়া যায়, আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।

ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন?

আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংকের শাখা বৃদ্ধি করা। শাখা খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নীতিমালা রয়েছে, সেটি হলো ১ অনুপাত ১। অর্থাৎ আমাকে শহরে একটি শাখা করতে হলে একই সঙ্গে গ্রামীণ এলাকায়ও একটি শাখা করতে হবে। কেউ যদি গ্রামাঞ্চল থেকে ঢাকায় অথবা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো আত্মীয়ের কাছে টাকা পাঠাতে চান, সেক্ষেত্রে অবশ্যই জেলা শহরগুলোর পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাগুলোয়ও শাখা প্রয়োজন হবে। আমরা এ পর্যন্ত চারটি শাখা করেছি। তার মধ্যে ঢাকায় একটি প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চ, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে একটি করে মোট তিনটি জেলা শহর পর্যায়ে ও একটি সাতকানিয়ায় গ্রামীণ এলাকায় করেছি। আগামীতে মতিঝিল, মিরপুর, বেনাপোলসহ আরো চার-পাঁচটি অঞ্চলে শাখা খুলে ফেলব ইনশাআল্লাহ। আমাদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে মানবসম্পদ ব্যবহার করা। ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। বিবিএ, এমবিএ ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমাপ্ত করে যখন কেউ চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে বসেন ও তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আজকের পত্রিকা পড়েছেন কিনা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক উত্তর পাওয়া যায়। একজন শিক্ষার্থী যদি সাম্প্রতিক বিষয়াদির ধারণা না রাখেন, তাহলে ব্যাংকিং খাতে প্রবেশ করে কী অবদান রাখবেন? তিনি যদি ব্যাংকিং নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাহলে তাকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং কাঠামো, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।

আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের ওপর। এগুলো কোনো খরচের খাতায় যায় না। এটা হলো বিনিয়োগ। আমরা যেহেতু একটি আধুনিক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সেহেতু আমাদেরকে ডেবিট-ক্রেডিট ব্যাংকিং নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। আমাদেরকে মডার্ন ফিন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট আনতে হবে, টেইলর মেড প্রডাক্ট আনতে হবে। এগুলোর জন্য জ্ঞান থাকতে হবে, দক্ষতা থাকতে হবে। এ বিষয়গুলোর ঘাটতি আমরা উপলব্ধি করছি।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান সংকট কীভাবে মোকাবেলা করবেন বলে ঠিক করেছেন?

সংকট তো আসলে আমাদের একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তবে আমি আমার ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা থেকে বলব, আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো হলো খেলাপি ঋণ, দক্ষ মানবসম্পদ ও ভালো পরিচালনা পর্ষদ। বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো চলতে চায়। অনেক ব্যাংকে দেখা যায় বোর্ড এমডিকে কোনো স্বাধীনতা দেয় না। এমন ব্যাংকও আছে, যেখানে একজন পিয়নের নিয়োগ হয় চেয়ারম্যানের হাত দিয়ে। যেখানে বোর্ড মিটিং ছাড়া চেয়ারম্যানের ব্যাংকে আসার দরকারই হয় না, সেখানে এমডির পাশের চেম্বারে বসে চেয়ারম্যানকে সকাল-সন্ধ্যা অফিসও করতে দেখা যায়। নতুন ব্যাংকে কেন উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন হচ্ছে? যেখানে বিধান হলো, যেসব ব্যাংকের পোর্টফোলিও নেতিবাচক বা ব্যাংকে অরাজকতা হচ্ছে, সেখানে একজন অভিজ্ঞ উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন হয়। ব্যাংকের উপদেষ্টা বা ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর নিয়োগের ক্ষেত্রেও স্বজনপ্রীতি দেখা যাচ্ছে। এগুলো কাম্য নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের, কিন্তু সেখানে এগুলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো স্বাধীনতা নেই সেখানে। এর মধ্যে আবার পরিবারতন্ত্র কায়েম করা হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরে। এটি মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত কয়েক বছরে লক্ষণীয় নিয়ন্ত্রণ এনেছে। তারা অনেক বিষয়ে অটোমেশন করে ফেলেছে। আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। তবে পেছনে না তাকিয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে চাই। ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমরা খারাপ নেই, তবে এখনই লাগাম টেনে ধরার সময়। ঊর্ধ্বমুখী অর্থনীতিতে কিছু নেতিবাচক প্রভাব থাকবে, দুর্নীতি থাকবে। এগুলো রোধে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মিডিয়া এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যায় বলে মনে করেন?

ইতিহাসের কথা বললে ১৯৭২ সাল থেকেই এ খেলাপি ঋণের শুরু। খেলাপি ঋণের কারণ হিসেবে আমি পর্যবেক্ষণের অভাবকেই দায়ী করব। ব্যাংকিং খাতে যেকোনো অপরাধের পেছনে ব্যাংকারের অজ্ঞতা অথবা সহযোগিতা এর যেকোনো একটি দায়ী। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখতে হবে যিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন, তার ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট কেমন, তার ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য আছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ গার্মেন্টস তৈরির জন্য কেউ যদি ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিতে আসেন, তাহলে প্রথমেই দেখা উচিত তার উদ্যোক্তাজ্ঞান আছে কিনা, অফিস ম্যানেজমেন্ট বোঝেন কিনা, এক্সপোর্ট- ইমপোর্ট সম্পর্কে কতটুকু ধারণা রাখেন, গার্মেন্টস খাতে তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কেমন প্রভৃতি। সমস্যা সমাধানে প্রথম কাজই হলো বোর্ডকে শক্ত হতে হবে। ব্যাংক প্রশাসনকে শক্ত হতে হবে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

ব্যাংকের শোভাবর্ধনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

এটা মূলত বেসরকারি ব্যাংকগুলো যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন থেকেই দেখা যাচ্ছে। তারা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই একটু শোভাবর্ধনের দিকে নজর দিয়েছিল। পরবর্তীতে এ প্রবণতা ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। কোনো অফিস শুরু করার ক্ষেত্রে এ প্রবণতা শুভ লক্ষণ নয়। আর্থিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ এনে প্রযুক্তি ও জনশক্তি খাতে জোর দেয়া উচিত।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা পুরো ব্যাংকিং খাতে কোনো প্রভাব ফেলছে কিনা?

আমি মনে করি অবশ্যই ফেলছে। এর কারণ হিসেবে বলব, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধে নানা বাহানা তৈরির সুযোগ থাকলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা থাকে না। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে গ্রহীতাদের একটি সাহস তৈরি হয়ে যায়। এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। সামাজিকভাবেও এর প্রভাব পড়ছে।

সূত্র: বণিক বার্তা

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত