শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

প্রাণবন্ত এক বিদেশিনী

প্রাণবন্ত এক বিদেশিনী

নাসের রহমান, ১৪ অক্টোবর, এবিনিউজ : মেয়েটির সাথে পরিচয় ভিন্নভাবে। একেবারে অন্যরকম পরিবেশে। আগে কখনো ভাবা যায়নি এরকম পরিবেশে এর সাথে পরিচয় হবে। পরিচয়টা হয় হঠাৎ করে। দেশের বাইরে একটি সেমিনারে। এখানে যে এরকম একটি মেয়ের খোঁজ পাবে সে ভাবতে পারিনি। মেয়েটি হাসি খুশী। তবে চঞ্চল না, অনেকটা ধীর স্থির। গায়ের রং ফর্সা নয়, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের। তেমন লম্বাও নয় আবার বেটেও না। আশে পাশের দেশে এরকম মেয়ের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে এতদূরে এসে এরকম একটি মেয়ে তার পাশে বসবে তা জানা ছিল না। মেয়েটি দেখতে অনেকটা বাঙালি মেয়ের মতো। এখানে বাঙালি থাকার কথা নয়। বহুকাল আগে সাদারা এসেছে এদেশে। কালোরা আছে আদিকাল থেকে। সাদা আর কালো মিলেমিশে বসবাস করছে। একসময় সবকিছু সাদাদের হাতে ছিল। এখন আর তেমন নেই। কালোরা এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। তবে এ শহরে কালোর চেয়ে সাদার সংখ্যা এখনো বেশি। সাদারা একবারে ধবধবে সাদা নয় চাঁদের আলোর মত রূপালী সাদা। এখানে বহুকাল ধরে থাকতে থাকতে তাদের গায়ের রং এরকম রুপালি চাঁদের মত। আবার কালোরা এত কালে যেন রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারকেও হার মানায়। যেমন স্বাস্থ্য তেমন লম্বাও অনেকে। তবে বেশিরভাগই মোটাসোটা। এতে এদের কোন চিন্তা নেই। এটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক। এরকম শরীর নিয়ে তারা স্বাচ্ছন্দে কাজ কর্ম করে। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সহজে আরেক জনের সাথে কথা বলে, মিশে যেতে পারে। অপরিচিত জনকেও সহজে আপন করে নিতে পারে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সাদা আর কালোর মধ্যে কোন বিভেদ খুঁজে পায় না। সাদার চেয়ে কালোরা আরো বেশি প্রাণবন্ত। আরো বেশি কাছাকাছি আসতে পারে। কিন্তুু এ মেয়েটি সাদাও না আবার কালো না। সাদা আর কালোর মাঝামাঝি যাকে ফর্সা বলা যায় না। গৌর বর্ণও না। অনেকটা শ্যামবর্ণ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। মুখটা যেন লাবণ্যে ভরা।

এশিয়া আফ্রিকার বারটি দেশ থেকে এসেছে এরা। মোট ত্রিশজন অংশগ্রহণকারী। ষোলজন মেয়ে চৌদ্দজন ছেলে। ভারত বাংলাদেশ শ্রীলংকা মরোক্কো থেকে কোন মেয়ে আসেনি। ইন্ডিয়া থেকে যে মেয়েটি এসেছে সে অংশগ্রহণকারী না। সহকারী কোর্স কো–অর্ডিনেটর। এটি গৌর বর্ণের। ছিপছিপে গড়ন। চোখ দুটি মায়ায় জড়ানো। সেমিনারের সবাইকে নানা ধরনের সহায়তা দিয়েছে। সবার মোবাইল নম্বর, ই–মেইল এ্যাড্রেস সংগ্রহ করেছে। নাম ঠিকানা এন্ট্রি করেছে। সবার ছবিও তুলেছে। প্রথম দিন শুরুতে নাম এন্ট্রির সময় সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে নিজের নাম বলে পরিচিত হয়েছে। মেয়েটির নাম পুনা। কম বয়সী বলে মেয়েটিকে সবাই নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। মেয়েটিও কাজে সহায়তা করেছে। কোর্স সমন্বয়কারী প্রথম দিন ছিল, পরের দিন থেকে শুরু হওয়ার সময় এসে চলে গিয়েছে। কিন্তুু পুনা মেয়েটি সারাক্ষণ কোর্সের সাথে থেকেছে। কার কি প্রয়োজন সেটা মেটাতে চেষ্টা করেছে। অংশগ্রহণকারী ষোলজন মেয়ের মাঝে অধিকাংশ কালো। গায়ের রং কালো হলে কি হবে এরা খুবই স্মার্ট। নিজেদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করে সবার মনোযোগ ওদেরদিকে চলে যায়। খুব সুন্দর ইংরেজি বলতে পারে। কোন কিছুতে জড়তা নেই। সবকিছুতে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত আর প্রাণবন্ত। সাদা মেয়েরা এদের পাশে বসে আছে। এতে এদের কিছু যায় আসে না। এরা নিজেদের মত সব কিছুতে অংশ নিচ্ছে। সাদারাও কিন্তু চুপচাপ নেই। এরাও যে কোন বিষয়ে মতামত দিচ্ছে। আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। তবে ছেলেরা এখানে কিছুটা চুপচাপ ধরনের। আফ্রিকার আশে পাশের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছেলেরা মেয়েদের মত এত ছটফটে নয়। অনেকটা ধীর স্থির। কিছু জানতে চাইলে উত্তর দিচ্ছে। নিজ থেকে খুব একটা অংশ নিচ্ছে না। এশিয়ানরা প্রথমে বসে বসে শুনেছে দেখেছে, এখন তারাও সেমিনারকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

রিসোর্স পারসন একটি টপিক্স এর অবতারণা করে প্রশ্ন আশা করেন। তখন বাঙালির মত দেখতে মেয়েটি হাত একটু উঁচু করে টেবিলে রাখে। তার এ হাতে রুপালি বর্ণের কারুকাজে ভরা একটি বেচলেটের মত। তার উপর কয়েকটি সাদা পাথর জ্বলজ্বল করছে। উপরের দিকে ছোট একটা হাতঘড়িও বসা আছে। হাতের আঙুলে দু’টি আংটি, কানে পাতলা দুল এবং গলায় একটি হালকা চিক। সবগুলোর রং রুপার মত। হাত তুলতে দেখে রিসোর্চ পারসন কিছুটা খুশি হয়ে এর দিকে আঙুল দিয়ে বলেন, ইয়েস, ইউ ক্যান স্যা। সে দাঁড়িয়ে বলতে চেষ্টা করে। তিনি বসে বসে বলতে বলেন। সে গুছিয়ে খুব সুন্দর করে ইংরেজিতে তার মত প্রকাশ করে। এতে রিসোর্স পারসনের কাছে দু’একটা প্রশ্নও রেখে যায়। তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর আগে অন্যদের কাছ থেকে নিতে চান, তারপর দেন। এভাবে মেয়েটি প্রথম দিনই সবার দৃষ্টিতে এসে যায়। অন্যরাও অনেকে প্রশ্ন করেছে। কিন্তু মেয়েটির মত নয়। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা প্রশ্ন বেশি করেছে।

রিসোর্স পারসন মহিলা যিনি তিনি কোরিয়ান। তার বলার স্টাইলটা একেবারে ভিন্ন। দেখতে একটু ছোট খাট ধরনের হলে কি হবে যখন কথা বলতে শুরু করেন তখন মনে হয় সিএনএন চ্যানেলে কেউ প্রেজেন্টশান দিচ্ছে। নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন সবাই যেন ধীরে ধীরে তার কথার মাঝে ডুবে যেতে থাকে। আসলে কথা বলা একটা বড় আর্ট। একে যারা যত বেশি রপ্ত করতে পারে তত বেশি প্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন দেশে এসব সেমিনারে তারা রিসোর্স পারসন হিসাবে বক্তৃতা দিয়ে অংশ গ্রহণকারীদের অনুপ্রাণিত করে তোলে। একটি সেমিনার বা ওয়ার্কসপকে সার্থক করে তুলতে রিসোর্স পারসনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর করে বিষয়টি উপস্থাপন করা না হলে পুরো সেমিনারটা আর অর্থবহ হয়ে উঠে না। রিসোর্স পারসনের ওপর নির্ভর করে অন্যদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এ সেমিনারটা অনেকটা সেরকমই। ছেলে মেয়েরা যে যেদেশ থেকে আসুক না কেন এখানে আসার পর এরা যেন একই রকম আচরণ করছে। একে অন্যের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শেয়ার করছে। একে অপরের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেমিনারকে প্রাণবন্ত করে তুলছে।

সেমিনারে আট দশজন করে রাউন্ড টেবিলের চারদিকে গোল করে বসে।পাশের সিট থেকে মেয়েটি তার হ্যান্ডব্যাগটি তুলে জায়গা করে দেয় এবং হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে নিজের নাম বলে ‘রাজনীতি’। নামটা শুনে সে কিছুটা অবাক হলেও নিজের নামটাও বলে মজিদ শেখ। শুনে মেয়েটিও বলে ‘শেখ’। ভেরি এ্যারোস্টোকেট নেইম। সে মাথা নেড়ে বলে নাম না টাইটেল। মেয়েটি বলে, তুমি শেখ ফ্যামিলি। সে মাথা নেড়ে কিছুটা সায় দিয়ে বলে, হ্যাঁ। মেয়েটি এবার বলে, শেখ মুজিব তোমার কি হয়? মজিদ কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, হি ইজ আওয়ার গ্রেট লিডার।ইয়েস আই নো, ফাউন্ডার অব বাংলাদেশ। হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো,তিনি আমাদের ফাদার অব দি নেশান। মেয়েটি এবার বলে, তোমরা তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছো। মজিদ হতবাক হয়ে যায়। খানিক নিঃশব্দে থেকে বলে,কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটায়।পরিবেশ হঠাৎ ভারী হয়ে যায়। দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।একটু পরে মেয়েটি বলে,আমার নাম মনে আছে তো। হ্যাঁ, ‘রাজনীতি’। মেয়েটি একটু হেসে বলে ইয়েস, আইমিন পলিটিক্স। এভাবে দুজনের পরিচয় হয় সেমিনার শুরু হওয়ার সময়। দুজন পাশাপাশি বসাতে সেমিনার চলাকালীন সময়েও টুকটাপ আলাপ হতে থাকে। প্রথম দিকে মজিদ খুব একটা সায় দেয়নি। নিজেকে ফ্রি করতে পারে নি। এমনিতে ইংরেজি বলতে তার একটু জড়তা আছে। টি ব্রেকের সময় মেয়েটি বলে বসে, কি মজিদ তুমি এত চুপচাপ কেন? সেমিনার শুরুতে সবার পরিচয় বলতে হয়। নাম, পদবী, প্রতিষ্ঠানের নাম এবং দেশের নাম বলে সবার সাথে পরিচিত হতে হয়েছে। তবে এতে খুব একটা পরিচয় হয়ে উঠে না যদি পরবর্তীতে আলাপ না হয়। এখানে আলাপের বেশ সুযোগ আছে। যে যেখানে কাজ করছে বিশেষ করে হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে কথা বলার অনেক সুযোগ। এখানে যারা এসেছে তারা সবাই এ ডিপার্টমেন্টের কর্তাব্যক্তি। মানবকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায় এবং এখান থেকে কি করে লিডারশীপ তৈরি করা যায় তার ওপর এ সেমিনার। আসলে সেমিনার না বলে ওয়ার্কসপ বলা সমীচীন। সেমিনারে যারা বক্তা শুধু তারাই কথা বলে। অংশগ্রহণকারীরা শোনে। এখানে সবার কথা বলার সুযোগ রয়েছে। অংশগ্রহণকারী সহজে প্রশ্ন করতে পারছে এবং নিজেদের মতামত দিতে পারছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মেয়েটি তার প্রতিষ্ঠানের কাজ করতে গিয়ে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এসব একের পর এক সুন্দর করে তুলে ধরে। রিসোর্স পারসন অন্য অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে এসবের উত্তর বেরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। এতে সবার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। তাদের থেকে উত্তর নিয়ে নিজের মতামতটি যুক্ত করে। প্রশ্ন উত্তরের মধ্যে দিয়ে সেমিনারটি এগিয়ে যায়।

দুপুরের লাঞ্চটা হোটেলের নীচ তলায় হয়। হোটেলটি এ শহরের খুব ঐতিহ্যবাহী, নামকরা হোটেল। ইন্ডিয়ান স্থাপত্যে নির্মিত হলেও ডেকোরেশন একেবারে আধুনিক। সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা এখানে রয়েছে। খুব ভালো লাঞ্চের আয়োজন করে। তৃপ্তি সহকারে সবাই খেতে পারে খাওয়ার টেবিলেও এরা কয়জন একই টেবিলে বসে। খাওয়ার রুচি নিয়ে কথা উঠে। কেউ কেউ ফিস খাওয়ার তালিকায় এক নাম্বার আইটেম বলে। আবারা অনেকে মিট ছাড়া খাওয়া হয় না বলে জানায়। সবার প্রিয় কিন্তু স্যূপ আর ভেজিটেবল। তবে এসব হোটেলে মাছ মাংস ছাড়াও অনেক পদের খাবার ম্যানু আছে তা অত্যন্ত রুচিসম্মত। অনেকে তাই মাছ মাংস বাদ দিয়ে এসব খাবার পছন্দ করে। অবশ্য এখানে সরাসরি মাছ মাংস রান্না করে পরিবেশন করা হয় না। এসবের নানা ধরনের রেসিপি করে পরিবেশন করা হয়। এর স্বাদও আলাদা, খেতেও ভাল লাগে। খাওয়ায় কিছুটা বৈচিত্র্য আসে। রাজনীতি প্রায় সবগুলো আইটেমের নাম বলে এসবের টেস্ট সম্পর্কেও ধারণা দেয়। মাশরুমটা এখানে সবার প্রিয় খাবার। সবাই এটা পছন্দ করে।

লাঞ্চের পর বিকেলের সেশনটা বেশি একটা জমেনি। সোয়া একঘণ্টা চলে। টেবল মাউন্টেনে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুতি নেয়। এ শহরে এলে টেবল মাউন্টেন না দেখে কেউ যায় না। এরা একসাথে যেতে চাওয়ায় কোর্স কো–অর্ডিনেটর একটা বাসের ব্যবস্থা করে। বাসটি নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। লাল রঙের খুব সুন্দর বাস। পাঁচটার মধ্যে ওখানে পৌঁছতে হয়। নতুবা উপরে উঠা যায় না। সবাই তাড়াতাড়ি করে নেমে পড়ে। এখানে এরকম বেশিক্ষণ গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এটা একটি লম্বা বাস যেখানে ত্রিশ জন সহজে বসতে পারে। লাল রঙের বাসটিতে নানা রকম কার্টুন। গাড়িতে উঠে এদের একটা হালকা হয়ে যায়। কার্টুন শিশুদের আনন্দ দেয় এখন বড়দেরও দিচ্ছে। সবাই উঠে বসার পর গাড়ি স্টার্ট দেয়। রিসোর্স পারসন ও সহকারী কো–অর্ডিনেটর পুনাও উঠেছে। পুনার ড্রেসটা সর্টকাট। স্কার্ট পরেছে সে। তাকে আরো ছোট দেখাচ্ছে। এটাতে সে আনন্দ পায়। শহরটাএভাবে ঘুরে দেখা হয়নি। গাড়িতে বসে তারা বাইরে দেখে। শহরটি পুরানো কিন্তু দেখলে মনে হয় আধুনিক একটি শহর। বড় ছোট উচু নীচু বিল্ডিং সবকিছু যেন পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের ঢালকে ঠিক রেখে এসব দালান কোঠা গড়ে উঠেছে। ওয়েল স্ট্রিট থেকে বের হয়ে বাস সী পয়েন্টের কাছাকাছি আসতে সবাই সমুদ্রের ছোঁয়া পেতে শুরু করে। এরা দুজন পাশাপাশি সিটে বসেছে। মজিদ শেখ কথা বলতে পারছে না। রাজনীতি এটা সেটা চিনিয়ে দিচ্ছে। এতো সাগর নয় মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর যার কোলে গড়ে উঠেছে কেপটাউন শহর। আর মহাসাগর তীরে দাঁড়িয়ে আছে টেবিল মাউন্টেন। প্রকৃতির সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য। এ মাউন্টেন দেখার জন্য এত পর্যটক ছুটে আসে এখানে এ কেপটাউনে। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে বাস এগিয়ে যাবে উঁচু নিচু পথ বেয়ে। এরা যেন বাসের ভেতর থেকে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। যেদিকে তাকায় যেন অপরুপ সব দৃশ্যাবলি। সমুদ্রের জলে সূর্যের আলো এমনভাবে পড়েছে যেন হীরক খণ্ড টুকরো টুকরো করে পড়ছে। চোখ ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। আর পাড়ের দিকে তাকালে মনে হয় কত অবিচল অনন্তকাল ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন পাহাড়ের ছুড়া আকাশের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছে গেছে। টেবল মাউন্টেনে উঠার আগে দুই পাশের সৌন্দর্যে সবাই বিভোর হতে থাকে।

এদের টিকেট আগে বুকিং দেয়া আছে। মাউন্টেনের কাছে এসে দেখে গাড়ির লাইন হয়ে আছে। তার চেয়ে বেশি লম্বা লাইন টিকেট কাউন্টারে। ভাগ্য ভাল এরা টিকেট পেয়ে যায়। তবে লাইনের বাইরে কেউ টিকেট নেয় না। কয়েক কাউন্টারে টিকেট দেয়া হয়। তাই লাইটা লম্বা হলেও সময় বেশি লাগে না। টিকেট পাওয়া গেলেও কিন্তু এখানে ক্যাবল কারে উঠার লাইন কয়েকটা। এখানকার লাইনটা সহজে এগোয় না। বিকেলের রোদটা ধীরে ধীরে মিষ্টি হয়ে উঠেছে। বয়স্ক অনেকে আছে। কেউ কেউ মাথার উপর হাতের ছাতা খুলে ধরেছে। বিশেষ করে মেয়েরা। লাইনটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। বামদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের বিশাল জলরাশি আর ডান দিকে টেবল মাউন্টেন। যেদিকে তাকায় যেন চোখ ফিরে আসতে চায় না, দৃষ্টি সীমা আরো দূরে চলে যেতে চাই। রোদের তীব্রতা তখন আর মনেই থাকে না। সবাই যেন লাইনে দাঁড়িয়ে দুপাশের এ অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করে। ক্যাবল কারও কয়েকটি। একটি উপরে উঠলে আর একটি নামে। উপরের উঠার দৃশ্যটা সত্যি দেখার মত। এত উপরে ক্যাবল কারটি তার বেয়ে বেয়ে যেন উপরে উঠে যাচ্ছে। এদের ত্রিশ জনের গ্রুপটি একসাথে লাইন ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। রাজনীতি এখানেও আশে পাশের জনকে এটা সেটা চিনিয়ে দিচ্ছে। মজিদ শেখ তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটছে। তাকে প্রশ্ন করতে হচ্ছে না। সে নিজে থেকে একের পর এক বলে যাচ্ছে। সবাই যেন তার কথা কান দিয়ে শুনছে কিন্তু তাদের চোখ যেন ওই দূরের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের সাথে দোল খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিছুদূর যাওয়ার পর কয়েক ধাপ সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরের দিকে উঠতে হয়। দ্বিতল স্থাপনাটিতে এসে ক্যাবল কার নামে। পাশে ওয়েটিং এর মত করা আছে। এখানে দাঁড়িয়ে ক্যাবল কারে উঠার জন্য অপেক্ষা করে। এখান থেকে মাউন্টেনে ক্যাবল কার কীভাবে উঠেছে তার ছবি তোলা যায়। অনেকে মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোন গাইড তার দলের লোকজনদের উপরে উঠলে কি কি করবে এসব বলে দিচ্ছে এবং ক্যাবল কারে উঠার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। তবে এখানে বেশিরভাগ পর্যটক গাইড ছাড়া আসে। এখনকার নিয়মকানুন এত সুশৃঙ্খল গাইডের প্রয়োজন পড়ে না। ক্যাবল কারে একসাথে প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন দাঁড়াতে পারে। গ্লাসে ঘেরা এই ক্যাবল কারে উঠার পর মনটা যেন আরেক রকম হয়ে যায়। ছাড়ার আগে মিউজিক বাজে তাদের জাতীয় সঙ্গীতের মিউজিক। এখানকার লোকজন এ মিউজিকের সাথে গাইতে থাকে। খুব চমৎকার সুর যেন কানের ভিতর ঢুকে হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। রাজনীতি গানের কথার অর্থ বুঝিয়ে বলে। ক্যাবল কার উপরের দিকে উঠতে থাকে। মনে হয় মাটির পৃথিবীকে ছেড়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। এখান থেকে আটলান্টিক মহাসাগর আর শহরটি অপূর্ব দেখায়। যতই উপরে উঠে মাউন্টেনের ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠে। পঞ্চাশ কিলোমিটার উঠতে একটু সময় লাগে। নিচের দিকে তাকালে কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। আবার দূরে তাকালে যেন ভয়টা কেটে যায়। মনটা আনন্দে ভরে উঠে। যত উপরে উঠে বড় বড় বিশাল আকারের পাহাড় চোখে পড়ে। এসবের উপর যেন পর্বতটি দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাবল কারটি উঠতে উঠতে একটি বিন্ডিং এর সামনে এসে লাগে। নীচ থেকে এ বিল্ডিংটা ছোট একটা ঘরের মত দেখায়। এটা একটা দ্বিতল বিল্ডিং এমনভাবে তৈরি করেছে ক্যাবল কারটি সহজে এসে এখানে বসে যায়। দরজা খুললে এরা সবাই নামতে শুরু করে।

এরা মাউন্টেনের উপর দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। এ যেন প্রকৃতির সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য। এখানেও পর্যটকদের বিনোদনের জন্য বেশ কয়েকটি পাথরের স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

পাথরকে কেটে ছোট বড় তাক করে করে অনেকটা পার্কের মত করা হয়েছে। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় উঁচু নিচু পাহাড় আর পাহাড়। কোনটা এত নিচু যেন তলাটা আর দেখা যায় না। পাহাড় আর শেষ হয় না। পাথরের পাহাড় কিছু কিছু গাছ পালাও চোখে পড়ে। ধুসর বিবর্ণ পাহাড় দৃষ্টি সীমানার বাইরে যেন নীলিমায় ঢেকে আছে। বিশাল এ পর্বতের উপর পাথর কেটে কেটে পায়ে হাঁটার পথ করেছে। কোন কোন জায়গাকে চেঁচে চুচে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যে পর্যটকেরা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে সুন্দর ভিউগুলো দেখতে পারে। এরা হাঁটতে থাকে। রৌদ্রের তীব্রতা এখন আর তেমন নেই। বাতাস থাকায় যেটুকু আছে তাও যেন গায়ে লাগছে না। অনেক পথ হেঁটে যায়। এখানে ছোট ছোট কাটাযুক্ত গুল্মে ভরা। অনেকটা সবুজ। পথের দুধারে বেশি করে লাগানো যেন পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুলেছে। অনেকটা সমতল পথ ধরে হাঁটতে থাকে। একটু উঁচু জায়গাটা খানিকটা ওয়ালের মত দেখায়। এখানে এক ধব ধবে সাদা তরুণী কুচকুচে কালো এক তরুণকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। চিক চিকি করণে চাঁদের মত মেয়েটি যেন কালো একখণ্ড মেঘের উপর ভাসছে। টগবগে কালো ছেলেটি মেঘখণ্ড হয়ে চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে। মনে হচ্ছে এখানে এসে তারা অনন্ত এক সুখ খুঁজে পেয়েছে।

এরা পাশ দিয়ে হেটে যায়। সবার দৃষ্টিতে পড়লেও কেউ কোন মন্তব্য করে না। পাথরের এ পর্বতমালা এতই বৈচিত্র্যময় যেন তা দেখে শেষ করা যায় না।রাজনীতি মজিদ শেখের দিকে তাকিয়ে বলে, এরা অনেক দিন থেকে ভেবেছে এখানে এসে পুরো দিনটা এভাবে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে থাকবে। সাদা তরুণীদের এক তীব্র আকাঙক্ষা কালো তরুণদের পাওয়ার সাদা কলোর দ্বন্দ্বে তা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কালোদের ইচ্ছা থাকলেও তা প্রকাশ করতে পারে না। আগে যে রকম কড়াকড়ি ছিল এখন অনেকটা শিথিল। সাদা কালোর বিভেদ অনেকাংশে কমে এলেও প্রেম পরিণয়ের ব্যাপারে সাদারা এখনো রক্ষণশীল। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রেম হলেও পরিণয় সহজে হয়না। মজিদ কোন মন্তব্য করে না। কথাগুলো শুনে যায়। তার একটি পুরানো স্মৃতি জেগে উঠে।কলেজে পড়ার সময় এরকম একটি হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়ের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়। মেয়েটি তার সহপাঠী ছিল। গ্রীষ্মের ছুটিতে মেয়েটি যে বাড়ি গেল আর সফিরে আসেনি। পরে খবর নিয়ে জানতে পেরেছে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী বিদেশে থাকে। বিয়ের পর তাকেও সাথে নিয়ে যায়। এরপর আর কখনো যোগাযোগ হয়নি তার সাথে। দিনে দিনে মন থেকেও মেয়েটি হারিয়ে যায়। আজ আবার হঠাৎ করে তাঁর কথা মনে পড়ে গেল। মজিদ শেখ এসব নিয়ে কোন কথা বললো না। তখন সূর্যের অজস্র রঙিন আলো সমুদ্রের জলরাশিতে অসংখ্য তরঙ্গমালা আর আলোর বন্যায় যেন ভাসিয়ে তোলে। কখনো টুকরো টুকরো হীরক খণ্ড কখনো ঝলমলে আকাশের তারারা যেন সাগর জলে নেমে আসে।এ অপরূপ দৃশ্যে সবাই বিভোর হয়ে যায়। ওরা কোন কথা না বলে হাঁটতে থাকে।

অনেকগুলো পথ এখানে। যে যার মত হেঁটে বেড়াচ্ছে। এ পথগুলোর যে শেষ নেই। কোথায় চলে গিয়েছে ঠিক বুঝা যায় না। যারা সারাদিনের জন্য উঠেছে তারা হয়তো অনেক দূর হেঁটে চলে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে আসে। এরা যে পথ দিয়ে এগিয়ে যায় সেখানে আর ফিরে না। পথগুলো এমনভাবে ঘুরানো যেন ফেরার পথে পাহাড়ের পাশ দিয়ে আসতে হয়। কয়েকটি পাখিও চোখে পড়ে। ধুসর কালো বর্ণের পাখিরা তাদের মত করে বিচরণ করে। এদের খাবার পোকামাকড়। এসবও কিছু কিছু চোখে পড়ে। সরীসৃপ প্রাণীও দেখা যায় বিশেষ করে গিরগিটি। পাশে রেলিং দেওয়া যেন কেউ রেলিং এর বাইরে যেতে না পারে। যেতেও চেষ্টা করে না। বাইরে গেলে যেকোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। তখন আর রক্ষা নেই। এত নীচে যে কোন কিছুকে অতি ক্ষুদ্র মনে হয়। অনেকটা পিঁপড়ার মত। বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ড যেন নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এটাও ছোট খাট একটি পাহাড়। তার সাথে এর চেয়ে ছোট আরো কয়েকটি। সবাই এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। এসব পাহাড়সম পাথর যেন বহুকাল থেকে এভাবে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। প্রলংকারী স্রোত এদেরকে এতটুকু নড়াতে পারে না।

এরা পথে পথে এরকম আরো কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট খুঁজে পায়। এখানে পাহাড়ের উঁচু নিচু আছে। উঁচুতে কেউ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে কেউবা বসে। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালে মনের ভেতর নানা ভাবনা জাগে। এত উঁচু বিশাল পাথরের পর্বত মালার পাদদেশে আটলান্টিক ভিউ পয়েন্ট বেষ্টনী দেওয়া, তাও যেন পাথরের বেষ্টনী। বিদেশী একটি সংস্থা অনেক বছর কাজ করে এ পর্বতকে পর্যটকদের আসার উপযোগী করে তুলেছে। একটি আধুনিক ওয়াশ সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। যেটিতে গ্রীণ পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু’একটা রেস্টুরেন্ট ও প্রয়োজনীয় শপিং সেন্টারও গড়ে উঠেছে। মজিদ শেখ টুকিটাকি কেনাকাটা করে। রাজনীতি তাকে এখানেও সহায়তা করে। আসলে কেউ মনে করে দেশে ফিরে গিয়ে বলবে এসব আইটেম টেবেল মাউন্টেনের থেকে এনেছে। তবে হঠাৎ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায়। এরা গ্রুপে একসাথে আবার কয়েকজন এবং দুজন বারে বারে অনেক ছবি তোলে। তবে সবার ছবি একসাথে সেলফি করে তুলতে হয়। এখানে কেউ কারো দিকে তাকাবার সময় নেই। কেউ কারো মোবাইল বা ক্যামেরায় ছবি তুলে দেবে এমনটি ভাবাও যায় না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে আসে। সূর্যটা একটু পরে সাগরে ডুবে যাবে।এখান থেকে সূর্যাস্তটা অপূর্ব সুন্দর দেখায়। অস্তগ্রামী সূর্য সব রং ছড়িয়ে যেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশিতে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। এরা সবাই এক সাথে বসে অর্পূব দৃশ্যে বিভোর হয়ে যায়। এসময়ে কারো মুখ থেকে তেমন কথা বের হয় না । সবাই যেন এ অপরূপ দৃশ্যে নিমগ্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যটা পানিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু আকাশ জুড়ে সূর্যের রক্তিম আভা যেন ছড়িয়ে থাকে। আকাশের সে রক্তিম আভা সমুদ্রের জলরাশিকে আরেক মায়ার জগতে নিয়ে যায়। এ রক্তিম আভা বেশিক্ষণ থাকে না। ধীরে ধীরে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। সমুদ্রের জলের মায়াও কোথায় হারিয়ে যায়। কালো আঁধারের ভিতর বিশাল জলরাশি আকাশের সাথে একাকার হয়ে যায়। এখান থেকে ফিরে যেতে কোনমতে মন চায় না। অনেকে সারাদিন কাটিয়েও শেষ করতে পারে না। ইচ্ছা না হলেও এদের নিচে নামতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর বেশিক্ষণ থাকা যায় না। অবশ্যই এখানে সন্ধ্যা নামে সাতটার পর।আটটার মধ্যে ক্যাবেল কারে উঠতে হবে।

এরা ক্যাবল কারের কাছে এসে দাঁড়ায়। নামার লোক কম। কিছুক্ষণ সময় লাগে ক্যাবল কার ভর্তি হতে। জাতীয় সংগীত বাজিয়ে ক্যাবল কার নিচে নামতে শুরু করে। এ যেন আরেক রকম অনুভূতি। সবাই একসাথে গাইতে থাকে। মজিদ এতক্ষন চুপচাপ থাকে। রাজনীতি তাকেও গাইতে বলে। সে যেন এর সাথে সুরমেলাতে পারে না। তারপরেও চেষ্টা করে। কিন্তু তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

সেমিনারের শেষ দিনে রাজনীতি সবাইকে চমক লাগিয়ে দেয়।এ কয়দিনে এমনিতে সবার সাথে কথা বলেছে। গ্রুপের সবার সাথে অনেকটা মিশে গিয়েছে। সবাইকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভূদ ক্ষমতা মেয়েটির। তার গ্রুপের জমা দেওয়া এ্যাসাইন্টমেন্টা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। শেষ দিনে তার প্রেজেন্টেশান সবাইকে মুগ্ধ করে। অন্যান্য গ্রুপের সদস্যরা তাকে অনেক প্রশ্ন করেছে। সে প্রতিটি প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর দিয়েছে। এখানে প্রত্যেককে অংশ নিতে হয়েছে। মজিদ শেখ যখন নিজের অংশটা উপস্থাপন করেছে তখন রাজনীতি তাকে অনেক সহায়তা করেছে। শুধু তাকে নয় গ্রুপের অন্যান্যদেরকেও। এতে সবাই যেন তার সান্নিধ্য লাভ করেছে। দু–একজন নিজের মত করে বলতে গিয়ে বেশিদূর এগুতে পারেনি। অন্যরা প্রশ্ন করে থামিয়ে দিয়েছে। গ্রুপের হয়ে রাজনীতি এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। অন্যান্য গ্রুপের সাথেও সে প্রশ্ন উত্তর পর্বে অংশ নিয়ে চমৎকার জওয়াব দিয়েছে। মজিদ শেখের বেশ ভালো লাগে মেয়েটির এরকম পারফর্মেন্সে। মারিসাস থেকে আরো কয়েকটি মেয়ে এসেছে। তারা দেখতে তার চেয়ে অনেক সুন্দর আবার স্মার্টও। তাদের কথাবার্তাও সুন্দর। কিন্তু তারা কেউ এর মত সবার সাথে পরিচিত হতে পারেনি। তাদেরকে হয়তো কেউ আর মনে রাখবে না। কিন্তু রাজনীতিকে সবাই মনে রাখবে। ক্লোজিং সিরেমণিতে সার্টিফিকেট বিতরণের পর সবার পক্ষ থেকে রাজনীতিকে কিছু বলার সুযোগ দেয়। সে চমৎকার করে বলে যায় এ কয়দিনের সেমিনার সম্পর্কে। সবাই যেন নির্বাক হয়ে তার কথা শুনে। সেই কিন্তু তার কথা শেষ করার আগে মজিদ শেখের নাম ঘোষণা দিয়ে আসে।এ ওয়ার্কসপে সবচেয়ে চুপচাপ যে অংশগ্রহণকারী তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই। মজিদ খুব বেকায়দায় পড়ে যাই। এদের মত এতো সুন্দর করে সাবলিলভাবে সে ইংরেজিতে বলতে পারে না। তাই নাম ঘোষণার পর এতক্ষনের আনন্দ কোথায় মিলিয়ে যায়। বুকটা দুরু দুরু করে কাঁপতে থাকে। রাজনীতি যে তাকে এত বিপদে ফেলবে সে ভাবতে পারেনি। এখন কোন উপায় নেই, উঠে কিছু বলতে হবে। রাজনীতি এবার সাহস যোগায়। মজিদ তোমার দেশ সম্পর্কে কিছু বল। মজিদ সত্যি একটু সাহস পায়। সে উঠে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করে। রাজনীতি ওয়ার্কসপ সম্পর্কে বলেছে আমি তার সাথে সম্পূর্ণ একমত। এখন আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমি সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলতে চাই। সবুজ শ্যামল নদী মাতৃক আমাদের বাংলাদেশ। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজের সমারোহ। হঠাৎ মজিদের কণ্ঠের জড়তা কেটে যাই। সে ইংরেজিতে সাবলীলভাবে বলতে থাকে। পৃথিবীর কোন জাতিকে ভাষার জন্য রক্ত দিতে হয়নি। বাঙালি জাতিকে ১৯৫২সালে ২ ফেরুয়ারি তার মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃত। এ ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্দের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। সবশেষে বাংলাদেশের মানচিত্র ও পতাকার মনোগ্রাম খচিত কোটপিন দেখিয়ে বলে, এ লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়।সবাই করতালির মধ্যে দিয়ে মজিদকে অভিনন্দন জানায়। রাজনীতি ওর সাথে হ্যান্ডশেক করে অনেকটা জড়িয়ে ধরে বলে, মজিদ শেখ তুমি অনেক চমৎকার করে বলেছ। আমি তোমার জড়তা ভেঙে দিতে পেরেছি। মজিদ অনেকটা আবেগ প্রবণ হয়ে বলে, রাজনীতি তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। রাজনীতি বলে, তোমার দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবে না। মজিদ মুহূর্ত বিলম্ব না করে বলে, নিশ্চয়; তোমার জন্য বাংলার সবুজ প্রান্তর অপেক্ষা করবে।এবার রাজনীতি বলে তোমার মত আমার একজন বন্ধু দরকার। যার সাথে অনেক কিছু শেয়ার করা যায়। মজিদ কিছুটা বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে মেয়েটির দিকে তাকায়। সে আবার বলে তুমি কি আমার সাথে ফ্রেন্ডসিপ গড়ে তুলবে। মজিদ দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। রাজনীতির দু’চোখের মাঝে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের ছোঁয়া খুঁজে পায়।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত