![দস্তয়ভস্কির নিদারুণ বিশৃঙ্খলায় আমি ঈর্ষাবোধ করি](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/10/15/kajuo-ishiguru_105442.jpg)
ঢাকা, ১৫ অক্টোবর, এবিনিউজ : ২০১৭ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরোর ভূমিকা সম্বলিত এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় বম্ব সাময়িকীর ২৯তম সংখ্যায়। লন্ডনে বসে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন আরেক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক গ্রাহাম সুইফট। এটি অনুবাদ করেছেন বিনয় বর্মন।
কাজুও ইশিগুরো আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড প্রকাশের পর থেকে। এটি ১৯৮৬ সালে হুইটব্রেড বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয় এবং বুকারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায়। বইটি লেখা পূর্বতন সময়কার একজন চিত্রকরকে নিয়ে তিনি পোস্ট–ওয়ার রিভিশনিস্ট কালচারের শিকারে পরিণত হন। তিরিশের দশকের ভুল রাজনৈতিক আদর্শের জন্য তাকে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। বছরের শেষদিকে কনম্ফ থেকে প্রকাশিত দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে প্রায় একই বিষয় নিয়ে রচিত। এখানে গল্পের কথক হিসেবে দেখা মেলে একজন ইংরেজ বাটলারের যিনি তিরিশের দশকের একজন সম্ভ্রান্ত শীর্ষ রাজনীতিকের সেবাকর্মে নিয়োজিত থাকার সময়কার স্মৃতিচারণ করেন।
অন্যদিকে, স্টিভেন্স এক গৌরবময় সৃষ্টি, বাইরে কঠিন, স্পর্শগতভাবে অন্ধ এবং ভেতরে দুঃখভারাতুর। কিভাবে ‘মহৎ’ বাটলার হওয়া যায়, মর্যাদা কী এবং কিভাবে মজা করার দক্ষতা অর্জন করা যায় তা ভেবে ভেবে তিনি হয়রান। ইশিগুরোর নির্মাণশৈলিতে, সংবেদনশীলতার সূক্ষ্ম স্পর্শে তার চরিত্র একদিকে হালকা হাসির খোরাকে পরিণত হয়, অন্যদিকে সে জমাটবাঁধা আবেগের গভীর বিষণ্নতাকে প্রকট করে তোলে। তিরিশের দশকের ব্রিটিশ অ্যান্টি–সেমিটিজমের নিরব পরীক্ষা আছে এই উপন্যাসের মর্মমূলে।
গ্রাহাম সুইফট: আপনার জন্ম জাপানে এবং পাঁচ বৎসর বয়সে আপনি ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। জাপানি লোকজন আপনার ব্যাপারে কী বলে?
কাজুও ইশিগুরো: আমি পুরোপুরি ইংরেজদের মতো নই কারণ জাপানি পিতামাতার ঘরে আমি বেড়ে উঠেছি যেখানে জাপানি ভাষা ব্যবহার করা হতো। এই দেশে যে এতো দীর্ঘ সময় থাকতে হবে পিতামাতা বুঝে উঠতে পারেননি। আমি যাতে জাপানি মূল্যবোধ নিয়ে বড় হই সে ব্যাপারে তারা দায়িত্ব অনুভব করতেন। আমার নিজস্ব পটভূমি রয়েছে। আমি ভিন্নভাবে চিন্তা করি, আমার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন।
গ্রাসু: তার মানে আপনার বাকি সত্তাটা ইংরেজ? আপনি কি নিজেকে ইংরেজ মনে করেন?
কাই: মানুষেরা এমন নয় যে দুই–তৃতীয়াংশ এক রকম এবং বাকিটা অন্যকিছু। মেজাজ, ব্যক্তিত্ব অথবা দৃষ্টিভঙ্গি ওভাবে ভাগ করা যায় না। ওগুলো স্পষ্টভাবে বিভাজ্য নয়। শেষ পর্যন্ত সে এক মজার সমজাতীয় মিশ্রণে পরিণত হয়। শতাব্দীর শেষভাগে এরকম বেশি হয়েছে মিশ্র সামাজিক পটভূমি ও মিশ্র জাতিসত্তার মানুষ। দুনিয়া এভাবেই চলছে।
গ্রাসু: আপনি সমসাময়িক অন্যান্য অনেক ইংরেজ লেখকদের একজন যারা ঠিক এরকম: তাদের জন্ম ইংল্যান্ডের বাইরে। আপনি তাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন? আমি কয়েকজনের কথা ভাবছি: টিমথি মো, সালমান রুশদি, বেন ওকরি।
কাই: আমার অবস্থানের একজন মানুষ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনো দেশ থেকে আসা কেউ দুজনের মধ্যে পার্থক্য আছে। যে ভারতের মতো জায়গা থেকে এসেছে, ব্রিটেনের সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারটা অত্যন্ত বিশিষ্ট ও যারপরনাই পোক্ত। ব্রিটেন তার কাছে মাতৃভূমি এবং আধুনিকতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার উৎস।
গ্রাসু: অন্য প্রান্ত থেকে সাম্রাজ্যের অভিজ্ঞতা। এটা সত্য যে আপনার দুটো উপন্যাসে, যেগুলোকে ঢিলাঢালাভাবে জাপানি উপন্যাস বলা যায়, এ পেইল ভিউ অব হিলস এবং অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড, আপনি জাপানি সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ তুলে ধরেছেন। এগুলো যুদ্ধ–পরবর্তী উপন্যাস। আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস, দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে, যুদ্ধ–পরবর্তী ইংল্যান্ডের পঞ্চাশের প্রেক্ষাপটে রচিত। অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী সময়ের ভ্রান্ত আনুগত্য ও আদর্শ নিয়ে রচিত: তিরিশের দশকের যুদ্ধপূর্ব ব্রিটেন এবং তিরিশের জাপান। এদিক থেকে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
কাই: আমি একটি বিশেষ কারণে এই প্রেক্ষাপট বেছে নিয়েছি: আমার বিষয়বস্তুর জন্য যা বলিষ্ঠ। আমি যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধ–পরবর্তী পটভূমিকার দিকে ঝুঁকে পড়েছি কারণ আমি তার মূল্যবোধ ও আদর্শের পরীক্ষায় আগ্রহী। পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি মূল্য–আদর্শের ধারণাটা তারা যেরকম ভেবেছিলো ঠিক সেরকম নয়। তিনটি বইতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উপস্থিত।
গ্রাসু: দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে–এর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন বাটলার। বাটলারকে সচরাচর লোকজন গোয়েন্দা উপন্যাস, হাসির নাটক, প্রহসন ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেখে। কিন্তু আপনার বাটলার বেশ সিরিয়াস গোছের মানুষ। আপনি এই চরিত্রকে কিভাবে খুঁজে পেলেন?
কাই: সাদামাটা ছোট মানুষের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্কের দিক থেকে বাটলার একটি ভালো উপমা। আমাদের অধিকাংশ লোক সরকার চালায় না কিংবা বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় না। আমাদের ছোটখাটো কাজ করে খেতে হয়: আদর্শের জন্য, চাকরিদাতার জন্য, প্রতিষ্ঠানের জন্য। আমরা চেষ্টা করি ভালোভাবে বেঁচে থাকার। যা ঘটে তা মেনে নিই। এই অবস্থাটা নিয়েই আমি লিখতে চাই। আমার মনে হয়েছে, বাটলার এমন এক চরিত্র যে কাছের কারো সেবা করে কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বহু দূরে। এমন চরিত্রই আমার লেখার জন্য উপযোগী। এর অন্য কারণও আছে যার ইঙ্গিত আপনি দিয়েছেন ব্রিটিশ কালচারে বাটলার এক মিথিক্যাল ফিগারে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত ও কৌতুককর। এটা আমাকে নাড়া দিয়েছে কারণ আমি জাপানি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি। ইংরেজত্বের অনেক কিছু আমার কাছে দূরদেশীয় মনে হয়েছে।
গ্রাসু: তবে আপনি বলতে পারেন বাটলার তার প্রয়োজনের তাগিদে এক দারুণ স্টাইলের অস্তিত্ব বজায় রাখে যা এই চরিত্রের জন্য প্রভূত গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের সঙ্গে এর মিল আছে সেই মর্যাদা, সেবা, জীবন এক ধরনের অভিনয়। অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড–এর জোরালো প্রতিধ্বনি। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মাসুজি ওনো তার মর্যাদা নিয়ে চিন্তিত। স্টিভেন্স অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও অধিক হতভাগা চরিত্র। তার নিজের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে সে মারাত্মকভাবে অন্ধ। মর্যাদাকেই সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আপনি কি মর্যাদাকে পুণ্য মনে করেন?
কাই: আমি ঠিক নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না মর্যাদা কী জিনিস। দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে–এর আংশিক বিতর্ক এটা নিয়েই। যাকে আমরা মর্যাদা বলি স্টিভেন্স তা নিয়েই মগ্ন হয়ে থাকে। সে মনে করে, অনুভূতি না প্রকাশ করার সঙ্গে মর্যাদার একটি সম্পর্ক আছে। আসলে তার মতে, অনুভূতি না থাকাই মর্যাদা।
গ্রাসু: এতে অনুভূতি অবদমিত হয়।
কাই: হ্যাঁ, মানুষ হওয়ার ঊনতা তৈরি হয়। তার কাছে নিজেকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে এনে অনুভূতি অবদমিত করে দায়িত্ব পালন অথবা এমন কিছু যা এমনকি পেশাগত সত্তাকে অপমানিত করে, তাই হলো মর্যাদা। সে অনুভূতিকে দুর্বলতার সঙ্গে এক করে দেখে। বইটি মর্যাদার সেই ধারণা নিয়ে বিতর্ক করে মর্যাদার অন্য কোনো ধারণার বিরুদ্ধে কোনোরকম অনুভূতি না থাকা। নিজের জীবনের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলে তবেই না মানুষের মর্যাদা। গণতন্ত্র সাধারণ মানুষকে মর্যাদা দেয়। পরিশেষে, কেউ দাবি করতে পারে না যে স্টিভেন্স কোনোভাবে মর্যাদা ভোগ করেছে: নির্ভাবনায় যেখানে সে তার সমস্ত আনুগত্য নিয়োজিত করেছে এমন অবস্থার মধ্যে অমর্যাদাকর কিছু রয়েছে, এ ব্যাপারে সে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। এটি এমনি এক আদর্শিক অবস্থান যেখানে তার প্রতিভা কিভাবে ব্যয় হবে সেই নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপারে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
গ্রাসু: আর সেই আদর্শিক অবস্থান এটাই প্রমাণ করে যে, তা যতো সম্মানজনকভাবেই শুরু হোক না কেন, সেটা ভুল।
কাই: হ্যাঁ।
গ্রাসু: অবশ্যই অন্য সমগ্র এলাকা আছে, আরো অধিক চরম ও তীক্ষ্ন পর্যায়ের। স্টিভেন্স প্রাক্তন গৃহপরিচারিকা মিস কেন্টনের সঙ্গে প্রেমের সম্ভাবনাকে পুরোপুরিভাবে অবদমিত করেছিলো। এখন সে তাকে দেখার জন্য এক দুর্লভ ছুটি নিচ্ছে। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। সে অতীতের সেই চরম মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছে। তথাপি তার নীরবতা এটাই প্রমাণ করে যে এতে তার অনুভূতি জড়িত ছিলো। উপন্যাসটি কঠিন একটি জায়গায় সফল হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি এমন এক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যে স্পষ্টভাষী এবং অনেকাংশে বুদ্ধিমান, কিন্তু আত্মবিশ্লেষণ কিংবা আত্মমূল্যায়নের ক্ষমতা তার নেই। এটা এড়িয়ে যাওয়া খুব কঠিন। আপনি কি এটা কঠিন মনে করেছেন?
কাই: শেষদিকে সে তার কাজ নিয়ে কথা বলে কারণ ভেতরে ভেতরে সে জানে কোন জিনিস তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। সত্যিকার অর্থেই, সংকটের জায়গাগুলো বোঝার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি তার আছে, এবং এটা তার বয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আত্মপ্রতারণার ভাষায় বইটি লেখা। সে কেনো ওভাবে কথা বলে, বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ বিষয়ের অবতারণা করে, তা বিক্ষিপ্ত নয়। সে যা উচ্চারণ করে না, সেই উচ্চারণ দ্বারাই এটা নিয়ন্ত্রিত। সেটাই বয়ানের প্রেরণা। যন্ত্রণাকর অবস্থার মধ্যে সে এক সময় টের পায় কী ঘটছে, কিন্তু সে তা সামনে নিয়ে আসে না। এবং তার কিয়দংশে সেই দক্ষতা আছে যাতে সে নিজেকে বুঝিয়ে বলতে পারে, কিছুই হয়নি। আত্মপ্রতারণার কাজটা সে যথেষ্ট স্পষ্টতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করে থাকে।
গ্রাসু: আপনি আত্মপ্রতারণার ভাষার কথা বলছেন। এটা এমন এক ভাষা যা প্রণীত আপনার সকল প্রধান কথক চরিত্রদের জন্য। এটা বিশেষ করে স্মৃতির ব্যর্থতা ঘিরে আবর্তিত। আপনার চরিত্রেরা নিজেদের সুবিধামতো ভুলে যায় অথবা স্মরণ করে। অথবা তাদের স্মরণ ঘটে ভুল প্রসঙ্গে, অথবা তাদের স্মরণে এক ঘটনা আরেক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এটা এক ধরনের সচেতন বা অসচেতন এড়িয়ে চলার প্রক্রিয়া। এই বিষয়টা কতোখানি পরিচিত?
কাই: পরিচিত তাদের কাছে?
গ্রাসু: হ্যাঁ।
কাই: এক পর্যায়ে তাদের জানতে হবে তাদেরকে কী এড়িয়ে চলতে হবে এবং তার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে তারা স্মৃতি ও অতীতের কোন পথ বেছে নেবে। তারা সাধারণত অতীত নিয়ে উদ্বিগ্ন, এটা অস্বাভাবিক নয়। তারা উদ্বিগ্ন কারণ তারা বেঠিক কিছু টের পায়। অবশ্যই স্মৃতি হলো এই মারাত্মক বিপদসংকুল এলাকা, স্মৃতির দ্ব্যর্থকতা থেকেই আত্মপ্রতারণা আসে। কাজেই প্রায়শ আমরা এমন অবস্থা দেখি যেখানে একজনের অতীত ঘটনা বানানোর ক্ষমতা দ্রুত নিঃশেষ হতে থাকে। জীবনের ফলাফল, জীবনের জবাবদিহিতা, সামনে এসে দাঁড়ায়।
গ্রাসু: প্রাক্তন গৃহপরিচারিকা মিস কেন্টনের সঙ্গে দেখা করার পর স্টিভেন্স সাগরতীরে গিয়ে বসে এবং কান্নায় ভেঙে পড়ে। এটা নিজের মুখোমুখি হওয়া, একরকম বিশুদ্ধ হওয়া। কিন্তু এটা সম্ভবত অন্য এক ধরনের মর্যাদার মুহূর্ত। ক্ষতি ও ব্যর্থতা স্বীকারের পর এই মর্যাদা আসে। এই মর্যাদা স্টিভেন্সের হিসাবনিকাশের বাইরে, তথাপি সে তা গ্রহণ করে।
কাই: হ্যাঁ।
গ্রাসু: বেদনার সঙ্গে।
কাই: এটা মানুষ হওয়ার, সৎ হওয়ার মর্যাদা। আমার মনে হয় স্টিভেন্স এবং চিত্রকর ওনোর পক্ষ থেকে আমি এই বিষয়েই আবেদন তৈরির চেষ্টা করেছি। হ্যাঁ, তারা অনেক সময় অহংকারী ও বিরক্তিকর। তারা কদর্য বিষয় নিয়ে চর্চা করে। তাদের পক্ষে যদি কিছু বলার থাকে তবে বলতে হয়, মানুষ হিসেবে তাদের কিছুটা মর্যাদাবোধ আছে এবং অতিশয় বেদনাদায়ক সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যে বীরত্ব আছে।
গ্রাসু: মর্যাদা সম্পর্কে আপনার ধারণা দেখছি বেশ জটিল। যে কেউ বলতে পারে, আপনার শৈলির মধ্যে মর্যাদা আছে। শিল্পী ও লেখকের কিছু চিরন্তন সমস্যা আছে, যা স্টিভেন্সের মতো, জানি না আপনি তা নিয়ে কতোটা ভাবেন। শিল্পের নিজস্ব একটি অন্তর্নিহিত মর্যাদা ও সৌন্দর্য রয়েছে। এটি যখন রাজনীতি বা অন্য কোনো বড় বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তা চমকপ্রদভাবে শিল্পের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড–এর ওনো একেবারে নিখাঁদ অর্থেই একজন চিত্রকর। এই ‘ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ (ভাসমান দুনিয়া)-এর মধ্যে ক্ষণস্থায়ী খাঁটি শিল্পসৌন্দর্য আছে। যখন সে রাজনীতিতে তার প্রতিভা বিনিয়োগ করে, তখন তার জীবনের সবকিছু ভুল পথে চলে যায়। সে কি ভুল করেছে? রাজনীতির সেবায় শিল্পের বিনিয়োগ কি মন্দ? সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে শিল্প সংশ্লিষ্ট থাকবে, এটা কি ঠিক?
কাই: এটা ঠিক যে শিল্পীদের সবসময় এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হয়। একজন লেখক, সাধারণভাবে শিল্পীরা, সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জায়গায় থাকেন। “উচিত নাকি অনুচিত?” প্রশ্ন তা নয়। প্রশ্ন হলো, “কতোটুকু?” কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনটি উপযোগী? আমার মতে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনীয়। এটি নির্ভর করে একজন কোন দেশে বাস করে বা সমাজের কোন ক্ষেত্রে তার বিচরণ। জীবনের প্রতিটি দিন শিল্পী ও লেখকদের এই প্রশ্নটি করতে হয়।
স্পষ্টত, চিরকাল প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ভাবা ও নিষ্ক্রিয় বসে থাকা ঠিক নয়। কোনো এক সময় তাকে বলতে হবে, “আদর্শের নানা খুঁত থাকলে একে সমর্থন করতে হবে কারণ এর বিকল্পগুলো বিপর্যয়কর।” সমস্যা হলো কখন সেটি বিবেচনায় আসবে তা নিয়ে। বিশেষত উপন্যাস লেখাটা যথাযথভাবেই প্রতিশ্রুতির মুহূর্তকে পিছিয়ে দেয়। উপন্যাসের প্রকৃতিই এমন যে এটি প্রচারাভিযানে পারঙ্গম নয়। যদি বিতর্কিত কোনো আইনি বিষয় নিয়ে লিখতে হয়, পত্রিকায় চিঠি কিংবা গণমাধ্যমে প্রবন্ধ লেখা ভালো। উপন্যাসের শক্তি হলো, এটি গভীরতর স্তরে পঠিত হয়; এটি দীর্ঘ সময় ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় পঠিত হয়। উপন্যাসের গঠনের মধ্যেই এমন কিছু আছে যা রাজনৈতিক বিতর্ককে আরো মৌলিক, গভীর ও সর্বজনীন পর্যায়ে অধ্যয়নের উপযোগী করে তোলে। বাস্তুহীনতার বিপক্ষে প্রচারাভিযানে আমি সংশ্লিষ্ট, কিন্তু এই বিষয় নিয়ে আমি কখনোই উপন্যাস লেখার চিন্তা করিনি।
গ্রাসু: আপনি কি নতুন কোনো উপন্যাস লিখছেন?
কাই: চেষ্টা করছি। আমি গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়ে এসেছি। লেখার খসড়া শুধু করতে আমার অনেক অনেক সময় লেগে যায়। আসল লেখা এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই হয়ে যায়, কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্কে লম্বা সময় লাগে। আমি যে বিষয় নিয়ে কাজ করবো তার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। কমবেশি বিষয়বস্তু সম্পর্কে এবং বইয়ে কিসের ওপর জোর দেওয়া হবে তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হবে। চরিত্রসমূহের ব্যাপারেও জানতে হবে।
গ্রাসু: কাগজে কলমের আঁচড় দেওয়ার আগেই।
কাই: হ্যাঁ, লেখালেখির বিষয়ে আমি অত্যন্ত সাবধানী। আমি টাইপরাইটারে সাদা কাগজ ঢুকিয়ে ব্রেইনস্টর্ম করে দেখতে চাই না সেখান থেকে কী বেরিয়ে আসে। আমার সামনে স্পষ্ট মানচিত্র থাকা চাই।
গ্রাসু: বাস্তবে যখন লেখা শুরু করেন তখন কি পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়?
কাই: হ্যাঁ, অধিকতর হারে। প্রথম উপন্যাসের বেলায় অবশ্য কম হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার সময় আমি বিষয়–শৃঙ্খলা শিখেছি। কাহিনী বা গল্পের ধরণ যতোই আকর্ষণীয় হোক, লেখার সময় থেমে যেতে হয়। যদি সামগ্রিক গঠনে তা সহায়ক না হয়, তবে তা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করতে হবে। প্রথম উপন্যাস লেখার সময় আমি দেখেছি কিছু কিছু বিষয় আমি যা আসলে চাই তার বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি এখন সেই ‘প্রতিভাদীপ্ত বিশৃঙ্খলা’ প্রত্যাশা শুরু করেছি যা কোনো কোনো লেখক, আমার ধারণা, মানচিত্রে আঁটকে না থেকে অর্জন করে।
গ্রাসু: তাদের তরিকা অনুসরণ করবেন।
কাই: আমার পড়ার অভিজ্ঞতায় এরকম দুজন দেবসুলভ লেখক আছেন: চেখভ এবং দস্তয়ভস্কি। এ পর্যন্ত আমি আমার লেখক জীবনে চেখভের দিকে বেশি ধাবিত হয়েছি: বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয়ে সযত্ন নিয়ন্ত্রিত বলার ভঙ্গি। কিন্তু দস্তয়ভস্কির নিদারুণ বিশৃঙ্খলায় আমি ঈর্ষাবোধ করি। তিনি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন যা সেইভাবে লেখা ছাড়া আর কোনোভাবে সেখানে পৌঁছানো যায় না।
গ্রাসু: পরিকল্পনা করে সেখানে যাওয়া যায় না।
কাই: হ্যাঁ, সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু আছে। জীবন বিশৃঙ্খল। মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, গ্রন্থকে কেনো এতো নিখুঁত ও সুগঠিত হতে হবে? বই সুন্দরভাবে সংগঠিত, এটা বলা কি প্রশংসাসুলভ? বইয়ের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব আছে, এটা বলা কি সমালোচনা?
গ্রাসু: আমার মনে হয় এটা পাঠকের ভাবনার বিষয়।
কাই: আমি পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করছি। আমার লেখক জীবনের অন্য একটা দিক আছে যা ঘেঁটে দেখতে হবে: বিশৃঙ্খলা। অমর্যাদাপূর্ণ দিক।
(গ্রাহাম সুইফট ‘বম্ব’ সাময়িকীর একজন কন্ট্রিবিউটিং এডিটর। তিনি ওয়াটারল্যান্ড এবং আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড নামক দুটি বহু আলোচিত উপন্যাসের লেখক।)
(সংগৃহীত)