শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
logo

‘শিক্ষক হতে পেরেছি, এটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা মনে হয়’

‘শিক্ষক হতে পেরেছি, এটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা মনে হয়’

ঢাকা, ০৮ সেপ্টেম্বর, এবিনিউজ : অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক, শিল্প-সমালোচক ও অনুবাদক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে তাকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— শেখ মেহেদী হাসান।

আপনার জন্ম সিলেটে। মনে পড়ে আপনার ছেলেবেলার কথা?

আমার জন্ম সিলেটে, ১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি। আমার ছোটবেলা কেটেছে সিলেটে, সেখানে আমি দুই দফা ছিলাম। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সিলেটে থাকার পর আমরা কুমিল্লায় চলে আসি। সেখানে চার বছর ছিলাম। আমার মা বাবা দুজনই সরকারি চাকরি করতেন। মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা ছিলেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা। তারপর আবার সিলেটে এবং ’৬৮ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চলে এলাম। ছেলেবেলার কথা বলার সময় আমার ওই সব আনন্দের স্মৃতি ভেসে ওঠে। শৈশব-কৈশোর খুব উপভোগ করেছি। বাবা অন্য জেলায় কাজ করতেন। তিনি ছুটি পেলে আমাদের কাছে চলে আসতেন। মায়ের শাসনে থাকার ফলে আমরা প্রচুর স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু এর অপব্যবহার করিনি। সারা দিন খেলাধুলা করেছি। সন্ধ্যার পর আমরা কেউ বাইরে থাকতাম না। কোনো চাপ না থাকায় পড়াশোনা করেছি নিজের মতো। মা শুধু বলে দিতেন, তুমি যদি না পড় তোমার ক্ষতি হবে। শাসন করলে বরঞ্চ পড়াশোনাটা কম হয়। আমাকে প্রচুর গল্পের বই কিনে দিতেন। বই উপহার পেতাম। বই কেনার জন্য পয়সা চাইলে কোনো দিন না করতেন না। তখন সিলেট শহরে ৩-৪টি লাইব্রেরি ছিল। দুই-তিনটি বইয়ের দোকান ছিল। খেলাধুলার জন্য প্রচুর মাঠ ছিল। সাইকেল চালিয়ে আমি শহরের এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়াতাম। চা-বাগানে যেতাম। বন্ধু-বান্ধব প্রচুর ছিল। সুতরাং আমি বলব, আমার ছোটবেলাটা কেটেছে খুব আনন্দের সঙ্গে।

সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

আমার নানী ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলীর আপন বোন। বাংলা একাডেমি থেকে তার একটি গানের সংকলনও বেরিয়েছে। যেহেতু বিখ্যাত ভাইয়ের বোন ছিলেন এজন্য তার মধ্যে ওই মেধাটা ছিল। তখনকার দিনে আমাদের নারীরা অনেক সন্তান নিয়ে সাধারণত সংসার-ধর্ম পালন করতেন। আবার তাদের দীর্ঘ জীবনও ছিল না। রোগ-শোকের প্রতিকারও কম হতো। তাদের জীবন ছিল খুব কষ্টের। আমার নানী তার মেধাকে কাজে লাগাতে পারেননি। আর মুজতবা আলী এমন মানুষ ছিলেন যিনি পরিবারকে বরাবরই প্রাধান্য দিতেন। আমার সঙ্গে তার খুব বেশি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। ১৯৬৩ সালের দিকে আমাদের বাড়িতে তিনি দুই-তিন দিন ছিলেন। তখন অটোগ্রাফে আমাকে চার লাইনের একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। আর সব সময় বলতেন, বই পড়। তার ভাগ্নি আমার মা। মাকে তিনি প্রচুর বই, পূজা সংখ্যা কিনে পাঠাতেন। যখন তিনি ছুটিতে আসতেন, তার বিশাল ভাগ্নে-ভাগ্নির যে বাহিনী ছিল তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতেন। তিনি অসাধারণ একজন কথক ছিলেন। ভাষাবিদ তো ছিলেনই। যখন বাংলা বলতেন তখন সেটি হতো খুবই পরিচ্ছন্ন। আবার ইংরেজি বললে মনে হতো কোনো ব্রিটিশ ভদ্রলোক কথা বলছেন। আবার যখন সিলেটি বলতেন মনে হতো আমাদের চেয়েও খাঁটি সিলেটি। অত্যন্ত চমৎকার হাস্যরসের অবতারণা করতে পারতেন। প্রতিটি কথার ভিতর একটা কৌতুক থাকত। তার জ্ঞান ছিল অপরিমিত। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে এমন সুন্দর, স্বচ্ছ ধারণা খুব কম সাহিত্যিকের মধ্যেই দেখেছি আমি। একেবারে ক্লাসিকস থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বিষয়াবলিতেও তার অগাধ জ্ঞান ছিল। ফলে তিনি যখন কথা বলতেন আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। আমার মতে, বাংলা ভ্রমণসাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ও সৈয়দ মুজতবা আলী- এ দুইজনকে বাদ দিলে একটা শূন্যতার মধ্যে পড়ে যায়। তার এই পরিচ্ছন্ন ভ্রমণসাহিত্যকে অতিক্রম করা কঠিন।

শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কেন?

আমাদের সময় পাবলিক সার্ভিসের প্রতি আগ্রহ খুব কম ছিল। আমরা বড় হয়েছি, স্কুল, কলেজে যখন পড়েছি তখন পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার সংগ্রাম তুঙ্গে উঠছে। আমরা পাকিস্তানের সিএসপি প্রথাকে পছন্দ করেনি কেউ। একজন সরকারি কর্মকর্তা প্রজাতন্ত্রের দাসে পরিণত হবে সেটি আমাদের কখনো আকর্ষণ করেনি। সিএসপিদের এলিটধর্মী আচরণ আমাদের মতো সমাজতন্ত্রী বিশ্বাসীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সরকারি কাজ যখন অর্থ-বিত্তের জোগান দিচ্ছে, ক্ষমতার জোগান দিচ্ছে— রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছাকাছি থাকা যায়— এই ধরনের কতগুলো সুবিধা এবং লোভ তৈরি হওয়াতে সরকারি চাকরি খুব লোভনীয় হয়ে গেছে, আমাদের সময় সেটি ছিল না। সেজন্য আমরা শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছি কারণ তখন একটা আদর্শ ছিল। নতুন দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবজনক ঐতিহ্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের জন্মের সময় সূতিকাগারের ভূমিকা পালন করেছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একজন শিক্ষক হতে পেরেছি এটা আমার কাছে একটি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর আজ এত বছর পড়ালাম, কখনো বাইরে গিয়ে থেকে যেতে ইচ্ছা হয়নি। বার বার মনে হয়েছে এই ছোট্ট দেশ, দেশের মানুষের জন্য সামান্য কিছু করতে পারলেই আমি খুশি। আমার বন্ধু মুনতাসীর মামুন, সে কোনো দেশে গেলে ভালো করতে পারত। সবার ইচ্ছা ছিল, আমাদের ঋণগুলো একটি একটি করে শোধ করি। বলতে পারেন, একটা ঋণশোধের ভূমিকায় নেমেছিলাম। আমার মনে হয়, আর কোনো চাকরিতে সেই আনন্দ খুঁজে পেতাম না যা আমি শিক্ষকতায় পেয়েছি। আমি কিন্তু বেশি বেতন, গাড়িসহ জাতিসংঘের একটি চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলাম। তারপরও আমি সেখানে কাজ করিনি। আজ এত বছর পর বুঝতে পারি, শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়ে আমি কোনো ভুল করিনি।

আপনি ডব্লিউ বি ইয়েটসের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করেছেন। কর্মজীবনেও সিরিয়াস গবেষণার পাশাপাশি নিয়মিত মননশীল প্রবন্ধ লিখেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর আমাদের বলা হলো, প্রকাশনা থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য জ্ঞান উৎপাদন এবং বিতরণ। সুতরাং শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর পাশাপাশি লেখালেখিতে মনোযোগ দিই। কুইন্সে আমার পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক নরম্যান ম্যাকানজি ছিলেন উঁচু মানের একজন স্কলার। তিনি আমাকে হাতে-কলমে সত্যিকার গবেষণার কলাকৌশল শিখিয়েছিলেন। কতটা করতে পেরেছি তা জানি না। দেশে ফিরে সংবাদে আমি কলাম লিখতে শুরু করলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’। ওই কলামের বিষয় একাডেমিক না রেখে সৃজনশীলতার ভিতরে ছড়িয়ে দিলাম। এই শিক্ষাটাও কিন্তু আমার পিএইচডি কার্যক্রম থেকে পেয়েছি।

কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি শিক্ষকতাও করেছিলেন।

কুইন্সে আমি টিচিং অ্যাসিসটেন্ট ছিলাম। আমার এক শিক্ষিকা যিনি ভীষণ অলস কিন্তু অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। সকাল নয়টায় ক্লাস। হয়তো আটটার সময় তিনি আমাকে ফোন করলেন, আমি তো ঘুম থেকে উঠতে পারছি না, তুমি আমার ক্লাসটা নিয়ে নাও। শেকসপিয়র পড়িয়েছি। শিক্ষার্থীরা আমার জন্য অপেক্ষা করত। আমি আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকতাম। যদি তিনি ফোন না করেন তাহলে আমি হয়তো তার ক্লাসে গিয়ে বক্তৃতা শুনে নিজেকে শাণিত করতাম। আমি কখনো অপ্রস্তুত হয়ে শ্রেণিকক্ষে যাইনি। এই নীতি সারা জীবন অনুসরণ করেছি। আমি যদি শিক্ষার্থীদের প্রতি সৎ হই, সম্মান করি তারাও আমাকে সম্মান, শ্রদ্ধা করবে।

‘নন্দনতত্ত্ব’ শীর্ষক আপনার লেখা বহুল পঠিত একটি বই রয়েছে। বইটি কখন লিখেছিলেন।

নন্দনতত্ত্ব বইটি লেখার একটি প্রেক্ষাপট আছে। বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মাওলা উদ্যোগ নিলেন নানা বিষয়ে একশ বই ছাপবেন। একদিন আমাকে বললেন, ‘আপনাকে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে বই লিখতে হবে। কারণ বাংলাদেশে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে কোনো বই নেই। ’ আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। লাইব্রেরিতে যত বই ছিল সংগ্রহ করে প্রচুর পড়লাম। অনেক পরিশ্রম করে বইটি লিখেছি। ওই যে আমার পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক বলেছিলেন যে, ‘তোমার গবেষণাকে একটি গল্পের মতো করে সাজাবে। তার ভাষার প্রতি নজর রাখবে। ’

শিল্পকলা বিষয়ক আপনার প্রচুর লেখা রয়েছে। দেশের খ্যাতিমান শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়াকে নিয়ে একটি বইও লিখেছেন।

১৯৬৮ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন চারুকলা ইনস্টিটিউটে মারুফ ও ইব্রাহিম নামে দুই বন্ধু পেয়ে গেলাম। চারুকলার ক্যান্টিনে ওদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। একটু সিঙ্গাড়া খেতাম। আমাদের হাতে এত পয়সাও ছিল না। বৃত্তির টাকা দিয়ে পড়তাম। ওদের ছবি আঁকা দেখে, আড্ডা দিয়ে ছবি আঁকার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলো। একদিন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এসেছি? আমি বললাম ইংরেজি বিভাগ থেকে। আমি ছবি আঁকা দেখতে চাই। তিনি খুব আন্তরিকভাবে বললেন, কোনো অসুবিধা নাই। আবেদিন স্যারের আশকারা পেয়ে হাতে-কলমে কাজ দেখা ও শেখার সুযোগ পেলাম। কীভাবে জলরং, তেলরং, উডওয়ার্ক, এচিং করে এগুলো বসে বসে দেখতাম। জয়নুল আবেদিন ছবি আঁকছেন আমি বসে সেগুলো দেখছি, তার বক্তৃতা শুনছি। কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমদ আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন করছি, সফিউদ্দিন সাহেব আমাকে ভোট দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে চলে এলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে শিল্পকলা সম্পর্কে প্রচুর জানার সুযোগ পেয়েছি। তারপর তো শিল্পী সুবীর চৌধুরী আমাকে জাতীয় শিল্পকর্ম প্রদর্শনী, এশিয়ান বিয়েনালে ঢুকিয়ে দিল। প্রায় তিনশ ক্যাটালগ লিখেছি। শিল্পী কিবরিয়া, দীপা হককে নিয়ে বই লিখেছি। আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। হাশেম খানের ওপর কাজ করেছি। শিল্পকলা বিষয়ক পত্রিকা যামিনিতে নিয়মিত লিখছি। আমি তো মনে করি শিল্পকলা বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে লিখেছি।

আমাদের শিল্পকলা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতখানি প্রতিনিধিত্ব করছে বলে আপনি মনে করেন?

১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকায় আর্ট কলেজ করলেন। তার আগে খুলনায় ছোট্ট একটা স্কুল ছিল। কিন্তু ঢাকায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার ১০ বছর না যেতেই, পাকিস্তানের চিত্র প্রদর্শনীর প্রায় সব পুরস্কার আমাদের শিল্পীরা পেয়েছে। অথচ লাহোরের মেহ কলেজ বহু পুরনো। পাকিস্তানের একটা ঐতিহ্য ছিল। আমাদের ঢাকায় কোনো ঐতিহ্য ছিল না। শূন্য থেকে শুরু করে আমরা বিশাল সৌধ গড়ে তুললাম। জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমদ, এস এম সুলতানের ছবি বিদেশে প্রদর্শনী হয়েছে। আমাদের শিল্পীরা ইতালি, স্পেন, গ্রিস, জাপান, ফ্রান্সসহ নানা দেশে গেলেন। শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন, কাজী গিয়াসউদ্দিন, শহীদ কবির, ওয়াকিলসহ অনেকেই বিদেশে কাজ করছে। মনিরুল ইসলাম বিশ্বের বিভিন্ন বিয়েনালের জুরি বোর্ডের সদস্য। এই অর্জনগুলো তো একদিনে হয়নি। আমরা এই পথ দৌড়ে পৌঁছে গেছি।

সংবাদে ধারাবাহিক কলাম লিখতেন। তারপর নিয়মিত লিখেছেন প্রথম আলোসহ অন্যান্য দুই-একটি দৈনিকে।

আমাদের সময় শিক্ষকদের মধ্যে খান সারওয়ার মুর্শিদ, মুনীর চৌধুরী, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক, জি. সি দেব, সরদার ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। আমরা যে শুধু বিভাগ অনুযায়ী শিক্ষক মানছি তা নয়। ফলে এই অসংখ্য শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তারা বিশ্বাস করতেন, কেবল ক্লাসে পড়ালেই চলবে না। শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে হবে দেশের জন্য দশের জন্য। দেশের কাজ কিন্তু সময় সময় পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে দেশের অধিকার আদায় করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর রাজনীতিতে অতটা সক্রিয়তার প্রয়োজন হয়নি যতটা গণমানুষের জন্য প্রয়োজন ছিল। বামপন্থি সংগঠনগুলোর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল গণমানুষ। কিন্তু অন্য প্রধান দুটি সংগঠন তা রাখেনি। বিশ্ববিদ্যালয় এখন বিসিএস উৎপাদনযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাটা এখন বাজারমুখী, আদর্শমুখী নয়। আমি শ্রেণিকক্ষে পড়িয়ে যতটা আনন্দ পেয়েছি তেমনি লিখেও। আমার আদর্শ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি ‘গাছ পাথর’ নামে সংবাদে একটি কলাম লিখতেন। ওই কলাম আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এইচ. এম এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে আজকের কাগজে কলাম লিখেছি। সংবাদ, সমকাল, প্রথম আলোতে লিখেছি। সময় পেলে এখনো লিখি। কলাম লেখাকে আমি এক ধরনের সৃষ্টিশীল আনন্দের কাজ হিসেবে বিবেচনা করি।

আপনি প্রচুর গল্প লিখেছেন। আপনার গল্পে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার নিপুণ বর্ণনা থাকে। মানুষের দিন যাপনের চরিত্রগুলো যেন আপনার গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠে।

আমি এক সময় খুব ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হলে থাকতাম। তখন ঢাকা খুব সুন্দর একটা শহর ছিল। উত্তরার দিকে আমরা বেড়াতে যেতাম পিকনিকের মেজাজ নিয়ে। সোয়ারিঘাটের একটু ভাটিতে বুড়িগঙ্গায় সাঁতারও কাটতাম। সেই দিনগুলো এখন স্বপ্নের মতো। এখন ঢাকা শহর কংক্রিটের আর আবর্জনার একটা জঙ্গল হয়ে উঠেছে। আমি রাস্তায় হাঁটতাম, সাইকেল চালাতাম, আর চারদিকের জীবন-দালানকোঠা-গাছপালা-দোকানপাট দেখতাম। বাসাগুলো দেখে মনে হতো, এখানে কারা থাকে? ছাদে হয়তো একজন তরুণীকে দেখা গেল, ভাবতাম, এই তরুণীটির জীবনটা কীভাবে কাটে? সে কী করে? মানুষ দেখতে খুব পছন্দ করতাম। দেখতাম আর ভাবতাম, মানুষগুলো কী করছে? কী ভাবছে? ট্রাফিক পুলিশের মুখটা কেন বিরক্ত? এই বিষয়গুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এগুলো গল্পে বর্ণনা করি।

আপনার বইয়ের নামে একটি সূত্র থাকে, প্রেম ও প্রার্থনার গল্প, বেলা অবেলার গল্প, সুখ-দুঃখের গল্প, কাঁচ-ভাঙ্গা রাতের গল্প ইত্যাদি। বইয়ের নামে ‘গল্প’ শব্দটি যুক্ত করে দেন, কেন?

শুধু একটা বইয়ের নাম ছিল ‘মেঘ শিকারী’। এটি আমার খুব প্রিয় একটি গল্প। আমি গল্প লিখছি এটা আমাকে বলতে হচ্ছে। এজন্য আমার বইয়ে বিষয়টি উল্লেখ থাকে। সৈয়দ শামসুল হক এক দিন আমাকে বললেন— দেখেন মনজুর, আমি গল্প লিখি। কিন্তু গল্পের বই থেকে আমার উপন্যাস বেশি বিক্রি হয়। গল্প লিখতে অনেক পরিশ্রম। তিনি অসাধারণ কলাম লিখতেন। তার ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বা ‘হৃৎকলমের টানে’-এর মতো অসম্ভব সুন্দর সাহিত্য কলাম আমি আর পড়িনি। অন্যদিকে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ‘সময় বহিয়া যায়’-এর মতো কলাম আমি কোথাও পড়িনি। কি পরিশীলিত ভাষা! আবদুল মান্নান সৈয়দ নিজ থেকে আমার বইয়ের সমালোচনা লিখলেন। কাগজে লেখা পড়ে আমি তাকে ফোন করলাম— ‘আপনি আমাকে নিয়ে এত বড় বড় কথা লিখলেন, আমি কি এর যোগ্য। ’ তিনি বললেন, ‘আমার ব্যস্ততা আছে, ফোন রাখছি’। তিনি এরকম মানুষ ছিলেন। এই মানুষগুলো অন্যদের উৎসাহিত করেছেন। গল্প লিখেছি মনের আনন্দে। অনেক সময় ছাত্ররাই আমার গল্পের উপাদান সংগ্রহ করে দেন। যত গল্প লিখেছি বেশিরভাগই বাস্তব সত্য। যা জীবন থেকে নেওয়া। পত্রিকার মফস্বল সংবাদ থেকেও আমি গল্পের উপাদান সংগ্রহ করেছি।

ছোট গল্পের কথাগুলো কীভাবে সাহিত্যপদবাচ্য হয়ে ওঠে, একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

একটা চরিত্র সেটা ছোট গল্পে, নাটকে কিংবা ভজনে হোক কি বাউল সংগীতে হোক- চরিত্র কিন্তু চরিত্র। আমি যে মাধ্যমে তাকে প্রতিষ্ঠা করছি তার একটি বয়ানগত শৃঙ্খলা প্রয়োজন। একটি দাবিও থাকে। রবীন্দ্রনাথ কিনু গোয়ালার চরিত্রটি কবিতার দাবি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু ছোট গল্পের পরিসর আরও একটু বড়। এখানে চমক থাকে। কবিতায় চমক নেই। কবিতায় আগেরটা ঘন হয়ে একটা জায়গায় এসে একটা সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়। ছোট গল্পের চমকটা সহজে বলে দেওয়া যায় না। ছোট গল্পে চরিত্রকে জীবন্ত করতে চাইলে তাকে এমন ভাষা দিতে হবে তা যেন সত্যিকারার্থে তার প্রতিনিধিত্ব করে। আপনি দেখুন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চেয়ে তার ছোট গল্পের চরিত্র (বলাই, ফটিক, রতন, পোস্ট মাস্টার) কিন্তু আপনার বেশি মনে আছে। আমি চেষ্টা করেছি চরিত্রগুলোর প্রস্ফুটিত ঘটাতে। ছোট গল্পে অতি লিখন হয় না। আমি অতি লিখন বিশ্বাস করি না। আমার গল্পের ঐতিহ্য কিন্তু লিখিত গল্পের না। কথ্য গল্পের অর্থাৎ মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্য আমি ধারণ করেছি। গল্প বলার ঐতিহ্য ভাষার কারুকাজ অস্পষ্ট করার জন্য নয়, ভাষার ভিতরের স্তরগুলো তুলে ধরার জন্য।

আপনি প্রচুর অনুবাদ করেছেন। আপনার কী মনে হয় বাংলা সাহিত্যের অনুবাদকর্মে উদ্যোগের অভাব রয়েছে?

একজন অনুবাদকের দুটি ভাষার ওপর (উৎস ভাষা ও উদ্দেশ্য ভাষা) দুর্দান্ত অধিকার থাকতে হবে। পূর্ণ অধিকার না থাকলে বইয়ের প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার আমি করতে পারব না। দ্বিতীয়ত. যারা গল্প, কবিতা অনুবাদ করেন তাদের ওই কাব্যিক কিংবা গাল্পিক সত্তা আছে কিনা, সৃজনশীল সত্তা আছে কিনা সেটা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। একজন প্রবন্ধকার একটি গল্প অনুবাদ করলে যেমন খটোমটো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তেমন একজন গল্পকার একটি প্রবন্ধ অনুবাদ করলে সমস্যা হতে পারে। বিষয়ভিত্তিক সক্ষমতা থাকতে হবে। আমাদের দেশে খুব কমসংখ্যক অনুবাদকের ভাষার ওপর দক্ষতা আছে। সুতরাং তাদের অনুবাদ সাবলীল হয় না। যদিও হয় তখন দেখা যায় অনুবাদ মূলানুগ হয়নি। আবার বেশি মূলানুগ করতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলে। ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে তার সংস্কৃতিও আমার অনুবাদ করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে সে কাজটি হয়েছে, আমাদের দেশে সে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়নি।

দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। গুণগত মান আমরা উন্নতি করতে পারছি না কেন?

আমরা বিস্তারের দিকে গিয়েছি মানের দিকে যাইনি। আমাদের যেন একটা পণ দাঁড়িয়ে গেছে যে, কতসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করছে, স্কুলে যাচ্ছে, ঝরে পড়ছে না। এটি বিশ্ব ব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া। তাদের চাপে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। আমার কথা হলো আমরা বিস্তারে যাব কিন্তু মান উন্নত হতে হবে। মান ভালো করতে শিক্ষকদের ভালো বেতন দিতে হবে, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক তৈরি করতে হবে। অবরোধের মুখে কিউবা শিক্ষকদের বেশি বেতন দিয়েছে। কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কার একজন শিক্ষক যত বেতন পান আমাদের শিক্ষক সেটা ভাবতেও পারেন না। ভিয়েতনামে শুনেছি, শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদা পান। আমাদের দেশে প্রাইমারি শিক্ষক যারা মানুষ গড়ার আদি কারিগর তাদের সামাজিকভাবে কেউ স্বীকার করে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যখন বিমানবন্দরে যাই তখন কেউ এসে সালাম দিয়ে আমাকে ভালো একটি সিট দিয়ে দেয়। কাস্টমসে ছেড়ে দিচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান অনেক ভালো। আমাদের চেয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা বেশি হলে তারা একশ ভাগ সেবা দিতে পারত। কোচিং বাণিজ্য গ্রাম পর্যায়ে চলে গেছে। শিক্ষামন্ত্রীর বয়ানানুযায়ী এখন ৬০ হাজার কোটি টাকা কোচিং বাণিজ্য হয়। একটি সনদ হাতে নিয়ে পরীক্ষার্থী বের হয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষার্থী বের হচ্ছে না। এর ফলে আমরা পরাজিত হচ্ছি। মানের প্রতি অবহেলার কথাটি কাউকে বুঝানো যায় না। দেশে প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত