
ঢাকা, আগস্ট, এবিনিউজ : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির মহাসচিব। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি কৃষি, পর্যটন ও বেসরকারি বিমান চলাচলবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিএনপির শীর্ষ এ নেতা কথা বলেছেন সাম্প্রতিক রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে। এতে এসেছে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের দলের অবস্থানের বিষয়টিও। দলীয় কোন্দল, জামায়াতের সঙ্গে জোট ও ভিশন ২০৩০ নিয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক আলমগীর স্বপন।
আলমগীর স্বপন : প্রায় দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে বিএনপি ভিশন ২০৩০ দিয়েছে। এ নিয়ে আপনাদের মাঠপর্যায়ে যাওয়ার কথা ছিল। কতটা যেতে পেরেছেন?
মির্জা ফখরুল : আমাদের সম্মেলনেই দলের চেয়ারপারসন ভিশন ২০৩০-এর একটা রূপরেখা দিয়েছিলেন। এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল, বিএনপি ২০৩০ সালের মধ্যে কীভাবে, কেমন বাংলাদেশকে দেখতে চায়, দেখাতে চায়। এর একটা ধারণাই আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি। পূর্ণাঙ্গ একটি রূপরেখার মধ্য দিয়ে সেটা তুলে ধরা হয়েছে। এটা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমরা শুধু ওই প্রেস কনফারেন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিনি। বই আকারে প্রিন্ট করে দেশের প্রায় সবগুলো জেলা-উপজেলায় পাঠাচ্ছি। আমরা এটার ওপরে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন করছি। এর পর আমরা প্রতিটি জেলা হেডকোয়ার্টারে এ বিষয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করব। দেশনেত্রী কিন্তু ভিশন ২০৩০-এর প্রস্তাবেই বলেছেন, আমরা এটা জনগণের সামনে তুলে ধরছি। আশা করি যে, জনগণ তাদের মত জানাবেন এবং এরপর আমরা যেটা বিশ্বাস করি এর সঙ্গে মিলিয়ে সেই সব মতামত অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করব।
আলমগীর স্বপন : ভিশন ২০৩০-এ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার দুটি প্রস্তাব নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। ভিশনে আপনার বিষয় দুটি তুলে ধরলেও তা স্পষ্ট নয় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।
মির্জা ফখরুল : দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ সম্পর্কে আমরা বলেছি যে, এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিষয় আছে। অর্থাৎ এখানে বিভিন্ন মতামত নেয়া হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতামত নেয়া হবে। পার্লামেন্টারিয়ান যারা আছেন তাদের মতামত নেয়া হবে। সুশীল সমাজের যারা আছেন, যারা দেশ ও সমাজ সম্পর্কে চিন্তা করেন তাদের মতামত নেয়া হবে। এই মতামতগুলো নিয়ে আমরা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ধারণাটি চূড়ান্ত করব। বাংলাদেশে এখন এককেন্দ্রিক সরকার এবং এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদ আছে। এটাকে আরও উন্নত করার জন্য, আরেকটু ভারসাম্য আনার জন্য আরেকটা হাউস বা কক্ষ যদি তৈরি করা যায়, সেখানে সমাজের সব স্তরের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তা হলে সেটা অনেক সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে। সে জন্যই কিন্তু আমাদের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব। এ বিষয়ে মতামত নেয়া এরই মধ্যে শুরু করেছি আমরা।
আলমগীর স্বপন : প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার প্রস্তাবও দিয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে আলোচনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় এই প্রস্তাবকে অনেকে গুরুত্বসহকারে দেখছে।
মির্জা ফখরুল : প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিষয়টি আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছি। আমরা দেখেছি যে, আমাদের সিস্টেমটা এমন হয়ে গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী ব্যাক্তি হিসেবেই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে যান। বর্তমান সরকারের আমলে আমরা এটা বেশি করে উপলব্ধি করছি। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে আনা যায় সে বিষয়েও আমরা মতামত চাচ্ছি। এর ভিত্তিতেই আমরা এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেব।
আলমগীর স্বপন : অনেকেই সমালোচনা করছেন যে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কখনো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলেনি।
মির্জা ফখরুল : আগে না বললে যে এখন বলতে পারব না এমন কোনো কথা নেই। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এটা বলছি। আমরা আমাদের অতীতের অবস্থান বিবেচনা করেই বলছি যে, এটা করা দরকার। সব সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে হবে। আগে কী হয়েছে, সেটা চিন্তা করলে হবে না। ৩০ বছর আগে যেটা ছিল, সেটা বা যদি বলি আওয়ামী লীগ এখন তা হলে বাকশালের কথা বলছে না কেন? কারণ তারা জানেই যে, এখন বাকশাল বললে লাভ হবে না। কেউ গ্রহণ করবে না। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কেউ গ্রহণ করবে না। যদিও ওই বিষয়টা এখন আড়াল করে তারা একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার চাপিয়ে দিয়েছে।
আলমগীর স্বপন : আপনি কর্তৃত্ববাদী শাসনের কথা বলছেন। এ অবস্থায় রাজনীতিতে বিএনপির চ্যালেঞ্জ অনেক?
মির্জা ফখরুল : দেশে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা প্রধান চ্যালেঞ্জ। একটা নির্বাচন, যে নির্বাচনটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। যে নির্বাচনে জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারবে, সব দল অংশগ্রহণ করতে পারবে। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত করা, এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বিএনপির সামনে।
আলমগীর স্বপন : বিএনপি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত?
মির্জা ফখরুল : সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে, চ্যালেঞ্জ তো সেই জন্যই। মোকাবিলা করে পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। বিএনপি যে বৈরী একটা পরিবেশের মধ্যে রাজনীতি করছে এখন তার চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা পর্যন্ত মামলায় জর্জরিত হয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপিকে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনা ও তা কার্যকর করাই বিএনপির চ্যালেঞ্জ।
আলমগীর স্বপন : নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই কমিশনের যে ভূমিকা তা কীভাবে দেখছেন। তারা রোডম্যাপও দিয়েছে। সামনে কি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন?
মির্জা ফখরুল : এর সম্ভাবনা খুবই কম বলে আমরা মনে করি। কারণ এই নির্বাচন কমিশন যেভাবে তৈরি হয়েছে এর প্রক্রিয়াটাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম নির্বাচন কমিশন তৈরি করার আগে, সেই প্রস্তাবের আশপাশ দিয়েও ওনারা যাননি। আমরা নিরপেক্ষ প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা নিরপেক্ষতার মধ্যে থাকেননি। আমরা দেখলাম তারা যাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিলেন তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে বলা যায়, তিনি পুরোপুরিভাবে একজন দলীয় মতামতের মধ্য থেকে উঠে আসা মানুষ। সেখানে সে নিরপেক্ষ হবে কি করে? তাই এই নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। আপনাকে নির্বাচনে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করতে হবে। পথটা তৈরি করতে হবে, রোডটা তৈরি করতে হবে। তার পর না রোডম্যাপ। আপনি সব দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে পারছেন কিনা? সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা? নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা? আপনার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়েছে কিনা? এরপরই তারা কখন কী করবে এর ম্যাপ তৈরি করবে। এটা এখন তাদের দায়িত্ব, তারা কী করবে?
আলমগীর স্বপন : রোডম্যাপ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শুরু হয়েছে। আপনাদের আস্থা নেই এই নির্বাচন কমিশনে। এই কমিশন যদি বিএনপিকে সংলাপে ডাকে তা হলে কি যাবেন?
মির্জা ফখরুল : ভালো কথা। অবশ্যই অংশগ্রহণ করব। আমরা ইতিবাচক রাজনীতি করি। এরই মধ্যে আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। ইভিএম নিয়ে বিএনপির প্রতিনিধি গিয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। তখন তারা বলেছে, কোনো দল যদি না চায় তা হলে তারা আগামী নির্বাচনে ইভিএম চালু করবে না। বিএনপি এর আগেই বলে দিয়েছে আমরা ইভিএমে নির্বাচনে যাব না। এই পরিপ্রেক্ষিতে তারা যদি আলোচনায় ডাকে আমরা যাব। কিন্তু মূল বিষয়টির সমাধান করতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় কী রকম সরকার থাকবে, এর সমাধান করতে হবে।
আলমগীর স্বপন : আপনাদের সব কর্মসূচিতেই এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি। এর রূপরেখাটা কী হবে?
মির্জা ফখরুল : এর রূপরেখাটা বিএনপি চেয়ারপারসন লন্ডন সফর থেকে ফিরলে দেয়া হবে। সেই সময়ে আশা করছি আমরা এর পূর্ণাঙ্গ একটা রূপরেখা দিতে পারব। বক্তব্যটা হলো পরিষ্কার- নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে এমন একটা সরকার দরকার। এখন যদি সরকার নিরপেক্ষ না হয় তা হলে তো সেটা হবে না। সে জন্য আমাদের মূল কথাটাই হচ্ছে, নির্বাচনের সময়টাতে আমরা নিরপেক্ষ সরকার চাই। যে সরকার নির্বাচন কমিশনকে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সাহায্য করবে।
আলমগীর স্বপন : এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিষয়টিকেও কি আপনারা সহায়ক সরকারের রূপরেখায় গুরুত্ব দেবেন?
মির্জা ফখরুল : রূপরেখা দিলেই দেখতে পারবেন আপনারা।
আলমগীর স্বপন : কিন্তু সরকার বলছে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার বলে কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী সব কিছু হবে।
মির্জা ফখরুল : সংবিধান তারা তৈরি করেছে। সংবিধানের যে পরিবর্তন ও সংশোধন তারা করেছে, এটা নিয়ে কোনো গণভোট হয়নি। যে সংসদে সংশোধনী পাস হয়েছে, সেই সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। সুতরাং সংবিধানের পরিবর্তিত অংশগুলো জনগণের স্বীকৃত অংশ নয়।
আলমগীর স্বপন : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি চেয়ারপারসন রাজি হননি। এবার তাই মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব নেই সরকারের পক্ষ থেকে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এমন কথাই বলেছেন। এক্ষেত্রে এবার বিএনপির কৌশল কী হবে। কী করবেন আপনারা?
মির্জা ফখরুল : তারা এবারও আগের মতো নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিবে কিনা- এটা হাইপোথিসিস। আমরা এখন বলছি এটা করা উচিত। এটাতেই আসা উচিত। এটাতেই জাতির ভালো হবে, কল্যাণ হবে। দেশে সংঘাত হবে না। দেশে পারস্পরিক বিভেদের জায়গাটা কমে আসবে। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের রাজনীতি থাকবে না। সেটা যদি না করে তা হলে বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ সেটাই চায়, বিভাজন চায়। একা নির্বাচন করতে চায়। তারা বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতে দিতে চায় না। তা হলে তাদের কথার আর কোনো মূল্য থাকে না। আপনি আমাকে হয়তো কিছুদিন হয়রানি করতে পারবেন, কিন্তু সারাজীবন পারবেন না। জনগণ এগুলো টিকতে দেবে না।
আলমগীর স্বপন : আপনারা যে শক্তিতে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন-এতেই বিভাজনের খবর আসছে মাঝে মাঝে। গুজব আছে বিএনপি ভেঙে যাচ্ছে, কিছু সিনিয়র নেতা বিএনপির নামে দল গঠন করে নির্বাচনে যাবেন?
মির্জা ফখরুল : বিএনপির মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। এখন পর্যন্ত বিএনপির একটা লোককেও তারা টানতে পেরেছে? একটা লোককে সরিয়ে নিতে পেরেছে? একটাও না। সুতরাং এগুলো হচ্ছে প্রোপাগান্ডা। মিডিয়াও এগুলোতে ভালোই সাড়া দেয়। মার্কেটিংটা ভালো হয়। সেদিক থেকে আমি মনে করি, এগুলো হচ্ছে অমুলক। আমাদের বিএনপির মধ্যে কোনো বিভাজনই নেই। এই ব্যাপারে আমরা সবাই একমত, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ আছে।
আলমগীর স্বপন : বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের কি সামনে আরও সম্প্রসারণ হবে? এক্ষেত্রে আপনারা কোন কৌশলে এগোচ্ছেন?
মির্জা ফখরুল : এটা যে কোনো সময় হতে পারে। আমাদের উন্মুক্ত ঘোষণা আছে যে, কোনো ব্যাক্তি, সংগঠন বা দল যে কোনো সময় আমাদের আন্দোলনে যোগ দিতে পারেন।
আলমগীর স্বপন : জোটের শরিক না হলেও বিকল্প ধারা, এলডিপিসহ কিছু দল আপনাদের কর্মসূচিতে থাকছেন। তারা কি সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাদের জোটে যোগ দিচ্ছে?
মির্জা ফখরুল : এটা তাদের সিদ্ধান্তর ওপর নির্ভর করবে। আমাদের জোটেও আসতে পারে। তারা অন্যভাবেও সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। তবে এটা তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। আমরা আহ্বান জানিয়েছি।
আলমগীর স্বপন : জাতীয় পার্টি সরকারের শরিক আবার বিরোধী দলও। এবার দলটির নেতৃত্বে আলাদা জোটও গঠিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সামনে আসলে বড় দুই দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জাতীয় পার্টি। তাদের প্রতিও কি আপনাদের জোটে আসার আহ্বান থাকবে?
মির্জা ফখরুল : এরশাদ সাহেবের ব্যাপারে আমি খুব বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ উনি আনপ্রেডিক্টেবল। ওনার রাজনীতির কোনো নীতি নেই। নীতি ছাড়াই রাজনীতি করেন। ক্ষমতার যেখানে সুবিধা আছে, সেখানেই উনি দৌড় দেবেন। সেটা প্রথম থেকেই করে আসছেন তিনি। সেদিক থেকে কিন্তু তিনি মাস্টার প্লেয়ার। এটা স্বীকার করতেই হবে। উনি যে সারভাইভ করছেন এটাই আমার কাছে অবাক লাগে। সারভাইভ করছেন অবশ্য আওয়ামী লীগের জন্য। আওয়ামী লীগই তাকে নিজের স্বার্থেই টিকিয়ে রেখেছে।
আলমগীর স্বপন : অতীতে জাতীয় পার্টিকে জোটে টানার বা দলটির সঙ্গে দরকষাকষি করার ইতিহাস বিএনপিরও আছে।
মির্জা ফখরুল : আমরা বলেছি, ভবিষ্যতে এই সরকারের বিরুদ্ধে যে কেউ আন্দোলন করতে চায় বা অবস্থান নিতে চায় তাদের জন্য আমাদের দুয়ার সবসময় খোলা।
আলমগীর স্বপন : ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত। তাদের নিবন্ধন নেই। কেউ কেউ বলছে এবার তারা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবে। আসলে সমীকরণটা কী হবে?
মির্জা ফখরুল : এগুলো অনেক পরের ব্যাপার। নির্বাচন একসঙ্গে কীভাবে হবে বা না হবে সেটা ঠিক হয়নি। আমাদের জোট নিয়ে অনেকে ভুল ব্যাখ্যা দেন। এই জোট হচ্ছে আন্দোলনের জোট। ২০ দলীয় জোটের ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার করে বলা আছে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের পতন ঘটানোর জন্য এই জোট। নির্বাচন পরের বিষয়। তবে নির্বাচন আসলে আলাপ-আলোচনা হবে। তখন কার কী অবস্থা দাঁড়াবে তখন সেটা দেখা যাবে।
আলমগীর স্বপন : সামনে তা হলে আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গেই মাঠে থাকছে?
মির্জা ফখরুল : আন্দোলন তো একসঙ্গে হবেই। যে আন্দোলন হবে, একসঙ্গেই হবে। যে আন্দোলন চলছে, এটাতে আমরা একসঙ্গেই আছি।
আলমগীর স্বপন : জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দল হিসেবেও দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে।
মির্জা ফখরুল : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন কারা তোলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি তারা তোলে। তবে আমি বলছি না যে আওয়ামী লীগ একেবারেই মুক্তিযুদ্ধ করেনি। অবশ্যই তাদের কিছু কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তারা নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা সরকারও গঠন করেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বলতে যা বোঝায়, এটা বিএনপির লোকেরা করেছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, লড়াই করেছেন। বিএনপির ৮০ ভাগ নেতা পাবেন যারা যুদ্ধ করেছেন।
আলমগীর স্বপন : জামায়াত বিতর্কের পাশাপাশি রাজনীতিতে এখন হেফাজত বিতর্কও চলছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি শীর্ষ দুই দলকেই হেফাজত নিয়ে টানাটানি করতে দেখছি আমরা। আপনারা এক সময় হেফাজতকে সার্পোট দিয়েছেন। এখন হেফাজতকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাছে টেনেছে।
মির্জা ফখরুল : কারো হুকুমে নির্দেশে কোনো রাজনৈতিক দল চলে না। রাজনৈতিক দল তার কৌশলগত কারণে, তার রাজনীতি সবকিছু মিলিয়ে তার রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে। দ্বিতীয়ত হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যে সম্পর্ক তৈরি করেছে, সেটা হচ্ছে তার সুবিধাবাদের সম্পর্ক। এই আওয়ামী লীগই ৫ মে হেফাজতের সমাবেশে অসহায় নিরীহ মানুষগুলোর ওপরে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, এখন নিজেদের সুবিধার্থে আবার তারা হেফাজতকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে যাচ্ছে। অর্থাৎ এটা তাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, এটা তাদের সুবিধাবাদের রাজনীতি। এই সুবিধাবাদের রাজনীতি আমরা করি না। আমরা খুবই স্পষ্টভাবে বলি যে, আমরা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। আমরা একটি উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। গণতন্ত্রের জন্য আমরা কাজ করি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কেউ ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়নি। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর সংগ্রাম করেছেন রাজপথে। ৯ বছর সে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে এবং কারো সঙ্গে আপস করেননি, লড়াই করেছেন রাজপথে থেকে। এরপর জনগণের ভোটে, আস্থা নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আবার ২০০১ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আবার তাকে সরিয়েছে কে? একটা বেআইনি, অবৈধ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। আওয়ামী লীগ করেছে। এরশাদ যখন ক্যু করল তখন আওয়ামী লীগ বলল, ‘আমরা অখুশি নই’, এগুলোর ডকুমেন্ট আছে। আবার যখন ১/১১ এলো, যখন জেনারেল মঈনউদ্দিন ক্ষমতা দখল করল, ফখরুদ্দিনকে দিয়ে তখনো আওয়ামী লীগ বলল, এটা হচ্ছে তাদের আন্দোলনের ফসল। এই আন্দোলনের ফসল কী করেছে, দুই বছর একেবারে স্টিমরোলার চালিয়েছে। গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেষ করেছে। তাদের আন্দোলনের ফসল বলেই আঁতাত করে তাদের (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় বসিয়েছে। আওয়ামী লীগের ডাবল স্ট্যান্ডাডের আরও নমুনা আছে। প্রধানমন্ত্রী হেফাজত ও ভাস্কর্য ইস্যুতে হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননদের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তিনিই তাদের মন্ত্রী বানিয়েছেন। অথচ এক সময় তারাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল। শেখ মুজিবর রহমানের চামড়া দিয়ে তারা ডুগডুগি বানাতে চেয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করার জন্য তারা গণবাহিনী তৈরি করেছে। এটাই সত্য। তাই সমস্যাটা তাদের। তারা এই ধরনের কাজ করেন। ডাবল স্ট্যান্ডার্ডেও ভূমিকা নেন, মানুষকে বোকা বানানোর কাজ করেন। গণতন্ত্রের কথা বলবেন, কিন্তু গণতন্ত্রের আশপাশ দিয়েও যাবেন না। সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু সমাজতন্ত্রের কাছেও নেই তারা।
আলমগীর স্বপন : এবারের বাজেট ও সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কী বলবেন। আওয়ামী লীগ সরকারের যতগুলো উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে এর আগের কোনো সরকার সে কাজ করতে পারেনি বলে দাবি করছে সরকার।
মির্জা ফখরুল : বাজেট এখন জনগণকে শোষণ করার আরেকটি হাতিয়ার। সরকার উন্নয়নের নামে লুটপাট করছে। এই লুটপাট করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে, সরকারি খাত। এখানে লুটপাটে সবচেয়ে বড় সুবিধা। বেসরকারি খাতে তারা এটা পারবে না। কারণ সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগ আছে। যেমন ধরেন স্বাস্থ্য খাত। মনে করেন পাঁচটা হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। কথার কথা বলছি যে, এর ৮০ ভাগই তারা লুটে নেয়। মেশিনপত্র আনল শতকরা ২০ ভাগ আর ৮০ ভাগই গেল। মেগা প্রজেক্ট করছে তারা। এই মেগা প্রজেক্ট মানেই বড় বাজেট। পদ্মা সেতুর বাজেট আড়াই হাজার কোটি টাকা থেকে এখন কত গুণ হয়েছে, ২৮ হাজার কোটি। অথচ পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে আড়াই হাজার কোটি রুপিতে এর চেয়ে বড় সাড়ে ৬ কিলোমিটার সেতু তারা নির্মাণ করেছে। এই যে ফ্লাইওভারগুলো হচ্ছে, এর সবগুলোর নির্মাণ ব্যয় তিনগুণ, চারগুণ, পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। সব তাদের পকেটে চলে যাচ্ছে। এই পকেটের টাকা যদি দেশেও থাকতো তা হলে বিনিয়োগ হতো, কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। বিনিয়োগ বরং কমে যাচ্ছে। এই টাকা চলে যাচ্ছে বাইরে। পত্র পত্রিকায় দেখি তারা দেশের বাইরে বাড়ি কিনছে, সেখানে বিনিয়োগ করছে। ফলে দেশের অর্থনীতি একটা চরম ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে যেটা খুবই আশঙ্কাজনক। পরিসংখ্যান ব্যুরোর যে চার্ট আছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে খাদ্যসামগ্রীর দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাড়তেই আছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা? দরিদ্র মানুষ। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়া মানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব মানুষ। বড়লোকেরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তারা এককেজি চাল ৫০ টাকা বা ১০০ টাকায় কিনলে তাদের কোনো যায়-আসে না। কিন্তু চালের দাম যদি ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয় তা হলে গরিব মানুষ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জিনিসগুলো এই সরকার দুঃখজনকভাবে করে যাচ্ছে। তাদের দায়বদ্ধতা নেই,জবাবদিহিতা নেই। কার কাছে তারা জবাবদিহিতা করবে, এর প্রয়োজন নেই তাদের। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত না। সংসদও নেই যে সংসদে তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং সরকার লাগামহীনভাবে চলছে।
আলমগীর স্বপন : আপনাদের মতে, সরকারের বিরুদ্ধে এত ইস্যু। এর পরও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি। এর জন্য বিএনপির দলীয় কোন্দল-দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসকেই দায়ী করেন অনেকেই।
মির্জা ফখরুল : বিএনপির মতো একটা বিশাল রাজনৈতিক দলে এগুলো না হলেই তো আমরা বুঝব যে কোথায়ও কোনো ভুল হচ্ছে। কোথায় কোন সমস্যা হচ্ছে। কারণ বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকবে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না, দুই একটা হইচই হবে না-এটা না হলে বিএনপি এতো বড় দল এটা বোঝা যাবে কী করে? এটা আজকের ব্যাপার না এটা তো ইতিহাস। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হচ্ছে, বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে সবসময়ই কাউন্সিল নিয়ে, নেতৃত্ব নিয়ে কিছু গোলমাল থাকেই। আওয়ামী লীগে হয়েছে, মুসলিম লীগে হয়েছে। সেই ব্রিটিশ আমলে হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের বই পড়লেই বুঝবেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। তিনি লাঠি নিয়ে বহুবার সম্মেলন ভেঙেছেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ উনি ভেঙেছেন, আওয়ামী লীগ ভেঙেছেন, মাওলানা ভাসানী বেরিয়ে এসেছেন ওনাদের লাঠি খেয়ে। এটাই বাস্তবতা। বর্তমান প্রজন্ম এগুলো জানে না।
আলমগীর স্বপন : তা হলে আপনি মনে করছেন কোন্দল-দ্বন্দ্ব কিছুই না। দল সংগঠিত আছে। সামনে আন্দোলন-সরকারি চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম বিএনপি?
মির্জা ফখরুল : বিএনপির বয়স এখন প্রায় ৩৮-৩৯ বছর। এই সময়ে বিএনপির উত্থান-পতন হয়েছে। বিএনপি কখনো ক্ষমতায় কখনো বাইরে, কখনো রাজনৈতিক চাপ, কখনো মিলিটারি অভ্যুত্থানের চাপ-সব মিলিয়ে বিএনপি টিকেই আছে। বার বারই দেখা গেছে, বিএনপি এর মধ্য থেকেই আরও বেশি উজ্জীবিত হয়। যখনই বিএনপির ওপর কোনো আঘাত আসে, যখন বিএনপি আক্রান্ত হয়, তখনই বিএনপি এই ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো বেরিয়ে আসে। বিএনপির রাজনীতিটাই হচ্ছে মানুষের জন্য। যে কারণে বিএনপি বার বার জেগে ওঠে। অনেকেই বলেছিলেন জিয়াউর রহমান সাহেব চলে গেছেন, বিএনপি শেষ। আমরা ক্ষমতা থেকে সরে গেলাম,অ নেকেই বলেছেন, বিএনপি শেষ। ১/১১ হলো, কেউ কেউ বলল বিএনপি শেষ। কই বিএনপির একটা লোককেও কেউ সরাতে পারেনি। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করে দেখুক তাদের জামানত থাকবে না। আওয়ামী লীগের জামানত থাকবে না। ৩০টার বেশি আসন তারা কোনোদিনও পাবে না।
আলমগীর স্বপন : ধন্যবাদ আপনাকে।
মির্জা ফখরুল : ধন্যবাদ।
এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ