ড. রহমান হাবিব, ০৪ অক্টোবর, এবিনিউজ : ড. আহমেদ মাওলা প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবেই মূলত পরিচিত; কথা সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি যে অপাংক্তেয় নন; তাঁর ‘কতিপয় মুখস্থ মানুষ’– উপন্যাসের মাধ্যমে তা মেধাবী স্থিতি ও স্বীকৃতি পায়। সমাজ ও রাজনীতির অন্তর্জগৎকে চরিত্রের সমাবেশে তিনি উপস্থাপন করেছেন।
‘কতিপয় মুখস্থ মানুষ’ (ঢাকা, বিদ্যা প্রকাশ, ২০১৭) আহমেদ মাওলার একটি সমাজ রাজনীতি নির্ভর উপন্যাস। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হলেও মূলত ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যকার সামাজিক–রাজনৈতিক ঘটনাবলী উপন্যাসটিতে বিভিন্নভাবে ফুটে এসেছে। সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় ও রাজনীতিক দুর্বিষহ জীবনকে কীভাবে যে পর্যুদস্ত করে তারই রেখাপাত উপন্যাসটিতে ভাষারূপ লাভ করেছে।
প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হরিশঙ্কর জলদাসকে উৎসর্গ করা বাক্যে বলা হয়েছে: ‘একটি বাক্যে সবটুকু জীবন কি ধরে রাখা যায়’? জীবনের ব্যাপক গভীর তাৎপর্যময় স্বরকে শিল্প কর্মে ধরে রাখার আকাঙক্ষা বাক্যটির মধ্যে প্রতিভাসিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের হালিশহরের আবাসিক এলাকার পরিবেশ পরিস্থিতির নেতিবাচক দোলাচল নিয়ে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। হালিশহর এলাকায় যেন হয়ে উঠেছে সমগ্র বাংলাদেশ।
মূলত আবদুল মতিনের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস নিয়েই আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসটি। তাঁর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পিতা আবদুল মজিদের স্বপ্নাকাঙক্ষাকে আবদুল মতিন ক্রমশ তার স্বদেশে ক্ষয়িত হতে দেখেছেন। ছাত্র জীবনের বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী মতিন দেশকে শোষণ ও দারিদ্র্য মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাস্তবের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে শেষ পর্যন্ত মানসিক বৈকল্যে নিপতিত হয়ে বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আইএসসিতে জিপিএ–৫ পাওয়া ছেলে ফয়সালকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ানোর সময় মতিনের মানসিক বৈকল্য এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, ছেলের ভর্তি পরীক্ষার কোন খোঁজ–খবরই বাবার পক্ষে রাখা সম্ভব হয় নি। স্ত্রী শায়লাই তার ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে সাফল্য পেয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো মতিন; একা একা কথা বলত। পিতৃ মাতৃসম্পদ বিক্রি করে কেনা জমি রাজনৈতিক দখলদারদের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়া এবং মাকে তৃপ্তি সহকারে চিকিৎসা করাতে না পারার ব্যর্থতা মতিনকে মানসিক রোগে আক্রান্ত করেছে নিঃসন্দেহে।
চরিত্র চিত্রায়নেও মাওলা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। শায়লা মতিনের স্ত্রী, তাকে অনেকটা মুখরা ও জেদি মনে হলেও জীবনের পরিশেষে এসে জীবন বাস্তবতার যন্ত্রণায় শায়লা স্থিত ব্যথিত হয়ে উঠেছে। মতিনের বন্ধু আনোয়ার ব্যাংকার; প্রাণবন্ত এক পুরুষ হিসেবে তাকে চিত্রিত করা হয়েছে। মতিন তার মানসিক অসুস্থতার বৃদ্ধিতে হাস্যমুখ আনোয়ারের অফিসে দ্বিতীয়বার যখন যেতে চেয়েছে– তখন অসুস্থতার কারণে সে পথ ভুলে গেছে বলে যেতে পারে নি। সুস্থ হয়ে ওঠার বাসনা তার ছিল। কিন্তু অফিসে অনিয়মিত এবং কাজে পূর্ণতা না দিতে পারার কারণে তাকে চাকরিচ্যুতির ধমকি সহ্য করে অফিস থেকে ছিটকে পড়তে হয়। তারপর–ই মতিন পূর্ণ মানসিক রোগীতে পরিণত হয় এবং ইলেকট্রিকের তারে স্পৃষ্ট হয় এবং সকালে সবাই দেখে তার মৃত্যু দৃশ্য।
শব্দ চয়ন ও ভাষা শৈলীর ক্ষেত্রেও মাওলা যে ব্যথিত দীপ্রতার পরিচয় দিয়েছেন; তা মতিনের মৃত্যুদৃশ্যে উপস্থাপিত। মতিন যেন ব্যথিত পর্যুদস্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধি:
‘নীল অত্যাচারে লাল হয়ে ওঠে আবদুল মতিন। সকালে সবাই দেখে বিদ্যুতের তারে ঝুলে আছে সম্পূর্ণ রঙিন এক বাংলাদেশ! অখণ্ড এক আবদুল মতিন।’ (ঐ, পৃ. ৭৮)
ভুল নামে অপহরণকারী মোহাম্মদ হারুনের জবানির মধ্যেও ঔপন্যাসিকের জীবনার্তি প্রত্যক্ষযোগ্য:
‘মুক্তিপণ দেয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই। পেটের দায়ে এখানে ইপিজেডে চাকরি করতে এসেছি। তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দাও’। (ঐ, পৃ. ৪৭)
আবদুল মতিনের বন্ধু হান্নান চরিত্রটির সংলাপের মধ্যেও ঔপন্যাসিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতকে সাহসিকভাবে উপস্থাপন করেছেন:
‘বিরোধী দলগুলো অতীতে এমন সব অপকর্ম করেছে যে, মানুষের সমস্ত আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে জনগণের ন্যায়সঙ্গত প্রতিরোধ, মৌলিক অধিকারগুলো এখন দাঁড়াবার জায়গা পাচ্ছে না’। (ঐ, পৃ. ৬১)
উপন্যাসের আখ্যান ও চরিত্রকে জীবনধর্মী করার প্রয়োজনে পরিবেশ নির্মাণ এই শিল্পে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আহমেদ মাওলাও উপন্যাসটির মানসিক পরিবেশ বিনির্মাণে মতিনের আচরণকে মুন্সিয়ানার সাথে চিত্রিত করেছেন:
‘চলমান মিছিলে কাউকে অনুসরণ করে। তার কাছে যাওয়া খুব সহজ নয়। কোতোয়ালী মোড়ে আবদুল মতিন প্রায় তার বাবার কাছাকাছি পৌঁছে। তারপর মিছিলের হাজার হাজার মানুষের মধ্যে তার বাবা শহীদ আবদুল মজিদ আবার কোথায় হারিয়ে যায়’। (ঐ, প. ৭৭)
উপন্যাসের নায়ক আবদুল মতিন বিষণ্নতারোপ ও মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত হয়েছে। সমাজের হত্যা, গুম, ধর্ষণ, মাদক–ব্যবসা, মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখে। তার সহকর্মী সেলিম সাহেব ও মতিনের সামাজিক কষ্টে কষ্ট পেয়েছেন। বন্ধু হুমায়ুন, হান্নান, আনোয়ার মিলে তারা যে সান্ধ্য আড্ডার ব্যবস্থা করেছে। তার নাম ‘উপশম’ হবার কারণ হলো আড্ডায় দেশের বিভিন্ন সামাজিক–রাজনৈতিক অপশাসনের কথা ব্যক্ত করতে পারার কারণে মানসিক অবদমনের উপশম ঘটে। টক শোতে তো মন খুলে সত্য প্রকাশ করা যায় না; উপশম আড্ডায় যা সম্ভব হয়। ঔপন্যাসিক তীক্ষ্মভাবে সমাজ শাসনকে এভাবে স্পর্শ করেছেন।
আবদুল কাদের মাদক সম্রাট। তার নামই হয়ে যায় ‘ফেনসি খোকন’। সরকার দলীয় এমপির সঙ্গে তার দহরম–মহরম। জেল খেটে আসার পর সে এই আনুকূল্য পায়। সমাজের দুষ্টচক্রের এই প্রবাহকে লেখক সাহসী শিল্পীর মতোই উপস্থাপন করেছেন।
কলেজের একাউন্টিং–এর প্রভাষক শারমিনকে ছাত্রনেতা প্রপোজ করেছে; এই পরিস্থিতির মাধ্যমেও শিক্ষা পরিবেশের আলোহীনতা স্পষ্ট হয়। চট্টগ্রামের হালিশহরের বিহারিদের বাড়ি দখল করে আনসারদের সহায়তায় সেখানে মাদক রাজত্ব কায়েম করার মধ্যেও সামাজিক দুষ্টক্ষতের চিত্রায়ন প্রত্যক্ষযোগ্য হয়েছে।
আবদুল মতিনের এক সময়ের সহপাঠি বন্ধু বশির উদ্দিন যে ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল না; কিন্তু উচ্চ মহলে সম্পর্ক রক্ষার বদৌলতে ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে তার প্রতিষ্ঠাও সমাজ রাজনীতির পরিবেশের আলোহীনতাকে নির্দেশিত করে।
আবদুল মতিন একে একে দুইবার স্বপ্নের ঘোরে তার বাবাকে দেখতে পায়। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে শত শত নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল সে তাঁর দুঃস্বপ্নে প্রত্যক্ষ করে। মৃত্যুর পূর্বেও সে মিছিলে তার বাবাকে দেখে। মিছিলের শেষে সে বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে; মানসিক–বৈকল্যদশা অবস্থায়। স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পরেও স্বাধীনতার প্রাপ্তিগুলো মানুষের হাতের নাগালের বাইরে থাকার কারণেই স্বপ্নযোগে আবদুল মতিন মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল প্রত্যক্ষ করে। মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার আকাঙক্ষার দর্পণই এভাবে ঔপন্যাসিক তাঁর শিল্প কর্মটিতে পাঠকদের প্রত্যক্ষ করান।
চট্টগ্রামের হালিশহরকে ঘিরে উপন্যাসটি আবর্তিত হলেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে এমন কোন চরিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। হয়ত শিল্পী সচেতনভাবেই তা এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। পরবর্তী পর্বে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি উপন্যাস হয়তো তিনি রচনা করবেন আশা করি; চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে তিনি যেহেতু আছেন– সে কারণে এই প্রত্যাশা।
ঔপন্যাসিক তাঁর শিল্পকর্মে একটি জীবন দর্শন উপহার দেন। আবদুল মতিনের মাধ্যমে আহমেদ মাওলাও তা পাঠকদের দিয়েছেন। সমাজ রাজনীতির পর্যুদস্ততার কারণে জীবন সংকটে অস্তিত্ব চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জীবনকেও সে অবচেতনে মৃত্যুময়তায় মিশিয়ে দেয়া যায়– সেই আখ্যানই আবদুল মতিনের চরিত্র–ভাষ্যে ঔপন্যাসিক বিষণ্ন প্রাতিস্বীকতায় উপস্থাপন করেছেন।
(সংগৃহীত)