মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২
logo
  • হোম
  • সাক্ষাৎকার
  • ‘অভিবাসন ব্যয় কমাতে ভিসা ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে প্রেরণকারী দেশগুলোকে জোটবদ্ধ হতে হবে’

‘অভিবাসন ব্যয় কমাতে ভিসা ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে প্রেরণকারী দেশগুলোকে জোটবদ্ধ হতে হবে’

‘অভিবাসন ব্যয় কমাতে ভিসা ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে প্রেরণকারী দেশগুলোকে জোটবদ্ধ হতে হবে’

ঢাকা, ১৯ অক্টোবর, এবিনিউজ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ার। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। গবেষণার ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- শ্রম অভিবাসনের প্রভাব, রেমিট্যান্স, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিবাসন প্রভৃতি। এডওয়ার্ড এলগার পাবলিশিং লিমিটেড থেকে প্রকাশিত ‘অ্যাডাপশন টু ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ: মাইগ্রেশন, দ্য মিসিং লিঙ্ক’ গ্রন্থের সহলেখক। খসড়া ‘বিদেশে কর্মসংস্থান নীতি’ ও ‘বিদেশে কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন ২০১৩’ প্রণয়নে তিনি সক্রিয় সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এশিয়া প্যাসিফিক মাইগ্রেশন রিসার্চ নেটওয়ার্ক ও সাউথ এশিয়া মাইগ্রেশন রিসোর্স নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিবাসন, রেমিট্যান্সপ্রবাহ, শ্রমবাজার, শ্রম রফতানি, দক্ষতা-সক্ষমতা নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তা হুবহু তুলে ধার হলো-

বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত নিতে হবে— এমন দাবি করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাদের এ দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে কী উদ্যোগ নিতে পারে, সে সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাই?

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত নিতে হবে— ইইউর এ দাবি আপাতদৃষ্টিতে সহজ একটি ব্যাপার মনে হলেও কার্যত এটি প্রায় অসম্ভব। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যুক্তিসঙ্গতও নয়। প্রথমে ইইউভুক্ত দেশগুলোকে বুঝতে হবে যে, এ ধরনের অভিবাসন ঘটছে কেন? ইইউভুক্ত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপকে দুর্গ বানিয়ে রেখেছে। ‘ফ্যামিলি রিইউনিফিকেশন’ বা ‘হাইলি স্কিলড নলেজ মাইগ্রান্ট’ ছাড়া কেউই ইউরোপে অভিবাসন করতে পারছেন না। অথচ বাংলাদেশে এমন একটি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন বেড়েছে, যারা ‘হাইলি স্কিলড’ নয় কিন্তু কিছু পড়াশোনা করেছেন। দেশে তাদের কর্মসংস্থান রয়েছে, তবে তারা আরো ভালো অবস্থানে যেতে চান। তারাই ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে ইউরোপে অভিবাসন করছেন।

অন্যদিকে আমেরিকা ও তার সহযোগী বেশকিছু পাশ্চাত্যের দেশ মধ্যপ্রাচ্যকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। সেখানে আরব বসন্ত বা শাসনক্ষমতার পরিবর্তনের পলিসি নিয়ে বা আইএস তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের বেশকিছু শ্রমবাজার যেমন— লিবিয়া, ইরাক ইত্যাদি দেশে যারা কাজ করতে গেছেন, তারা ওইসব দেশের অশান্ত অবস্থায় ইউরোপে যেতে আগ্রহী হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত অভিবাসীদের ইউরোপমুখী হওয়ার পেছনে উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক পলিসিকেই আমি দায়ী করব। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি সফর এবং তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত অস্ত্র চুক্তির কথাই ধরা যাক। ট্রাম্পের এ সফরের পরে সন্ত্রাস দমনের নামে কাতারের ওপর এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ আমরা লক্ষ করেছি। লিবিয়া, সিরিয়ার পরে এখন কাতারকে যদি নড়বড়ে করা হয়, তার ফলাফল পড়বে কাতারে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ওপর। তাদের অনেকে হয়তো কাজ হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন। আবার অনেকে রওনা হবেন ইউরোপ অভিমুখে। অর্থাত্ আমি বলতে চাইছি, বাংলাদেশী অভিবাসীদের ইউরোপ যাওয়ার প্রবণতা বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটেই সৃষ্টি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন শ্রম প্রেরণকারী রাষ্ট্রের নাগরিকদের ইউরোপমুখী অভিবাসন স্রোত।

ইদানীং ইইউ বাংলাদেশ সরকারের ওপর বাংলাদেশী অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে যে চাপ সৃষ্টি করেছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রথমে বিবেচনা করতে হবে তাদের অভিবাসন নীতি, তারপর বিশ্বরাজনীতি; তখনই তারা একটি যুক্তিসঙ্গত অভিবাসী গ্রহণ এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের রূপরেখা দিতে পারবে। অন্যদিকে তাদের বর্তমান হুমকি যে, অনিয়মিত অভিবাসীদের ফিরিয়ে না নিলে নিয়মিত অভিবাসীদের ভিসা প্রদান বাধাগ্রস্ত হবে। এটিও ন্যায়সঙ্গত নয়।

অভিবাসীদের ফেরত আনার ব্যাপারে আমাদের সরকারের সিদ্ধান্ত কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

আমার মনে হয় না, অভিবাসীদের ফেরত আনার জায়গায় বাংলাদেশ যাবে। বলা হচ্ছে, ইউরোপে অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা আট হাজার। আমরা বলছি, বাংলা ভাষা জানেন কিংবা বাংলায় কথা বলেন বলেই যে তারা সবাই বাংলাদেশী, তা কিন্তু নয়। তারা পশ্চিমবাংলার হতে পারেন, হতে পারেন মিয়ানমারে যে বাঙালিরা রয়েছে, তাদের কিছু অংশ। অভিবাসীদের সুস্পষ্ট পরিচয় না জেনেই ইইউ কীভাবে দাবি করে যে, এরা সবাই বাংলাদেশী! আমার ধারণা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনা করবে। অন্যদিকে ইইউর সঙ্গে আমাদের যে অর্থনৈতিক সংযোগ রয়েছে, তার জন্য ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটানো যাবে না। সেদিক থেকে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বেশ যুক্তিসঙ্গত। সরকার জানিয়েছে, চারটি পর্যায়ে অনিয়মিত অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনার প্রয়াস নেবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, এ বিষয়ে দ্রুত কোনো কিছু করার সম্ভাবনা নেই। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

একই সঙ্গে যারা ইউরোপে গেছেন, তাদের মানবাধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জায়গায় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ থাকা উচিত। একজন মানুষ হিসেবে অভিবাসীর যে অধিকার রয়েছে, সেই জায়গাগুলো নিয়ে নাগরিক সমাজের অবশ্যই তাদের পক্ষে বলা উচিত। অবৈধ পথে যাওয়ার প্রবণতা রুখতে আমাদের দেশের মধ্যেই ব্র্যাকের সঙ্গে ইইউ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু এ প্রচারণা দিয়ে কি অবৈধ গমন ঠেকানো সম্ভব? আমাদের সমাজের ভেতরে শ্রেণী উত্তরণের পথ একবারেই নেই। যেসব ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো, তারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ইউরোপে পাড়ি জমাবেন। অবৈধ পথে বিদেশ গমন সম্পর্কে সচেতন করতে আমরা হয়তো এর খারাপ দিকটি তাদের কাছে তুলে ধরতে পারি, তাদের বলতে পারি, এ পথে গেলে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা সেসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের।

মালয়েশিয়ার অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের কারণে বিমানবন্দর থেকেই অনেক বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠাচ্ছে। বৈধ ভিসা থাকার পরও অনেকে জেল খেটে ফিরছেন—

মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অভিবাসন প্রক্রিয়া ভীষণ জটিল এবং বর্তমানে এটি একটি দুঃখজনক অবস্থায় রয়েছে। জিটুজি, জিটুজি প্লাস বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। কেন কার্যকর হয়নি, তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। অথচ অভিবাসন ঠিকই হয়েছে। যদি প্রশ্ন করি, কীভাবে হয়েছে? উত্তরটা হচ্ছে, অনেকে স্টুডেন্ট ভিসায় গেছেন। অর্থাত্ আনুষ্ঠানিকভাবে যখন জিটুজির কারণে শ্রমিক যাওয়া খুব সীমিত হয়ে পড়েছিল, তখন দেশটি শিক্ষার্থীর মোড়কে শ্রমিক গ্রহণ করেছে। আমি মনে করি, গোটা বিষয় ঘিরে মালয়েশীয় সরকার দ্বৈত অবস্থান ধরে রেখেছে। এটা ওই দেশের ভুল নীতির সমস্যা। আমাদের এখান থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় লোক নিচ্ছে আবার যারা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে ওখানে গেছেন এবং শ্রমিক হিসেবে দীর্ঘদিন রয়েছেন, তাদের বলা হচ্ছে যে, ৮ হাজার রিঙ্গিত সরকারি কোষাগারে প্রদান করে তারা অবস্থানটি বৈধ করে নিতে পারবেন। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার। বৈধ করার জন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মানুষগুলো মালয়েশীয় সরকারের কাছে অনেকটা অর্থ তৈরির মেশিন। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সরকারের ভিসা বৈধকরণের যে প্রস্তাবনা, তার বিপরীতে আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভূমিকা দেখতে চাই। আমরা চাই তাদের সঙ্গে অর্থের অংক নিয়ে আলোচনা করা হোক। এর আগেও কয়েকবার খুব সামান্য অর্থের বিনিময়ে বৈধতার অনুমতি দেয়া হয়েছে, এবার ৮ হাজার রিঙ্গিত কেন? এদিকে আমাদের দেশের ভেতরেও কিছু সমস্যা হচ্ছে। শোনা যায়, বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বড় রকমের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের বাজার খোলার ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ২০০ রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে, যারা প্রণোদনা দিয়ে বাজার খোলার চেষ্টা করেছে তারা ভাবছে, আমরা বাজার উন্মোচন করেছি, অন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কেন মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সুযোগ পাবে। অন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মনে করছে, সরকারের কাছ থেকে বহুমূল্যে লাইসেন্স গ্রহণ করেছি, সুতরাং আমাদেরও লোক পাঠানোর সুযোগ দিতে হবে। দুটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব নতুন করে এ বাজারকে স্থবির করে ফেলেছে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের মাঝে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। বৈধভাবে অভিবাসন কমে যাচ্ছে। ফলে অনিয়মিত অভিবাসন বাড়ছে। এ অনিয়মিত অভিবাসীরাই বিভিন্ন ধরনের নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এমনকি অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই জানেন না, তারা অবৈধভাবে গেছেন। তারা শুধু জানেন যে, দালালকে টাকা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে পুরো ব্যবস্থার মধ্যেই সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট।

রেমিট্যান্সের ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে?

দুই বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন বেড়েছে। ২০১৫-এর তুলনায় ২০১৬ সালে অভিবাসন ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭-এর প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ছয় লাখ অভিবাসী বিদেশে চলে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল, অভিবাসন যখন বেড়েছে, বছরওয়ারি রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে; কিন্তু তেমনটি ঘটছে না। গত বছর আর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ১১ শতাংশ। এ বছর তা আরো কমে যাবে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন— মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অর্থনৈতিক স্থবিরতা, তেলের দাম কমা ইত্যাদি। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের নিম্নগতির ক্ষেত্রে এসব বৈশ্বিক কারণের পাশাপাশি বর্তমান যে শ্রমবাজার ব্যবস্থা, তাও দায়ী। বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ ভিসা ব্যক্তি উদ্যোগে সংগৃহীত। ওইসব দেশে অবস্থানরত অভিবাসীরা এসব ভিসা কিনে দেশে পাঠাচ্ছেন। এসব ভিসা নিয়ে যারা কাজে যাচ্ছেন, বিদেশে গিয়ে তারা অনেকেই কাজ পাচ্ছেন না। অথবা কাজ করছেন, বেতন পাচ্ছেন না। এদের এক বড় অংশ কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে আসছেন। বোঝাই যাচ্ছে যে, এ ধরনের শ্রমবাজারে কাজ করলে তা পর্যাপ্ত আয়ের ব্যবস্থা করবে না এবং এর ফলাফল গিয়ে পড়বে রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপর।

দাবি করা হয় যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে অন্য যেসব শ্রমবাজার রয়েছে, তার বেশির ভাগই বেসরকারি খাতগুলো গড়ে তুলছে। এটাকে কি কোনো আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যায় না? এক্ষেত্রে অন্য দেশগুলো কী করে?

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোয় বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থান সৃষ্টির মূল উত্স। শ্রম অভিবাসনও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৭৭ সালে যখন বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন বাড়তে থাকল, তখন সরকারই নিজেকে রেগুলেটরি অথরিটির ভূমিকায় নিয়ে যায় এবং বেসরকারি খাত শ্রম অভিবাসন ব্যাপকভাবে বাড়াতে থাকে। অন্যান্য শ্রম প্রেরণকারী দেশের বেলায়ও তা-ই হয়েছে। আমাদের দেশে সমস্যা হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ও প্রেরণকারী দেশে এমন কিছু ব্যবস্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যাকে গ্রহণকারী দেশ এবং আমাদের দেশের সরকার কেউই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। যেমন— ভিসা কেনাবেচা, গ্রামপর্যায় থেকে লোক সংগ্রহ প্রক্রিয়া, সরকারি ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ায় উেকাচের অভিযোগ ইত্যাদি। অভিবাসনের দেশে ভিসা কেনাবেচার বিষয়ে কিছু করা সম্ভব না হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে ভিসা সংগ্রহের হার আমরা কমাতে চেষ্টা করতে পারি। সরকার ও লাইসেন্স রিক্রুটিং এজেন্সির কেন দেশে দেশে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক তত্পরতার মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহের চেষ্টা বাড়াতে হবে? পরিবার বা পরিচিতজন ভিসা পাঠাবে আর রিক্রুটিং এজেন্সি দেশে বসে শুধু সরকারের ক্লিয়ারেন্স আদায় করে দেবে— এটা বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে ভিসা এলে তারাই যাতে ক্লিয়ারেন্স নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা আরো সংগঠিত করতে হবে। অনিয়মিত অভিবাসন কমাতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় বাড়াতে হবে। দালাল মারফত যারা অনিয়মিত প্রক্রিয়ার অভিবাসন করছেন, তাদের ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কোনো দায়িত্ব নেয় না। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার অভিবাসন আইন, ২০১৩ সম্পর্কে সেভাবে অবগত নয় বলে তা প্রয়োগ করে না। ফলে পুরো ব্যবস্থায় যে ফাঁকফোকর তৈরি হয়, তার কষ্ট ভোগ করে অভিবাসী ও তার পরিবার। দেশের ভেতরে পুরো ব্যবস্থাকে গোছাতে হলে চাই আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়। যদি আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, রিক্রুটিং এজেন্সিই বিদেশে পাঠাতে লোক সংগ্রহ করবে, তাহলে তাদের জেলাপর্যায়ে অফিস খুলতে হবে। আর তারা তা না খুলতে পারলে এবং দালালদের দিয়ে একই কাজ করাতে চাইলে তাদের রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রীলংকা বর্তমানে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জেলাপর্যায়ে অফিস খোলানোর জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে।

দালালদের তালিকা তৈরি কিংবা তাদের নিবন্ধন দেয়া প্রসঙ্গে কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে?

রামরু ১৯৯৭ সাল থেকে দালালদের সম্পর্কে বলে আসছে। বর্তমানে আবার নতুন করে তাদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে। গত ২০ জুলাই রামরু তাদের নতুন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আলোচনা ও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে একজন দালাল চমৎকার বিশ্লেষণ করে বললেন, ‘মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটেটিভ না থাকলে ওষুধ কোম্পানির তৈরি ওষুধ তো কারখানায়ই পড়ে থাকত। আমরা তো অভিবাসীদের জন্য ওই কাজটি করছি। আমাদের বৈধতা দিন। গ্রামের মানুষের টাকা মার গেলে তারা আমাদেরই দায়ী করে, রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে যায় না।’ এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সি যদি মনে করে তারা দালাল নিয়োগ করবে না, সেক্ষেত্রে তাকে মাঠপর্যায়ে সাব-অফিস খুলতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে দালালদের কাজ করতে দিতে হবে, যা হবে দেশের ভেতরের ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত উদ্যোগ। অন্যদিকে শ্রমিক ইস্যুতে গ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে তারা ভিসা ট্রেডিং বা অন্য ব্যবস্থা নিয়ে আলাপে আগ্রহ দেখান না কিংবা এ বিষয়ে শুনতে চান না। উপরন্তু প্রেরণকারী দেশের ঘাড়ে দায়ভার চাপিয়ে দেন। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কয়েক বছর ধরে রামরু মাইগ্রেশন গভর্ন্যান্সের মাল্টিল্যাটারালিজমকে আরো জোরদার করার দাবি করে আসছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সবসময় শ্রম প্রেরণকারী দেশগুলোর বিরুদ্ধে যায়। এখন মাল্টিল্যাটারাল ফোরামগুলোয় জোটবদ্ধভাবে যদি সবকিছু ঠিক করা হয়, তাহলে গ্রহণকারী দেশে ঘটা অন্যায়গুলোর প্রতিকার পাওয়া যাবে। মাল্টিল্যাটারালিজমের কতগুলো প্রক্রিয়া রয়েছে, জিএফএমডি (গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) যেমন— কলম্বো প্রসেস, আবুধাবি ডায়ালগ, বালি প্রসেস। আন্তর্জাতিক সনদ, ১৯৯০ অভিবাসী শ্রমিক ও তার পরিবারের সুরক্ষা-বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল; কিন্তু এ দলিলে কোনো গ্রহণকারী অনুস্বাক্ষর করেনি। অভিবাসনে সুশাসন আনতে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়া দাবি করা ছাড়া আমাদের পথ নেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি যেকোনো দেশের সরকারও কিন্তু অসহায়।

শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন, বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে তেমন কোনো সাহায্য পান না। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন?

অভিবাসনের দেশে ভালো সেবা দিতে লেবার অ্যাটাশের নিয়োগকে ক্যাডার সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে এ ক্যাডারদের বাছাই করতে হবে, যারা এ সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী, তারা আসবেন। তাদের কাজ শুরু হবে ডেমো অফিস থেকে। এখান থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে আসবেন। এরপর বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের নিয়োগ দেয়া হবে। মেয়াদ শেষে তারা আবারো একই মন্ত্রণালয়ে কাজ করবেন। বর্তমানে যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তারা কিছু না জেনেই তিন বছরের জন্য দায়িত্ব নিয়ে যাচ্ছেন; যারা সেবা দিতে আগ্রহী, তারা সেবা দিচ্ছেন। আর যারা সেবা দেয়ার মানসিকতা নিয়ে যাচ্ছেন না, তারা দুর্নীতিতে যুক্ত হচ্ছেন। এর প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্বিন্যাস চাই। সংসদের স্থায়ী কমিটির তরফ থেকে একটা প্রস্তাবনা ছিল। তা কেউ কার্যকর করছেন না।

স্বল্প মজুরি, কর্মক্ষেত্রে হয়রানিসহ নানা অভিযোগের খবর পাওয়া যায়। শোনা যায়, ভারত, শ্রীলংকা আমাদের চেয়ে কম শ্রমিক রফতানি করেও অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দরকষাকষির ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কী কিংবা আমরা এক্ষেত্রে কতটা কৌশলী?

এ মুহূর্তে হয়তো আমাদের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কিছুটা কম। তবে বাংলাদেশের মাথাপিছু রেমিট্যান্স ভারতের চেয়ে বেশি। ভারত অনেক বড় রাষ্ট্র, ওখান থেকে অনেক বেশি মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যায়, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাথাপিছু রেমিট্যান্স বেশি। অর্থাত্ আমাদের দেশ থেকে দরিদ্র যেসব শ্রমিক যাচ্ছেন, তারা আয়ের অধিকাংশ টাকাই দেশে পাঠান। শ্রীলংকা থেকে যারা যাচ্ছেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আমাদের দেশের শ্রমিকদের চেয়ে বেশি। আমরা যদি দক্ষ লোক পাঠাতে পারতাম তাহলে রেমিট্যান্স আরো বেশি হতো। আমি সবসময় বলি, স্কিলড মাইগ্রেশন রিডিউসেস এক্সপ্লয়টেশন, ইনক্রিজেস ইনকাম। একজন অদক্ষ শ্রমিককে নানাভাবে হেনস্থা করা যায়। শ্রমিকটি যদি দক্ষতাসম্পন্ন হন, তাহলে তার সঙ্গে এ আচরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ২০১১ সালে ন্যাশনাল স্কিলড পলিসি হয়েছে, সেখানে একটা অধ্যায়ই রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে। বড় পরিসরে আমরা এখনো শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তিনমুখী। ভোকেশনাল, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম। দেখা যায়, ভোকেশনালে কেউ পড়তে চায় না। এক্ষেত্রে মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ভোকেশনালকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভোকেশনাল শিক্ষা ঘিরে আমাদের এক ধরনের ট্যাবু কাজ করে। আমরা সন্তানদের এখানে দিতে চাই না। এ ট্যাবু ভাঙতে হবে। হয় ভোকেশনাল স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে অথবা মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে একে নিয়ে আসতে হবে। আগে আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৩৮টি, এখন এ সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিটি জেলায় এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন হতে যাচ্ছে। তবে বিএমইটির (ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং) প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোয় যে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, তার গুণগত মান কতটা উন্নত, তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব হলে দরকষাকষির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশিয়ায় শ্রমশক্তি পাঠানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও আমাদের লোক নেবে। এক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে কি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবা হচ্ছে?

যদি বাইরের দেশের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের শ্রমিকদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আনতে পারি, তাহলে নতুন বাজার না খুঁজলেও চলবে। কারণ এমনিতেই নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন হবে, নতুন বাজার খুলে যাবে। ন্যাশনাল স্কিলড পলিসি ২০১১ বাস্তবায়ন করে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমেই আমরা তা করতে পারি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে চাহিদাসম্পন্ন পেশাগুলোর ওপর আমাদের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। নতুন বাজার খোঁজার আগে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। আমাদের সাপ্লাই সাইড উন্নত করতে হবে। বিদেশে নার্স পেশার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আমরা এদিকে মনোযোগ দিতে পারি।

সরকার এজেন্সিগুলোকে অভিবাসন ব্যয় বেঁধে দিয়েছে, যা আগের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। এটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

প্রথমত. যারা কাজের জন্য বিদেশ যাচ্ছেন, তাদের কোনো ব্যয় বহন করার কথা নয়। বেশ ক’বছর ধরে সরকার বিভিন্ন দেশের জন্য সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে আসছে। এবার সে খরচ আরো বাড়িয়েছে। অভিবাসন ব্যয় বেঁধে দিয়ে এক্ষেত্রে খরচ কমানো সম্ভব নয়। আগেও সরকার যে ব্যয় বেঁধে দিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করে কর্মীরা বিদেশে গেছেন। এবারো তা-ই হবে।

অভিবাসন ব্যয় কমাতে হলে ভিসা ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে প্রেরণকারী দেশগুলোকে জোটবদ্ধ হতে হবে। দালালদের নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে সংগৃহীত ভিসার পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ভিসা ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে অর্থ আদান-প্রদানের যে অভিযোগ শোনা যায়, তাও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির চেষ্টা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি উন্নত বাজারের দিকে তাকাতে হবে। (বণিক বার্তা)

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত