সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২
logo
  • হোম
  • সাক্ষাৎকার
  • ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে’

‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে’

‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে’

ঢাকা, ১১ অক্টোবর, এবিনিউজ : ষোল কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। এদেশে সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ আছে, সেটিও ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। মাটির নিচে তেল ও খনিজ সম্পদ আছে, কিন্তু সেগুলো অনুসন্ধানের লোক নেই। এর কারণ আমাদের দক্ষ মানবসম্পদের বড়ই অভাব। ষোল কোটি মানুষের ভিড়ে যোগ্য ও দক্ষ লোকের অভাব সর্বত্র লক্ষ্যনীয়। এ কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানসহ বড় বড় প্রকল্পে বিদেশিদের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) সুযোগ গ্রহণ করেছে। এদেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যাই বেশি। কর্মক্ষম মানুষ বেশি থাকলেও তাদের একটি বড় অংশ বেকার। তাই কেউ কেউ মত দিচ্ছেন বিপুল জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ। তবে মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পদসহ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনসংখ্যাই এ দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার বড় জায়গা। এই জনসংখ্যাকে যুগোপযোগী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীন, বিশ্ব অর্থনীতিতে রাজত্ব করছে দেশটি।

বিপুল জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য বোঝা না, সম্পদ- এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের (বিএসএইচআরএম) সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে এখনই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। কর্মক্ষম মানুষগুলোকে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক রিজাউল করিম।

রিজাউল করিম : কেমন আছেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: জি, ভাল আছি।

রিজাউল করিম: বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (বিএসএইচআরএম) সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: ২০১১ সালে ১০ জন উদ্যোক্তা ও ১৩ জন সদস্য নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আমরা রেজিস্ট্রেশন পেয়েছি। ২০০২ সালের এপ্রিলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী এটি উদ্বোধন করেন। হোটেল শেরাটনের ওই অনুষ্ঠানে প্রায় ৪শ’ উচ্চপদস্থ দেশী-বিদেশী কর্মকর্তা উপস্থিতি ছিলেন।

এখন আমাদের সদস্য প্রায় ৩ হাজার। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই আমাদের প্রতিনিধি আছে। চট্টগ্রামে আমরা নতুন চ্যাপ্টার খুলেছি। প্রধান অফিস থেকে আলাদা চ্যাপ্টারে চেয়ারম্যান আছেন। নির্বাহী কমিটি আছে। যেখানে প্রায় ৫শ’ সদস্যও আছেন।

দশ জন মিলে যখন এই সংগঠনটি শুরু করি তখন এটি ছিলো অনেকের কাছে তুচ্ছ তাচ্ছিলের বিষয়। বর্তমানে আমরা এশিয়া প্যাসিফিকের সদস্য হয়ে বেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কানেক্টেড হতে পেরেছি। এশিয়া প্যাসিফিকের নির্বাচনে আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম এশিয়া প্যাসিফিক ফেডারেশন অফ হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের নির্বাচিত সভাপতি। সভাপতি হওয়ার কারণেই বোর্ড সভা বাংলাদেশে হচেছ। অরাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য এটা বিরাট বড় এচিভমেন্ট।

রিজাউল করিম: বিএসএইচআরমের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: একটি দেশ পরিচালনার জন্য দরকার রিসোর্স। রিসোর্স ছাড়া কোনো দেশ বা সংগঠন চলতে পারে না। এখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের রিসোর্স আছে। কারো গ্যাস আছে, কারো খুব ভাল টেকনোলজি আছে। কিন্তু আমাদের দেশে কি আছে? আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষ। এই ষোল কোটি মানুষই আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রিসোর্স । আমাদের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের কার্যক্রমের বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের জনসংখ্যাকে সত্যিকার অর্থে জনসম্পদে রূপান্তর করা।

আমাদের এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। বিভিন্ন মহলের সচেতনতা ও আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য আমরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন, প্রশিক্ষণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকি। এতে জ্ঞানের আদান প্রদানের সুযোগ তৈরি হয়।

রিজাউল করিম: বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) এর সুযোগ গ্রহণ করেছে। দেশে প্রচুর কর্মক্ষম মানুষ। তারা কাজ পাচ্ছে না। এদের দক্ষ করে কাজে লাগাতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

মো. মোশাররফ হোসেন: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট স্রষ্টা আমাদের দিয়েছেন। এটা যদি কাজে লাগাতে হয়, তবে বাংলাদেশ সরকারকে এই মুহুর্তে একটা মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় করে, সরকারি-বেসরকারি সবার সমন্বয়ে আমাদের একটা সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। কীভাবে আমরা এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ কাজে লাগাতে পারি সেই কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার এখনই সুযোগ।

দেশে এখন ৫০ শতাংশেরও বেশি লোকের ৩০ থেকে ৩৫ বছরের নিচে। এতো বড় একটা সুযোগ যদি আমরা কাজে লাগাতে না পরি। তবে এ সুযোগ তো বেশি দিন থাকবে না। জাপানও এসময় এই সুযোগ পেয়েছিল। তারা তো এটা ধরে রাখতে পারে নি। এখন তো বয়স্ক লোক নিয়ে তারা বিপদে আছে। যথাযথ উদ্যোগ না নিলে আমাদেরও কিন্তু তাই হবে।

এক্ষেত্রে আমি বলব, আমাদের কর্মক্ষম যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হলে দেশের চাকরির বাজারের চাহিদা কী আছে, অন্যান্য দেশে কী চাহিদা আছে, সব চাহিদাগুলো সামনে রেখে একটি সমন্বিত মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে।

সেই পরিকল্পনার সঙ্গে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ দূতাবাসগুলো বিদেশে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কোনো দেশে কোন ধরনের মানবসম্পদ দরকার, কী পরিমাণ জনবল, কোন খাতে দরকার, দূতাবাসগুলো তা জানালে বিএসএইচআরএম ও এইচআর মিনিস্ট্রি (প্রস্তুাবিত) যৌথ উদ্যোগ নিয়ে জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দিয়ে কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা যেতে পারে। শুধু দেশেই নয়, প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশের শ্রমিকদেরকেরও সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ কাজ করার জন্য আমি মনে করি দ্রুতই একটি মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় দরকার। সেই মন্ত্রণালয়ের আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব সেক্টরের প্রতিনিধিকে নিয়ে একটা সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। তবেই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।

এছাড়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন করতে হবে। তরুণ শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। সবাই এমএ পাস, সবাই বিবিএ পাশ করলে হবে না। বরং চাকরি বাজারের চাহিদা যাচাই করে সেই অনুযায়ী শিক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট তৈরি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ভাবতে হবে। চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে কর্মীকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তার ভেতরকার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। নতুবা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

রিজাউল করিম: আমাদের বিপুল জনসংখ্যাকে অনেক বিশেষজ্ঞ বোঝা মনে করেন, আপনিও তাই মনে করেন কী না?

মো. মোশাররফ হোসেন: এটা অনেকে মনে করেন। আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমি মনে করি যারা বাংলাদেশের এ বিশাল জনসংখ্যাকে কাজে লাগাতে পারছেন না, তারাই এ ধরণের কথা বলে থাকেন। এটা একটা বিভ্রান্তিকর মন্তব্য। একটি দেশের জনসংখ্যা কোনোভাবেই বোঝা নয়। তাদের কাজে লাগানো গেলে নি:সন্দেহে তারা জনসম্পদে পরিণত হবে।

রিজাউল করিম: বর্তমানে কোন কোন খাতে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব আছে বলে মনে করেন এবং ভবিষ্যতে কোন খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হতে পারে?

মো. মোশাররফ হোসেন: আমি মনে করি প্রযুক্তি খাতেই দক্ষ লোকবলের অভাব। আমাদের আইটি সেক্টরটা খুবই সম্ভাবনার। এই খাতে দেশে বিদেশে প্রচুর কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া টেকনিক্যাল সেক্টরটাও সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশে যদি এই মুহুর্তে ১ লাখ বিশেষজ্ঞ ড্রাইভার তৈরি করা হয় তাদের একজনও বেকার থাকবে না। পাশাপাশি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (এইচআর) খাতও বেশ সম্ভাবনাময়ী।

রিজাউল করিম: দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের অবস্থা কেমন? যদি আমরা পিছিয়ে থাকি, তার কারণ কী?

মো. মোশাররফ হোসেন: এটা খুবই ভাল প্রশ্ন। আপনি পার্শবর্তী ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে দেখেন, তাদের জনসংখ্যাকে সত্যিকার অর্থে মানবসম্পদে রূপান্তর করার জন্য বহমূখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারা এটার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতসহ এইসব দেশগুলোতে পৃথক মানবসম্পদ মন্ত্রনালয় আছে। প্রত্যেক মন্ত্রনালয়ে মানবসম্পদ বিভাগ আছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে আমাদের মত যে পেশাজীবী সংগঠন আছে, তারা তাদের অনেক পৃষ্টাপোষকতা দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও সেই ধরনের পরিকল্পনা-ই নেই। মানবসম্পদ উন্নয়নে নেই বাস্তব কোনো পদক্ষেপ। আমাদের দেশে লেবার মিনিস্ট্রি আছে বা বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয় আছে । এই দুটি মন্ত্রনালয় জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার মত কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট একটা প্লাটফর্ম না থাকার কারণে আমরা অন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছি।

রিজাউল করিম: সর্বোচ্চ পর্যায়ে লেখা-পড়া শেষ করে এসেও কর্মক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেকে নিজেকে মেলে ধরতে পারছে না। আসলে আমাদের দূর্বলতাটা কোথায়?

মো. মোশাররফ হোসেন: আমি ছাত্রদের দোষ দেবো না। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে বেকার। দেশের যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তারা অদৌ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন কি-না সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিপুল জনসংখ্যাকে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষাণ দিয়ে মানসম্পদ করার বিষয়ে ভাবনা টাই নেই অনেকের মধ্যে। অথচ চীনে দেখেন, তারা একসময় চেয়েছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবে। এখন তারা আবার মনে করছে তাদের আরও জনসংখ্যা দরকার। এর প্রকৃত কারণ তারা জনসংখ্যাকে বোঝা ভাবছে না, তাদেরকে দক্ষ করে দেশের কাজে লাগাচ্ছে।

আমাদের দেশের বহু মেধাবী দেশের বাইরে গিয়ে ভালো করছেন। এটা কিন্তু তাদের নিজেদের চেষ্টায়। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখবেন আমাদের বাঙ্গালি অধ্যাপক, গবেষক, টেকনোলজিস্ট আছেন। অথচ তাদেরকে আমাদের দেশের উন্নয়নে তাদের কাজে লাগাতে পারছি না বা লাগানো হচ্ছে না।

আমাদের দেশে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বেশি। যারা কার্যক্ষম না, তারা ভবিষ্যতে কার্যক্ষম হবে। আজকে যারা শিশু তারাও তো কিছু দিন পর কর্মক্ষম হবে, তারা কোথায় যাবে? মালয়েশিয়ার উন্নয়নে মাহাথির মোহাম্মদ প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সেখানে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। তার কারণ, ওনার ভিশন ছিলো ২০ বছর পরে। বিশ বছর পরে দেশ কোথায় যাবে।

আমি মনে করি জনসংখ্যা নিয়ে আমাদের অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের ব্যবস্থাপনার সংকট ও দক্ষতার অভাব। যদি জনসংখ্যার দক্ষতা না বাড়ানো গেলে বড় ধরনের ঝুঁকি অপেক্ষা করছে বাংলাদেশর জন্য। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দরকার। বিশেষ করে প্রায়োগিক শিক্ষাটা বেশি জরুরি।

রিজাউল করিম: আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় দুর্বলতা কোনটি বলে আপনার মনে হয়?

মো. মোশাররফ হোসেন: মাহাথির মোহাম্মাদ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। আমাদের দেশে দেখেন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই অবহেলিত। ক্লাস ফাইভে, এইটে, এসএসসিতে, এইচএসসিতে একটা পাবলিক পরীক্ষা নিই। আমাদের জিপিএ ফাইভ, গোল্ডের জিপিএর অভাব নেই। অথচ এতো গোল্ডেন এতো ডায়মন্ড থাকার পরও আমরা কাঙ্খিত মেধাবী পাচ্ছি না। এরকম জিপিএ ফাইভ দিয়ে কাজে আসবে না। আমাদের দরকার কর্মোপযোগী শিক্ষা-কাজের উপযোগী গ্রাজুয়েট, যারা আউটপুট দিতে পারবে। শুধু গোল্ডেন হলে হবে না।

আমাদের শিক্ষার প্রত্যেকটা ক্ষেত্র স্পেশালাইজড হওয়া দরকার। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে খুবই ভালভাবে করা দরকার। একদিকে যেমন যুগোপযোগী একাডেমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে পাশাপাশি নৈতিকতা-মূল্যবোধও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ম দিতে হবে। সেই শিক্ষাটাই বেশি জরুরি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে লোক এনে আমাদের দেশে তাদের কাজ করায়। আমরা যদি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারি তবে তারা কেন বিদেশ থেকে আনবে?

‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে’

রিজাউল করিম: দেশে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার লেখা-পড়ার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত কি না?

মো. মোশাররফ হোসেন: আমাদের দেশ মানব সম্পদের ব্যবহারে বেশ পিছনে পড়ে আছে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর পড়াশোনার সুযোগ আগে ছিল না, কিন্তু এখন আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানবসম্পদ বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছে। বর্তমানে সব বিশ্ববিদ্যালয়েও এর উপর ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানেও স্নাত্নকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছি।

আমরা ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা চালু করেছি । আমরা ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডভ্যান্স সার্টিফিকেট কোর্স চালু করেছি। প্রতি ১৫ দিনে একটা করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি আমাদের মেম্বরদের জন্য। বছরে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করি বিআইসিসিতে। এতো সবের পরেও বলবো বাইরের যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ বিষয়ে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ অনেক কম। তবে ধারা যেহেতু চালু হয়েছে এটা অগ্রসর হবেই বলে আমি বিশ্বাস করি।

রিজাউল করিম: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় লেখা-পড়া শেষে দেশে ও বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার সম্ভাবনা কতটুকু?

মো. মোশাররফ হোসেন: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় উজ্জল ক্যারিয়ার গড়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। এটা নতুন পেশা। দেশে ও বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ের গ্রাজুয়েটদের চাহিদা রয়েছে। দেশের মান্টিন্যাশনাল ও লোকাল কোম্পানিগুলো এখন মানবসম্পদ বিভাগের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মানবসম্পদ বিষয়ে পেশাদার ব্যক্তি চাচ্ছে। আমাদের এখানের সদস্যারাই কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তবে এ বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য গুণসম্মত শিক্ষা অবশ্যই দরকার। সাধারণত বিবিএ, এমবিএ করা শিক্ষার্থীরাই এ বিষয়ের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে সব বিষয়ের শিক্ষার্থীরাই এ বিষয়ে ক্যারিয়ার গঠন করতে পারে। এছাড়া এ বিষয়ে পড়াশুনা করতে বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। সব বয়সী মানুষ পড়তে পারে।

রিজাউল করিম: দেশের অর্থনীতিতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকদের অবদান রাখার সুযোগ কতটুকু?

মো. মোশাররফ হোসেন: একটি প্রতিষ্ঠানের জনবল যত বেশিই হোক না কেন, যদি তাদের প্রকৃতভাবে প্রশিক্ষত করে তোলা না যায় তাহলে তারা জনশক্তিতে পরিণত হবে না। আর জনশক্তি না থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান ভালো মুনাফা করতে পারবে না। এ কারণে মানবসম্পদকে যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তবে সেটা ভালো হয়। আর প্রতিষ্ঠানের ওই লোকজনকে দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজটি করে মানবসম্পদ বিভাগ। সুতরাং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে।

রিজাউল করিম: দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এইচআরকে কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে?

মো. মোশাররফ হোসেন: আমাদের দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানবসম্পদে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান তেমন দেয় না। এ কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানে লোকসানের হার বেশি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৯০ শতাংশ লোক কাজ করে। তাদের নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষিত করা- এসব দিক দেখে মানবসম্পদ বিভাগ। সরকারি প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ কম। তারা দক্ষজনশক্তির অভাবে একজনের কাজ ৫ জনকে দিয়ে করাচ্ছে। এ কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক পিছনে পড়ে আছে।

রিজাউল করিম: বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ে নিয়ে যেতে হলে কী করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: বাংলাদেশের মানবসম্পদ ছাড়া আর তো কোন সম্পদ ওইভাবে নাই। গ্যাস আছে আবার শুনি শেষ হয়ে যাচ্ছে, তেল আছে শুনি কিন্তু আমরা সন্ধান করতে পারছি না। জমি আমাদের যা আছে বাড়ানোর সুযোগ নেই। সব দিকে সীমাবদ্ধতা কিন্তু একদিকে সম্ভাবনা সেটি হচ্ছে মানবসম্পদ। আমি মনে করি বাংলাদেশকে যদি মধ্যম আয়ে নিয়ে যেতে হয় তাহলে দরকার দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা। এটা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে একদম উন্নত দেশে নিয়ে যেতে পারবে। এখন আমি মনে করি এটাকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিএসএইচআরএম- এর মত ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ কিছু করা সম্ভব নয়। এখানে আমাদের অবশ্যই সবার সহযোগিতা চাই। সরকারি বেসরকারি যত প্রতিষ্ঠান আছে, যত মানুষ আছেন সবার সহযোগিতা দরকার। তাছাড়া কিছু হবে না।

রিজাউল করিম: জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে সরকারের সুদূরপ্রসারী কোনো পদক্ষেপ কিংবা পরিকল্পনা আছে কী না?

মো. মোশাররফ হোসেন: সরকারের উচিত হবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আমরা আছি, পেশাজীবী সংগঠন মিলিয়ে একটা আলেচনার দ্বার খোলা। বলছি না যে, এখনি করে ফেলেন, কীভাবে করা যায় সবাইকে নিয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। একটা সময় জনসংখ্যাকে আমরা বোঝা বলেছি। এখন আর মুখে বোঝা বলছি না কিন্তু বোঝ তো রেখে দিয়েছি। আমাদের যতগুলো দূতাবাস আছে তাদের যদি টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয় যে, তুমি যেদেশে আছো সেই দেশের একটা অ্যাসেসমেন্ট করে রিপোর্ট পাঠাও। ওই দেশে বাংলাদেশের কোন ধরনের লোক গিয়ে কাজ করতে পারে, সেইভাবে এখান থেকে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করে লোক পাঠাতে পারি। আমাদের একটা মাইলস্টোন থাকতে হবে, আমরা কবে করবো।

রিজাউল করিম: এইচআর নিয়ে সরকার কাজ করতে চাইলে আপনারা কী ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: এইচআর নিয়ে রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক নেই। সরকার যদি এইচআর নিয়ে কিছু করতে চায় উন্নত বিশ্বের মত, আমাদের সংগঠন থেকে ফ্রি সার্ভিস দেবো। আমাদের কোনো পদও দিতে হবে না, পয়সাও দিতে হবে না।

রিজাউল করিম: সংগঠন করার পর সরকারিভাবে কী ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: আমাদের তো উদ্বোধনই করলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি। তবে সরকারের কোন পৃষ্ঠপোষকতা পাই নি। আমরা ট্রেনিং করিয়ে বা মেম্বারশিপ থেকে যা পাই তাতে সরকারকে ভ্যাট ট্যাক্স ঠিকমতই দেই। কোনো সুবিধা পাই নি। কোন জায়গা, অফিস বা অনুদান- বরাদ্দ কিছুই পাই নি।

রিজাউল করিম: সংগঠনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মো. মোশাররফ হোসেন: ২০২১ সাল তো সরকারের একটা মাইলফলক। মানবসম্পদ উন্নয়নে একটা ফ্রেমওয়ার্ক এবং নীতিমালা হোক এবং সরকার তা একা না করে আমাদেরও যেন যুক্ত করে।

রিজাউল করিম: তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন?

মো. মোশাররফ হোসেন: ত্বরুণদের উদ্দেশ্য বলবো পৃথিবীর সবকিছু পরিবর্তনশীল। তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে; কি পরিবর্তন হলো এবং কেনো হলো- এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। শেষ কথা হচ্ছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে। একজন মানুষ যখন পড়ালেখা করছে, কেন পড়ছে? সে সম্পর্কে বুঝতে হবে। ভাবানায় আনতে হবে তার লেখা-পড়া যেন কর্মমুখী হয়।

আসলে আমরা অনুকরণ ও অনুসরণ করে থাকি অর্থাৎ অন্যে এই বিষয়টি নিয়ে পড়ছে তাই আমাকেও একই বিষয় নিয়ে পড়তে হবে। মা-বাবা’র ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সন্তানের ওপর। অন্যের ইচ্ছা নয়, প্রত্যেক মানুষের নিজের একটি জায়গা প্রয়োজন। যেখানে সে নিজেকে প্রাধান্য দেবে। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবে। নিজেকে জানার চেষ্টা করবে। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাটা বেছে নেবে। আমরা কি করছি, কেন করছি সেটা জানতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তির খারপ দিকগুলোতে সময় না দিয়ে গঠনমূলক ও প্রয়োজনীয় দিকে সময় দিতে হবে।

রিজাউল করিম: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. মোশাররফ হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

**‘‘মো. মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (বিএসএইচআরএম) ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের (বিএসএইচআরএম) সভাপতি। এশিয়া প্যাসিফিক ফেডারেশন অফ হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের সভাপতি এবং ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ পিপল ম্যানেজমেন্ট আ্যাসোসিয়েশনের বোর্ড সদস্যও তিনি। এ মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ আইসিডিডিআরবি’র হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের প্রধান। মানবসম্পদ উন্নয়নে অবদান রাখায় তিনি একাধিককার পুরস্কৃত হয়েছেন। এরমধ্যে আছে বিএসএইচআরএম এর আজীবন সম্মাননা পুরস্কার, এশিয়া প্যাসিফিক এইচআরএম কংগ্রেসের দেওয়া গ্লোবাল এইচআর লিডারশীপ পুরস্কার।’’

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত