![সৃজনে অনন্য সৈয়দ শামসুল হক](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/10/03/shamsul-haque_103097.jpg)
দিলীপ কুমার বড়ুয়া, ০৩ অক্টোবর, এবিনিউজ : জাদুময় শব্দ তাঁর শিল্পিত সৌন্দর্য, বর্ণ তাঁর সৃজনী শক্তির উৎস, আর স্বপ্ন তাঁর অসামান্য সম্ভাবনার কাব্যসুষমায় ভরা সবুজ এবং লালের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। সৈয়দ হক তাঁর দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবনের ইতি টেনেছেন, হয়েছেন অমৃতলোকের অধিবাসী। অনন্য কুশলতায় উপমা ব্যবহারে লিখছেন দুহাতে অবিরত। ধূসর মৃত্যুকে করেছেন আলিঙ্গন। সাহসে– স্বপ্নে –সৌন্দর্যে পাঠককে মুগ্ধ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন জাগরণের বীজমন্ত্র, এক এবং অদ্বিতীয় সংলাপ “ জাগো বাহে কোনঠে সবায়!” উৎসারিত আলোর জাগরণমন্ত্রে তিনি আমাদের জাগিয়ে তুলবেন শাশ্বত চেতনার ধ্বনিতে। তিনি আধুনিক বাংলার সাহিত্য মানসে বাঙালি পাঠক সমাজে তাঁর উজ্জ্বল শস্যের ঋদ্ধিময় উর্বর পলিমাখা ক্ষেতে বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তরে।
চিরায়ত বাংলায় বাঙালির চিন্ময় প্রকাশ ঘটেছে দীর্ঘ সংগ্রাম, জাগরণের উৎসারণে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতরই উত্থিত রয়েছে আমাদের বাঙালির বোধ,সাহসী চেতনা এবং জাগরণের ধারাবাহিক ইতিহাস। কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির আকাশে সংগ্রামের,স্বাধিকারের প্রবল চেতনার ভাবনাপুঞ্জ উদিত সূর্যের প্রথম আবির্ভাবের দীপ্র আবেগে রক্তিম বর্ণে রাঙা হয়েছিল। সৃজনশৈলীতে আকীর্ণ হয়ে উঠেছিল স্বদেশপ্রেমের শিল্পিত মানসপট। সৃজনের দায়বদ্ধতায় অনিবার্য পথচলা মুক্তির উচ্ছ্বাসে স্বদেশের দিকে, মাটি আর সবুজের দিকে। সৃষ্টির অনুভবে সৃষ্টিশীল মানুষের শিল্প–মনোভূমিতে সুন্দরের পর্ধিত পর্দা সরিয়ে ইতিহাস ঐতিহ্যের সার পরমাণু কুড়িয়ে আনার প্রত্যয়ে অবিনাশী যাত্রা জাগ্রত চেতনার শব্দ চয়নে। কালের সকল ধারাকে অতিক্রম করে সৈয়দ শামসুল হক এমনই একজন বহুমাত্রিক সৃষ্টির কারিগর ও নিমগ্ন লেখক যিনি সব সময় নিজের বিশ্বাস থেকে সমকালীন ভাবনায় একটি জগত নির্মাণ করেছেন। এ জগতের চতুর্দিকে ছিল অজস্র শব্দ, বাক্যের ঋদ্ধ অনুরণন। সৃজনের বহুমাত্রিকতায় নিজেকে পরিণত করেছেন সব্যসাচী লেখক হিসেবে। অবিরাম, অবিরল, অবিশ্রান্তভাবে যিনি শুধু সারাজীবন লিখে গেছেন দুরন্ত প্রতিভাসম্পন্ন কবি শামসুল হক। বিস্ময়কর সৃষ্টিসম্ভারে বিচিত্র বর্ণে পল্লবিত করেছেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন। সৃজনী উদ্দামতায় লিখেছেন কবিতা, লিখেছেন গল্প, লিখেছেন উপন্যাস, লিখেছেন কাব্য নাটক ও প্রবন্ধ। তিনি সাহিত্যের সকল অঙ্গনকে ছুঁয়েছেন সাফল্যের সোপানে।
স্বাপ্নিক এবং স্বাদেশিক ভাবনার বাস্তবতায় আবর্তিত হয়েছে বাঙালির আবেগ মথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে আবেগ, বিশ্বাস একটি বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, সেই চেতনার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস গড়ে উঠে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অভিন্ন জাতিসত্তায় রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কবি সৈয়দ শামসুল হক এ দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বপ্ন সাহসে উচ্চারণ করেছেন দ্রোহী শব্দের পদাবলি – এই তেরো শত নদীমাতা দেশে অতঃপর/বুলেট নিষিদ্ধ হবে। /মানুষ দখল নেবে রাষ্ট্র ক্ষমতার। /রক্তরাজপথ হবে অতঃপর/মানবিক কৃষির জমিন। /সব স্বৈরশাসকের কারফিউ ভঙ্গ করে/ ত্রসকল/ দেবে……অতঃপর উৎসারিত হবে ঝর্ণাধারা/প্রতি করতল থেকে। (স্বাধীনতার স্বপ্ন) অস্তিত্বের লড়াই, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ে লাখো দানে বাঙালির জাতীয় জীবনের রক্তাক্ত ইতিহাসে আলোকিত অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। অনিবার্য স্বপ্নজয়ের স্বাধিকার আন্দোলনের রক্ত পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে বহু ত্যাগের ফসল হিসেবে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের অনেক কবি–সাহিত্যিক রচনা করেছেন দ্রোহের, বিপ্লবের, স্বদেশপ্রেমের কাব্য, নাটক, সংগীত ,গল্প মুক্তিযুদ্ধের বর্ণিল ইতিহাস। দীর্ঘক্ষণ ’মাস সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী নিরস্ত্র বাঙালির লড়াই আর প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর। এরই মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সোপান। কবি–সাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন ভাবালুতায়, আবেগে । সৈয়দ শামসুল হক ও তাঁর কবিতায় অন্তরঙ্গ আবেগে এবং হৃদয়ের প্রাণিত চেতনায় একাত্তরের মার্চ মাসে পহেলা মার্চ ১৯৭১ কবিতায় লিখেছেন – দ্যাখো, আমি পতাকাহীন। কিন্তু/ আমার আছে সেই পতাকা/ যা দাম্ভিকের দক্ষ থেকে উত্তোলিত হয় না/আমার পতাকা আমার মায়ের মুখ।/ আমার তো একটিই মা নয়, কোটি কোটি মা। দেশমাতাকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন কোটি কোটি মায়ের প্রতিচ্ছবিতে । প্রত্যেক মায়ের মুখাবয়বে তিনি খুঁজেছেন মানচিত্রের কাঙিক্ষত রূপ । প্রত্যেকেই যেন একেকজন মা। স্বদেশ প্রেমের তীব্র বাসনায় মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সৈয়দ শামসুল হক এর কাব্যে , কাব্য নাটকে , বিভিন্ন উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে মননের অনুপম সৌকর্যে। কাব্যিক ছন্দে তিনি বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন পরম ঔদার্যে – ফিরে এসো লৌহিত্য নদের কিনারে,/ফিরে এসো বুকরঙ্গি মাছের সংসারে,/লাল শাদা শাপলার কচুরির বেগনি জাজিমে,/যুবতীর কলসের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ভেতরে,/আমাদের পিতামহ পিতামহীদের/ ব্যবহৃত তৈজসপত্রে ফিরে এসো। সৈয়দ শামসুল হক কবিতায় অফুরান সম্পদে ভরা বঙ্গজননীর কথা প্রকাশ করেছেন। ইতিহাস–ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গে বাংলাদেশের নৈসর্গিক শোভা বর্ণনা করেছেন নিঃসংকোচে, অকপটে। সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধকে অনুষঙ্গ করে যেসব কবিতা লিখেছেন, সেসবের মধ্যে বোধ, মাতৃভূমির প্রতি অন্তর্গত উপলব্ধি, মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় বাংলাদেশ, সাহসী সন্তান, অফুরন্ত বিশ্বাস সব কিছুই স্ফটিক স্বচ্ছ । মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মধ্যে বিদ্যমান আবহটাকেই তিনি কবিতায় ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কবিতা, নাটক, উপন্যাস সর্বত্র সেই চেষ্টা লক্ষণীয়। ফলে গদ্যের আঙ্গিকে তিনি যে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছেন, সেই বিষয়েরই কাব্যরূপ দেয়ার মানস কবির পথকে আরো কিছুটা প্রশস্ত করে দিয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হক লন্ডনে অবস্থান কালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধোত্তর কালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা , দেশচিন্তা তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে কবি ও নগর কাব্যগ্রন্থের গদ্যাংশটি খুবই প্রাসঙ্গিক। একাত্তরের মার্চের নতুন পথ নির্দেশের বাস্তব পরিণতির ইতিহাসকে নির্মাণ করেছেন কবি।৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তাঁর প্রেরণা জাগানো উদ্দীপ্ত ভাষণে বাঙালি জাতির ইতিহাসকে এক নতুন মাত্রায় তুলে ধরেন। বিশ্বময় সাড়াজাগানো এ ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামী বাঙালির অমোঘমন্ত্র উচ্চারণ করেন –এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । বঙ্গবন্ধুর জাগরণী ভাষণে মুক্তি–আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। মুক্তি ও স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চূড়ান্ত পরিণতিকে নিয়ে কবি সৈয়দ হক উচ্চারণ করেন – বাঙালির সংকল্প ও সংগ্রহের অসীমতায় এখনো তো/সেই পায়রারই উড্ডয়ন,/এবং এখনো তো সেই পায়রারই দুটি ডানায়/অনবরত লিখিত হয়ে চলেছে :/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।/
কবি গেরিলা শিরোনামের কবিতায় শব্দের গাঁথুনি দিয়ে যে–আঙ্গিক তৈরি করেছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধে একজন গেরিলার সংগ্রামমুখর প্রকৃতির ভেতর দিয়ে সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে বীরদর্পে নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিচ্ছবি উদ্ভাসিত। কবিতাটিতে শব্দের গাঁথুনিতে দেশ কালের গণ্ডী পেরিয়ে এনেছেন নতুন মাত্রা। যেন নিসর্গের পথ ধরে একজন গেরিলার যাত্রা উদ্যত একাকী জনশূন্য জনপদে প্রত্যয়ে –
অবিরাম
দক্ষিণ ভিয়েতনাম
কম্বোডিয়া
বাংলাদেশ
অ্যাংগোলায়
মোজাম্বিকে তুমি
নিসর্গের ভেতর দিয়ে
সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে যাও সারাদিন সারারাত যখন গ্রামগুলো
জনশূন্য চাতাল চিড় খাওয়া আর উপাসনার চত্বরগুলো ঝরাপাতায়
অনবরত ঢেকে যায় নিঃশ্বাসের শব্দের ভেতরে
তোমাদের চলাচল
যেন তুমি আমাদেরই দ্বিতীয়
শরীর কোনো এক রবীন্দ্রনাথের
গান সমস্ত কিছুর কেন্দ্রেই আছো
এবং ধ্বনিত করছ দুঃখের পাহাড়
আফ্রিকার এশিয়ার
নিসর্গে তুমি নতুন বৃক্ষ
নতুন বর্ষা নতুন ফুল
দিগন্তে নতুন মাস্তুল
পিতৃপুরুষের চিত্রিত দণ্ড
দাউ দাউ নাপামের
মধ্যে তুমি হেঁটে যাও
উদ্যত একাকী
জনশূন্য জনপদে উজ্জ্বল এক চিতা
সৈয়দ শামসুল হক এর কবিতার পরতে পরতে বাক্য বন্ধনীতে সৃজিত হয়েছে আমাদের বধিরতা ছিন্ন করে নতুন এক বীরগাথার গান– আমাদের হাতের সঙ্গে আবার হতে থাকবে/মানুষেরই হাতের গ্রন্থন -/করতল ও হাতের ওই মুদ্রা থেকেই বেরিয়ে আসবে/সেই শাদা পায়রাটি আবার,/মুজিবের হাত থেকে/একদিন যে উড়েছিলো বাংলার আকাশে/এবং অনূদিত হয়েছিলো অক্ষয় দুটি শব্দে –মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা।/ধারালো এই হিমে আমরা সবুজ নেবো শরীরে,/জনসভায় বিশাল হবো আবার,/আর আমাদের হাতের সঙ্গে হতে থাকবে/জনকের স্বপ্নবাহুর গ্রন্থন আবারও?……… বেরিয়ে আসবে সেই সাদা পায়রাটি /পৌঁছে গিয়েছিলো লক্ষ কোটি স্বপ্ন– নীলিমায় ।
একাত্তরের পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হন। সৈয়দ হক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিলেন – কোনো শোকগাথা নয় , মুজিবের রক্তাক্ত বাংলায়, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে, টুঙ্গিপাড়ায়, মুজিবের শাদা পায়রাটি ইত্যাদি কবিতা । মুক্তিযুদ্ধের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন , তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের, স্বাধীনতার বিস্তৃত ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সৈয়দ শামসুল হক শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তা–চেতনা ও কর্মধারার ঘটনাবিন্যাস এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বঙ্গবন্ধুর দুঃসাহসিক দায়বদ্ধতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন রোজ গার্ডেনে সেদিন শেখ মুজিব কবিতাটিতে –জন্মসূত্রে টুঙ্গিপাড়ার, চেতনায় সমগ্র বাংলার,/পিতার সন্তান তিনি, কিন্তু একদিন/দেশটির পিতা হয়ে উঠবেন। জাতির জনক!/… … …ত্রিশ লক্ষের রক্তে লাল হয়ে আছে আজো মাটি।/যেন রোজ গার্ডেনের সেদিনের রক্ত–গোলাপেরা/নিজস্ব বাগান ছেড়ে সারা দেশে ব্যাপ্ত হয়ে যায়।
একাত্তরের প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর বুকে নতুন করে একটি জাতি ও একটি দেশের উত্থানে নবতর একটি মানচিত্র বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছে। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে তিনি ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায় পর্ধা আর অপার ভালোবাসার উন্মোচনের কালে এবং আমাদের সুবর্ণ ভূমিতে তাঁর উচ্চারণ বাঙালির অস্তিত্ব–সংকটে একাত্তরের প্রেক্ষাপটে সৈয়দ হক আমার পরিচয় কবিতায় উপলব্ধিতে যে–উচ্চারণ করেছেন তা বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষেরই কণ্ঠের অনুরণন – আমি যে এসেছি জয় বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে/আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।/পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের /কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।/শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস; /অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ; /একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস; /আপোষ করিনি কখনোই আমি এই হলো ইতিহাস।/এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? /যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান; /তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি/চোখ নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
তাঁর কালজয়ী কবিতার সংখ্যা হটাৎ করে নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। তবে বুনো বৃষ্টির গান, একদা এক রাজ্যে, বিরতিহীন উৎসব, বৈশাখে রচিত পক্তিমালা থেকে প্রতিধ্বনিগণ, অপর পুরুষ, পরাণের গহীন ভিতর কাব্যসমূহ তাঁর মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের এবং পরের চেতনাকে আমাদের উদ্ভাসিত করে ব্যতিক্রমী মাত্রায়। উপন্যাস রক্ত গোলাপ , নিষিদ্ধ লোবান সহ বেশ কিছু রচনা মুগ্ধ করে রেখেছে পাঠককে। নিজস্ব বৈভবে শুধু কথাশিল্প নয়, কাব্যনাট্যে চিরস্মরণীয় অবদান , নাটক থেকে অনুবাদ–প্রবন্ধে তিনি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সব্যসাচী সাহিত্যিকের উপমায় ভূষিত হয়েছেন। তাঁর অসংখ্য কবিতায় লোকায়ত জীবন, প্রান্ত সংস্কৃতি, মধ্যবিত্তের মাত্রিকতার সঙ্গে প্রতিরোধী চেতনা বিচ্ছুরিত হয়েছে। এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর। তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ এক থেকে বহুমাত্রার আলোছায়ায় প্রকাশ পেয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী এরশাদ বিদায় নেয়ার পর পরিবর্তিত বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছিলেন কবিতা তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ। এ কবিতায় তিনি তাঁর অনুপম শৈলীতে যে বাংলাদেশকে বিধৃত করেছেন তা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমান যাত্রাপথের ছন্দোবন্ধনে মূর্ত হয়ে উঠেছে –তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ/তুমি ফিরে এসেছো তোমার লাল সূর্য আঁকা সূর্যের ভেতরে/যার আলোয় আবার রঞ্জিত হয়ে উঠেছে বটবৃক্ষ।/তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ,/তুমি ফিরে এসেছো তোমার অনাহারী শিশুটির কাছে/যার মুঠোর ভিতরে এখন একটি শস্যের বীজ। তাঁর কাব্যশিল্পের বুননকৌশলে কবিতার অন্তর্গত রূপব্যঞ্জনায় পাঠকমনে স্থান করে নিয়েছেন একজন সৈয়দ শামসুল হক । তিনি নিজেই কবিতায় লিখেছেন একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই/ সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
বাংলাদেশের ছোটগল্প তাঁর কলমেই প্রথম সার্থকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গল্পে জীবন ভিন্ন সুর পেয়েছে, চরিত্র হয়ে উঠেছে জীবন্ত, প্রাণবান। দেহের কাঠামো ছাড়িয়ে গল্পে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। নাগরিক মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, অসঙ্গতি আর নির্বেদ অঙ্গনেই সৈয়দ শামসুল হক সবচেয়ে মনোযোগ দিয়েছেন। উপস্থাপনার অভিনবত্বে ছোটগল্পের যাত্রাকে ঋদ্ধ করেছেন। তাস, শীতবিকেল, আনন্দের মৃত্যু, প্রেমের গল্প, শ্রেষ্ঠ গল্প, গল্পসংগ্রহ গ্রন্থ অনন্য মাত্রায় পাঠককে আকর্ষণ করেছে। তাঁর উপন্যাসে বাঙালি সংস্কৃতির বহমান ধারা? লোকজ ও দেশজ ভাবনার মোড়কে বাঙালির ব্যর্থতা ও সাফল্য চিত্রিত হয়েছে। মঞ্চসফল নাটক লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে। বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রামী চেতনার জন্য নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাট্যটি রংপুর–দিনাজপুরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক নেতা নূরলদীনের সাহস আর সংগ্রামের উপাদানে সৃষ্টি করেছেন । এক নূরলদীন যদি চলি যায়, /হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়। নূরলদীন পরিণত হয়েছে বাঙালির সম্মিলিত শক্তির উজ্জীবিত চেতনার প্রতীকে।
জাদুময় শব্দ তাঁর শিল্পিত সৌন্দর্য, বর্ণ তাঁর সৃজনী শক্তির উৎস, আর স্বপ্ন তাঁর অসামান্য সম্ভাবনার কাব্যসুষমায় ভরা সবুজ এবং লালের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। সৈয়দ হক তাঁর দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবনের ইতি টেনেছেন, হয়েছেন অমৃতলোকের অধিবাসী। অনন্য কুশলতায় উপমা ব্যবহারে লিখছেন দুহাতে অবিরত। ধূসর মৃত্যুকে করেছেন আলিঙ্গন। সাহসে– স্বপ্নে –সৌন্দর্যে পাঠককে মুগ্ধ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন জাগরণের বীজমন্ত্র, এক এবং অদ্বিতীয় সংলাপ “ জাগো বাহে কোনঠে সবায়!” উৎসারিত আলোর জাগরণমন্ত্রে তিনি আমাদের জাগিয়ে তুলবেন শাশ্বত চেতনার ধ্বনিতে। তিনি আধুনিক বাংলার সাহিত্য মানসে বাঙালি পাঠক সমাজে তাঁর উজ্জ্বল শস্যের ঋদ্ধিময় উর্বর পলিমাখা ক্ষেতে বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তরে।
(সংগৃহীত)