বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

বাংলা ভাষায় অক্টোবর বিপ্লব চর্চা

বাংলা ভাষায় অক্টোবর বিপ্লব চর্চা

ঢাকা, ১৭ অক্টোবর, এবিনিউজ : ১৯১৭’র অক্টোবরে রুশ দেশে যে মানববিপ্লবের সূর্য উদিত হয়েছিল আজ একশ বছর পরও তা দেখিয়ে চলেছে আমাদের সবার সম্মুখযাত্রার আলোকদিশা। অনাগত ভবিষ্যতেও দেখিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশায় সারা বিশ্বের সকল শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কবি–লেখক–শিল্পীরাও তাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করছে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শততম বার্ষিকী।

আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে স্মরণীয় অবদান হচ্ছে দু’টো। একটি সিনেমার জন্ম। অপরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম। দুটো বিপ্লব। একটা চারুকলার ক্ষেত্রে। অন্যটা সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে। অক্টোবর বিপ্লব এবং সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটিয়েছে।

শহীদ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান (১৯৩৫–৭২) তাঁর ‘অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে এমনটিই মন্তব্য করেছিলেন।

১৯১৭’র অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু রাশিয়াতে নয়, সারা বিশ্বেই তার সংগ্রামী আভা ছড়িয়ে গেছে। দুনিয়া কাঁপানো দশদিন কারো কাছে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ আবার রুশ ক্যালেন্ডারজনিত কারণে কারো নিকট ‘নভেম্বর বিপ্লব’ বলে প্রতিভাত কিন্তু মর্মে নিহিত অঙ্গীকারের আগুন কোনো মাসের হিসেবে বেঁধে রাখতে পারিনি রুশ বিপ্লবকে। এবছর এই মহান মানববিপ্লবের শততম বার্ষিকী। একশ বছর আগে শ্রমিক–কৃষক–মেহনতী মানুষের মুক্তির বাণীকে ধারণ করে লেনিনের দেশে যে বিপ্লবের বিজয়বার্তা ধ্বনিত হয়েছিল তা স্পর্শ করেছিল এই লালনের দেশকেও; ১৯৬৬–তে রোকাইয়া জাফরি তাই বোধ হয় তাঁর একটি ভ্রমণকাহিনীর নাম দিয়েছিলেন লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে। দেশভাগের তিন দশক আগে সংঘটিত এ বিপ্লবের সময় ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত। এখানকার মানুষকে রুশ বিপ্লব একই সঙ্গে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা তেমনি তার হৃদয়–দিগন্তে জ্বালিয়ে দিয়েছে শ্রেণীহীন সমাজগড়ার স্বপ্নসূর্য; যে কারণে আমরা দেখি উপমহাদেশের বহু জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী জেলখানায় গিয়ে পাঠ নিয়েছেন সমাজতন্ত্রের, দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে অন্বয় ঘটিয়েছেন আবিশ্ব মানবের শোষণমুক্তির লড়াইয়ের।

এই পরিসরে আমরা অখণ্ড বাংলায়, বিশেষত বাংলাদেশে অক্টোবর বিপ্লব চর্চার কিছু নমুনা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। আশা করি পর্যাপ্ত তথ্যপ্রাপ্তিসাপেক্ষে ভবিষ্যতে তা পূর্ণাঙ্গ করা যাবে। বলাবাহুল্য অক্টোবর বিপ্লবের পাশাপাশি এই বিপ্লবের মহান নেতা লেনিন প্রসঙ্গে লিখিত রচনাসমূহকেও অনিবার্যত অক্টোবর বিপ্লব–চর্চা হিসেবে গণ্য করেছি আমরা।

২. বাংলায় রুশ বিপ্লব নিয়ে লেখার আদি একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর রাশিয়ার চিঠি (বাংলা ১৩৩৮) মূলত রুশ বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক নিগূঢ়–সংবেদী পর্যবেক্ষণ। রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিণ্ড

রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।

চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশী, তারাই বাহন ; তাদের মানুষ হবার সময় নেই ; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে, কম প’রে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশী তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশী তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মেরেণ্ড জীবনযাত্রার জন্য যত–কিছু সুযোগ সুবিধে সব–কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়ায়ে থাকেণ্ড উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে। … রাশিয়ায় একেবার গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনো বিচার করবার সময় হয় নি, কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘লেনিন’ নামের কবিতায় এভাবেই অমর করে রেখেছেন ‘অক্টোবর বিপ্লব’ নামক কবিতার মহাকবি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকেণ্ড

লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,

অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।

লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,

বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন ॥

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তো বলা চলে রুশ বিপ্লবের অন্যতম মানসসন্তান। আমরা দেখি রুশ বিপ্লবের ঠিক পাঁচ বছর পর প্রকাশিত অগ্নিবীণা (১৯২২) এবং তার পরের চারটি কাব্যগ্রন্থ বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬)-এ বিপ্লবের অগ্নিস্বাক্ষর অসামান্য শৈল্পিক দক্ষতায় মুদ্রিত। দূর রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বাঙালি কবি নজরুলের কলমে এনে দিয়েছিল যেন বিদ্যমান সমাজ ভাঙার কূলপ্লাবী সাহসী স্রোত। ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে নজরুলের বজ্রনির্ঘোষ উচ্চারণে খুঁজে পাওয়া যায় নতুন রাশিয়াকেণ্ড

দূর সিন্ধুতীরে বসে ঋষি কার্ল মার্কস যে মারণ–মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন তা এতদিনে তক্ষকের বেশে এসে এসে প্রাসাদেণ্ড লুক্কায়িত শত্রুকে দংশন করল। জার গেলণ্ড জারের রাজ্য গেলণ্ড ধনতান্ত্রিকের প্রাসাদ হাতুড়ি–শাবলের ঘায়ে চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে গেল।

কবি জসীমউদ্‌দীন তাঁর সোভিয়েত ভ্রমণকথার শিরোনাম দিয়েছেন যে দেশে মানুষ বড়। অক্টোবর বিপ্লব সাধারণ মানুষকে যে অসাধারণ মর্যাদায় উন্নীত করেছে মূলত তারই মর্মবাণী ধরা আছে এই শিরোনামে।

আবুল হুসেন (১৮৯৬–১৯৩৮) ঢাকায় গড়ে উঠা মুসলিম সাহিত্যসমাজ (১৯২৬)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’–এর চেতনায় বিশ্বাসী শিখাগোষ্ঠীর এই লেখকের বাংলার বলশী (১৯২৫) গ্রন্থটি মূলত রুশ বিপ্লবের প্রেরণায় স্নাত। ‘কৃষকের আর্তনাদ’, ‘কৃষকের দুর্দশা’, ‘কৃষি বিপ্লবের সূচনা’র মতো প্রবন্ধগুলো বাংলার কৃষকের দুঃখ–দুর্দশা এবং আসন্ন বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ধারণ করেছে। আবুল হুসেন রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবকে বাংলায় বাস্তবায়িত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, তাই বইয়ের নাম রেখেছিলেন বাংলার বলশী। এই বইয়ের ভূমিকা–লেখক মুহম্মদ ফযলুল করীম মল্লিকের ভাষায়ণ্ড

‘বাংলার বলশী’ আসন্নপ্রায় কৃষি–বিপ্লবের সূচনার প্রারম্ভেই সাবধানতার অগ্রদূত রূপে প্রকাশিত হইল। ‘বলশী’ শব্দটি বলশেভিক শব্দের অপভ্রংশ।

রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১–৭৪) ছিলেন কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক এবং সমাজতন্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাসী। এই লেখকের যাত্রী, বিপ্লবী রাশিয়া বই দু’টো রুশ বিপ্লবোত্তর রুশ দেশের অনুপুঙ্খ চিত্রে ভাস্বর। শিবরাম চক্রবর্তীর (১৯০৩–৮০) মস্কো থেকে পণ্ডিচেরী, প্রগতি লেখক সংঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চিন্মোহন সেহানবীশের (১৯১৩–৮৭) লেনিন ও ভারতবর্ষ, রুশ বিপ্লব প্রবাসে ভারতীয় বিপ্লবী (১৯৭৩), জ্যোতি ভট্টাচার্যের রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতি ও পরিণতি এবং রুশ বিপ্লবের জমির লড়াই অক্টোবর বিপ্লবের ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাবকে ধারণ করেছে। মুজাফ্‌ফর আহমদের (১৮৮৯–৭৩) আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ বইয়েও রুশ বিপ্লব এবং বাংলায় এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা রয়েছে। অক্টোবর বিপ্লবের তিন দশক পূর্তিতে বিনয় ঘোষ ও সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে প্রকাশিত হয় মাইকেল সেয়ার্স ও এলবার্ট কাহ্‌নের বই সোভিয়েত বিরোধী চক্রান্ত (১৯৪৭)।

৩. ১৯৬৭–তে পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে রুশ বিপ্লবের অর্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। সে বছরই ভারতে সংঘটিত হয় নকশালবাড়ী আন্দোলন। রুশ বিপ্লবের পঞ্চাশতম বার্ষিকী স্মরণে ১৯৬৭–তে প্রকাশিত হয় গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বই রুশ বিপ্লব ও বাংলার মুক্তি আন্দোলন। রুশ বিপ্লবের রজতজয়ন্তী বর্ষে ১৯৪২– এ ঢাকায় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির উদ্‌যোগে সোভিয়েত মেলা আয়োজিত হয়, উদ্বোধন করেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় পূর্ববাংলার লেখক–শিল্পীদের মাঝে অক্টোবর বিপ্লবের আবেদন ছিল কতটা গভীর।

জিতেন ঘোষের (১৯০১–৭৬) এই লেনিনের দেশ, রেবতী মোহন বর্মণের (১৯০৩–৫২) তরুণ রুশ, লেনিন ও বলশেভিক পার্টি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, শান্তিকামী সোভিয়েত, জ্ঞান চক্রবর্তীর (১৯০৭–৭৭) অমর লেনিন, মিহির সেনের (১৯২৭) লেনিনেন মা, অমল দাশগুপ্তের কমরেড লেনিন এবং রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন প্রমুখের রচনায় নানাভাবে এসেছে রুশ বিপ্লবের কথা।

৪. সোভিয়েটের দিনগুলি (১৯৬৮) কবি সুফিয়া কামালের (১৯১১–৯৯) সোভিয়েত ভ্রমণকাহিনী। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে বিপ্লবী রাশিয়ায় দেখা নারী–পুরুষ সমতাবাদী সমাজের চিত্র ণ্ড

মহামানব লেনিন অক্টোবর বিপ্লবের পর যে রাষ্ট্র গঠন করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল প্রবল মানবতাবোধের অনুভূতি। দেশের জাতির মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার প্রচেষ্টায় তিনি নর ও নারী নির্বিশেষে গঠনমূলক কাজের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে কাস্তে–হাতুড়ির পতাকাতলে সকলকে একত্রিত করেছিলেন।

মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদক ও সম্পাদক দ্বিজেন শর্মার সমাজতন্ত্রে বসবাস (১৯৯৯) বইতে মানুষের ইতিহাসের অক্টোবর বিপ্লবের অন্তহীন সম্ভাবনার কথা উচ্চারিত হয়েছে।

প্যারি–কমিউনের পর সত্তর বছর স্থায়ী দ্বিতীয় শ্রমিকরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের কল্যাণচিন্তায় নিবিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের মনে যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সকল মানুষের জন্য ন্যায়বিচারভিত্তিক ও সাম্যদর্শী সমাজ নির্মাণের চিন্তা সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি মানুষ কখনই ত্যাগ করেনি। এমনটি অত্যুক্তি নয় যে, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র নির্মাণের ব্যর্থতার হেতুগুলির শিক্ষা ভাবী সমাজ নির্মাতাদের প্রাজ্ঞতর করবে, তাঁদের নিপুণতর দক্ষতার সাধিত্র যোগাবে, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সার্থক প্রয়োগের নতুন পথ দেখাবে। বিপ্লবের ব্যর্থতা ও প্রতিবিপ্লবের জয় সর্বদাই নৈরাশ্যের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে, কিন্তু কখনই স্থায়ী ওঠে না। অগ্রগতির পথ যতই কষ্টার্জিত ও দীর্ঘ হোক, মানুষ কোনদিন তা থেকে পিছু হটে না। এটাই ইতিহাসের সরল সত্য।

এম এম আকাশের রাশিয়াতে শ্রমিক কৃষক কীভাবে বিপ্লব করেছিল? (১৯৮৩) এবং রুশ ও চীন বিপ্লব, মনজুরুল আহসান খানের রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, রেদওয়ানুর রহমানের রুশ বিপ্লব, শেখর রহিমের অক্টোবর বিপ্লব : এক নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ শিরোনামের বইগুলো এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

রুশ বিপ্লবের বছর জন্মগ্রহণ করেন কবি আহসান হাবীব। সদ্যপ্রয়াত শান্তনু কায়সারের ‘কবি’ গল্পে এই বিষয়টি যেভাবে ফুটে উঠে তাতে বোঝা যায় আহসান হাবীবের সঙ্গে রুশ বিপ্লবের চেতনার যোগাযোগটি খুব দূরবর্তী ছিল না। । শান্তনু কায়সার লিখেছেনণ্ড

১৯১৭ সালে জন্ম, যে বছর সোভিয়েতের প্রতিষ্ঠা– তখনও অবশ্য হয়নি। কোথায় পিরোজপুর আর কোথায় মস্কো। তবু অরণ্য হাবীব একদিন বলেছিলেন, আমার ভাবতে ভালো লাগে ওই বছর আমার জন্ম। জানো তো মার্কসিস্ট নই কিন্তু ব্যাপারটা মাথায় থাকে। গোর্কির জন্মশতবর্ষে দৈনিকের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটা ভালো সংখ্যা করতে চেয়েছিলাম, বোঝো প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকায়–তাও করেছিলাম, কী সাগর, করিনি? হ্যাঁ হাবীব ভাই করেছিলেন।

শুধু কবি আহসান হাবীব নন, কথাশিল্পী শওকত ওসমানও অক্টোবর বিপ্লববর্ষের জাতক। এ ঘটনা নেহায়েত কাকতাল নয় যে, ১৯১৭–তে জন্ম নেয়া শওকত ওসমানের হাতেই ১৯৭৩ সালে রচিত হয় শিশুতোষ গ্রন্থ ক্ষুদে সোশালিস্ট। কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম তাঁর জুবোভস্কি বুলভার, তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত, লাল আকাশ ইত্যাদি উপন্যাসে ধরে রেখেছেন বিপ্লবজাত রাশিয়াকে। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার তাঁর ১৯৯২ উপন্যাসে সোভিয়েত ভাঙনোত্তর বাংলাদেশ পরিস্থিতির দিকে আলো ফেলেছেন। শাহাদুজ্জামানের কিছু গল্পেও উঠে এসেছে সেই বাস্তবতা।

অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রায় দু’হাজার বইয়ের বাংলা ভাষান্তর প্রকাশিত হয় যার অনুবাদকদের মধ্যে ছিলেন সমর সেন, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, অরুণ সোম, ননী ভৌমিক, মঙ্গলাচরণ চট্টেপাধ্যায়, খালেদ চৌধুরী, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন শর্মা, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ। বলাবাহুল্য এ প্রকাশন থেকে অক্টোবর বিপ্লবকেন্দ্রিক মূল্যবান গ্রন্থাদিও অনূদিত হয়। জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশদিন বইটি প্রগতি প্রকাশন থেকে আজ থেকে তিন দশক আগে ১৯৮৭–তে বাংলায় অনুবাদ করেন ননী ভৌমিক। মানবমুক্তির লড়াইয়ে এটি এখনও প্রেরণা দিয়ে চলেছে। ননী ভৌমিক রুশ বিপ্লব : কী ঘটেছিল নামে একটি গ্রাফিক উপন্যাসও অনুবাদ করেন। আলবার্ট রিস উইলিয়মসের রুশ–বিপ্লব–প্রবাহ এবং লেনিন : মানুষটি ও তাঁর কর্মযজ্ঞ অনুবাদ করেছেন বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়।

৫. গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে অক্টোবর বিপ্লবের পুনর্মূল্যায়নমূলক বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লেনিন কেন জরুরি (১৯৯২) বইয়ে দেখিয়েছেন সমাজতন্ত্র কেবল সোভিয়েতসাপে কোন মতবাদ নয় বরং মানব–ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতির নাম সমাজতন্ত্র। বিলোপবাদীদের উল্লাসের বিপরীতে অক্টোবর বিপ্লবের ইতিহাস ও মর্মবস্তু অনুসন্ধানমূলক বেশ কিছু রচনা অক্টোবর বিপ্লবের বিজয়গাথা শিরোনামে সম্পাদনা করেছেন মনজুরুল আহসান খান। এম আর চৌধুরীর মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের নয়, সংশোধনবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের পতন (১৯৯১) বইটিও এই ধারার।

এবছর অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ স্মরণে দুই বাংলাতেই বেশ কিছু গ্রন্থ ও সংকলন প্রকাশিত হয়ে চলেছে। অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদ্‌যাপন জাতীয় কমিটি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও সংকলন প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছে। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম রচিত বই রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব : এ আলো নেভার নয়। এ বইয়ে তাঁর বক্তব্য–

ইতিহাসের অমোঘ ধারায় সমাজতন্ত্র–সাম্যবাদী ভবিষ্যতের যে আলোর নিশানা রচিত, সে আলো নেভাবেণ্ড এমন সাধ্য কার? এ আলোকবর্তিকা নেভার নয়।

হায়দার আকবর খান রনো ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর এবং অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট শিরোনামে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের রচয়িতা। সম্প্রতি প্রকাশিত শেষোক্ত গ্রন্থের উপসংহারে ধৃত তাঁর বক্তব্য আজকের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকণ্ড

অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ পরে পৃথিবীর চেহারাটা আজ অনেকটাই আলাদা। সেটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস শতবর্ষে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। একদিকে পৃথিবীর বস্তুগত অবস্থা সমাজতন্ত্রের জন্য অনেক বেশী পরিপক্ব, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন আপাতত ভাটার টান চলছে। সেখানে জোয়ার আনতে হলে কেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্র টিকলো না, সেটার সদুত্তর খুঁজে বের করতে হবে। এই উত্তরও একেকজন একেকভাবে দিচ্ছেন। সে–প্রশ্নে তীব্র শ্রেণী সংগ্রাম চলবেণ্ডবুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া ও সংশোদনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মার্কসবাদী বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির। এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যদি বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, তবেই আমরা অক্টোবর বিপ্লবকে পুনর্জীবিত করে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে পুনর্গঠিত করতে সক্ষম হবো।

মানুষের ইতিহাস যদি তার অগ্রগতির ইতিহাস হয় তবে সে অগ্রগামিতার জন্য বিপ্লব অনিবার্য। ১৯১৭’র অক্টোবরে রুশ দেশে যে মানববিপ্লবের সূর্য উদিত হয়েছিল আজ একশ বছর পরও তা দেখিয়ে চলেছে আমাদের সবার সম্মুখযাত্রার আলোকদিশা। অনাগত ভবিষ্যতেও দেখিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশায় সারা বিশ্বের সকল শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কবি–লেখক–শিল্পীরাও তাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করছে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শততম বার্ষিকী।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত