পত্রলেখা নাথ, ২২ অক্টোবর, এবিনিউজ : তিন বছর কোমায় থাকার পর হসপিটাল থেকে ফিরে আজ বহুদিন পর পাড়ার রবীনদের তাসের আড্ডায় যাচ্ছে অজিত। আগে নিয়মিত ওই ঠেকে দেখা যেত অজিতকে। অফিস থেকে ফিরে কোনমতে ব্যাগটা বাড়িতে ফেলে চলে যেত ওই আড্ডায়। তাস পিটিয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা। অনেকদিন পর সেই সব কথাই মনে পড়ছে। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিট এলাকায় অজিত মুখার্জিদের একশো বছরের পুরানো বাড়ি। বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে একটা কালী মন্দির, তার ঠিক পাশে বসাকদের বাড়ির বিস্তীর্ণ রকে রবিনদের তাসের আড্ডা। এই তিন বছরে কয়েকটা ফাস্টফুডের দোকান হয়েছে রাস্তার ওপর। মিলিদের বাড়িটা বোধ হয় শরীকি ভাগাভাগি হয়েছে, এক দিকটায় নতুন রঙ করা দেয়াল অন্যদিক অমেরামত অবস্থায় পড়ে আছে। এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে অজিত। তিন বছর কোমায় থাকার পর কেউ যে এভাবে হেঁটে চলতে পারে, তা পাড়ার লোক কেন, নিজের জীবনে না ঘটলেও বিশ্বাস করতে পারতো না।
‘আরে আয় আয় অজিত, কতদিন পর তোকে দেখলাম, চেহারাটা একটু ভেঙে গেছে, কিন্তু তার হাসিটা, সেই আগের মতোই আছে। এখানে বোস।’ গৌর মালিক অজিতের হাত ধরে পাশে বসায়। দিলিপ বলে, ‘রবীন, গৌর, অনিমেষকে তো তুই চিনতিস, এই ছেলেটা আমাদের নতুন সদস্য তুষার’। তুষার এবার সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, ‘আপনার কথা দাদাদের মুখে অনেক শুনেছি অজিত দা। আজ আপনাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। আসুন একদান হয়ে যাক’।
সন্ধ্যে নেমেছে কলকাতার বুখে। একে একে স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। তুষার একটা কাপড় পেতে ফেলে। কাপড়ের চারিদিকে গোল হয়ে বসে পাঁচজন। দিলিপ তাসটাকে ফটাফট ফাটিয়ে সকলের মধ্যে বেটে দেয়। প্রথম চাল দেয় অজিত। তারপর একে একে সবাই। তাসের আড্ডা এগিয়ে চলে। ফিস খেলায় একের পর এক তাস টেনে হাতের কার্ডের সঙ্গে মেলাতে হয়। ভালই খেলা জমে ওঠে। দু’রাউন্ডের খেলায় তুষারই বার বার এগিয়ে যায়, তৃতীয় রাউন্ডের শুরুতে অজিত হাসতে হাসতে বলে, ‘না এই বার তুষারকে হারাতেই হবে’। আবার তাস বাটা হয়। এর মধ্যে যোগেন দার দোকান থেকে তিনবার চা হয়ে গেছে। তুষার বলে, ‘অজিত দা, এবারও যদি আমি জিতি, তবে কিন্তু আপনাকে ভবতারিনীর গাওয়া ঘিয়ের সিঙ্গারা খাওয়াতে হবে’। অজিত বলে, ‘ঠিক আছে ভাই তাই হবে’। দিলিপ নিশ্চিন্ত মুখে হাতের কার্ডে চোখ বোলায়। ফিচকে গৌর নিজের কার্ড দেখে আশপাশের কার্ডে উঁকি ঝুঁকি মারার চেষ্টা করে। অজিত দেখে তুষার মন দিয়ে কার্ডটাই দেখছে। অজিত তুষারের এক্সপ্রেশানটা বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ তুষার চোখ তুলে অজিতের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি দেখছেন দাদা আমার মুখে’? অজিত বলে, ‘ধ্যানমগ্ন তুষারকে দেখছি’। অজিতের দানের সময় আসলে অজিত যে কার্ডটা দেবে বলে এতক্ষণ ঠিক করেছিল, হঠাৎ সেটা না দিয়ে অন্য একটা কার্ড দেয়। কেন দেয় ও নিজেও বুঝতে পারে না। কেন জানি না অজিতের মনে হয় তুষার হরতনের টেক্কাই ফেলবে। অজিতের দান দেখে বাকিরা ছ্যা ছ্যা করে ওঠে। কিন্তু তুষার কার্ডটা মাটিতে ফেলতেই অজিত দেখে এই রাউন্ডেও জিতে গেছে। ‘যা সিঙ্গারাটা মার গেল’। অজিত হাসতে হাসতে বলে, ‘না ভাই, এই নাও একশ টাকা, সিঙ্গারা নিয়ে এসো’।
তাসের আড্ডা শেষ হতে প্রায় রাত ন’টা বেজে যায়। পৌষালী জীবনকে দিয়ে দু’বার খবর পাঠিয়েছে আর দেরি না করতে। কিন্তু তাসের পর একথা সেকথা বলতে বলতে অজিত দেখে ঘড়ির কাটা প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। আর দেরি না করে অজিত বলে, ‘আজ উঠি আবার কাল দেখা হবে’। খাবার টেবিলে বসে অজিত মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা, এই শনিবারই আমরা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পুজো দিতে যাব, তুমি ভেবো না’। সুনন্দা দেবী ডালটা মাইক্রোওয়েভে গরম করে ডাইনিং টেবিলে রাখছিলেন। অজিতের কথা শুনে বলেন, ‘মায়ের মন ছেলেরাই বুঝতে পারে বাবা, এক্ষুণি এই কথাটাই আমি তোকে বলব ভাবছিলাম’। মা যে ঠিক এই কথাটাই ভাবছে তা কি করে অজিতের মনে এলো জানে না অজিত। কিন্তু মায়ের চোখের দিকে তাকাতেই অজিতের প্রথম এই কথাটাই মনে উদয় হল। ‘কি গো খেয়ে নাও, কি ভাবছো অতো’? পৌষালীর কথায় চমকে ওঠে অজিত। টেবিলে ঢেকে রাখা মাংসটা সরিয়ে বলে, ‘তোমার হাতে রান্না মাংস আজ অনেক দিন পরে খাব, আ., গন্ধটা খুব সুন্দর বেরিয়েছে। মনে আছে পৌষালী, বিয়ের পর প্রথমবার পুরীতে গিয়ে আমরা হলিডোহোম নিয়েছিলাম। সেখানে তুমি মাংস রেঁধেছিলে, আজও যেন সেই গন্ধটাই পাচ্ছি’।
রাতের খাওয়া হয়ে গেলে মায়ের ঘরে যায় অজিত। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বলে, ‘যেন মা ইদানীং আমার সেই ছোটবেলায় চন্দননগরের বাড়িটার কথা খুব মনে পড়ে। গোন্দলপাড়ায় আমাদের যে একতলা বাড়িটা ছিল, সামনে ফুলের বাগান। কি সুন্দর! রোজ বিকেলে তুমি আমি স্ট্যান্ড রোডে গিয়ে বসতাম।’ সুনন্দা দেবি অজিতের চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলেন, ‘তোর ইদানীং মনে পড়ে, আমি রোজ ভাবি সেই পুরানো দিনগুলোর কথা, ওগুলোই তো এখন আমার বেঁচে থাকার আশ্রয়’।
খুট্ করে দরজার কড়ার শব্দে ফিরে তাকায় অজিত। দেখে পৌষালী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পৌষালীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অজিত বলে, ‘হ্যাঁগো রাতের ওষুধ খেয়েই এ ঘরে এসেছি তুমি তো সেজন্যেই এসেছো তাই না’! এবার পৌষালী হেসে ফেলে বলে, ‘ব্যাপারটা কী, আজকাল সবার মনের কথা ধরে ফেলছো নাকি’! পৌষালী হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেও অজিতের মাথায় কথাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘটনাগুলো পর পর ভাবে। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অজিত।
বাজারের থলি হাতে পৌষালী বেরোচ্ছিল। এই তিন বছরে সংসারের যাবতীয় ঘরের বাইরের কাজ ও–ই সামলেছে। পৌষালীকে দেখে অজিত খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে ওঠে আসে তারপর পৌষালীর হাত থেকে থলিটা নিয়ে বলে, ‘আজ আমিই বাজারে যাব’। পৌষালী বাধা দেয় না। ডাক্তার বলেছে স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে অজিতকে রাখা দরকার। অজিত বাজারের থলি হাতে নিয়ে শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরে হাঁটতে থাকে। শ্যাম বাজার সবজির মার্কেটে ঢুকে পুরানো দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে। পরিচিত দোকান থেকে আগের মতো মেজাজে বাজার করে। তারপর মাছের বাজারে গোপালের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অজিতকে দেখে গোপাল বলে, ‘অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম গো দাদা বাবু, আমরা তোমার কথা কত বলাবলি করেছি, নাও নাও ভাল ইলিশ আছে’। অজিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইলিশ মাছগুলো ভাল করে দেখে। অজিতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গোপাল অজিতের দিকে মুখ তুলে তাকায়, আর ওমনি অজিতের মনে হয় গোপাল ভাবছে ইলিশ মাছটায় ওজনে মেরে খানিকটা লাভ করা যাবে। অজিত বলে ওঠে, ‘গোপাল, কথা বলতে বলতে তুমি আবার ওজনে ঠকিও না’। গোপালের মুখ শুকিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি ইলিশ মাছটা ওজন করে অজিতের থলিতে পুরে দেয়। অজিত খুশি মনে বাজার থেকে বেরিয়ে আসে। থলি ভর্তি বাজার নিয়ে একটা টানা রিকশায় ওঠে। মনের মধ্যে নানা কথা কিলবিল করে।
টানা রিকশায় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পকেট থেকে পনেরো টাকা বার করে রিকশাওয়ালার দিকে তাকাতেই অজিতের মনে হয় ও যেন আরেকটু বেশি টাকা আশা করছে। এই কাঠফাঁটা রোদে অজিত আর কিছু না ভেবে আরো পাঁচ টাকা বার করে রিকশাওয়ালার হাতে গুঁজে দেয়।
সকাল থেকেই আজ মেজাজটা ফুরফুরে। সত্যিই কি ও আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা? সামনের মানুষের মনের কথা বোঝার ক্ষমতা দেবদেবী, মুনি ঋষির থাকে। শরৎ চক্রবর্তীর লেখা স্বামী শিষ্য সংবাদ বইটায় অনেকদিন আগে এরকমই এক ঘটনা পড়েছিল অজিত। স্বামী বিবেকানন্দের এই ক্ষমতা ছিল। তিনি সামনের মানুষ কী ভাবছে তা বলে দিতে পারতেন। তাহলে অজিত কি! কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজের ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর খুব প্রয়োজন ছাড়া আয়নার সামনে দাঁড়াতো না অজিত। তিন বছরে নিজের চেহারাটা যেভাবে ভেঙেছে তা মেনে নিতে বড় কষ্ট হত। কিন্তু আজ নিজের মধ্যে এক নতুন ক্ষমতা খুঁজে বেড়াবার চেষ্টা করে।
‘কি গো স্নান করবে না’? পিছন থেকে পৌষালী জড়িয়ে ধরে অজিতকে। আয়নায় অজিত দেখে সেই আগের মতো পৌষালী জড়িয়ে আছে লতানো গাছের মতো যেন অজিতই পৌষালীর একমাত্র আশ্রয়। অজিত পৌষালীর দুটো হাত টেনে নিজের বুকে নেয়। তারপর পৌষালীর মুখটা তুলে নিজের মুখের সামনে ধরে। পৌষালী চোখটা বুজে আছে। দু’চোখ ভরে পৌষালীর বোজা চোখ দুটো দেখে অজিত। বিয়ের দিন পৌষালী অজিতের দিকে তাকাতে কি লজ্জাই না পাচ্ছিল। সেদিনের কথাটা মনে পড়তেই অজিতের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। পৌষালীর থুতনিতে হাত দিয়ে অজিত আহ্লাদের সুরে বলে, ‘এখনও এত লজ্জা’! পৌষালী পদ্মফুলের মতো বোজা চোখ দুটো আস্তে আস্তে খুলে তাকায় অজিতের দিকে। টানা টানা চোখের পাতা। অজিত দু’হাতে পৌষালীর কোমরটা ধরে পৌষালীকে বুকের মধ্যে নেয়। নতুন করে যেন শুভ দৃষ্টি হয় দু’জনের।
বাইরে পৌষালীর মোবাইলটা অনবরত বাজছে। পৌষালী এবার অজিতের হাতটা সরিয়ে ঘরের বাইরে যায়। অজিতের শরীরটা পাথরের মত স্থির হয়ে গেছে। একলা ঘরটা যেন ওকে বিদ্রুপ করছে। পৌষালীর মনের কথাগুলো অজিতের কানে বাজতে থাকে। বেশ তো ভাল চলছিল এতদিন। তিন বছরে জীবনটা একেবারে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। তুমি ফিরে এসে আমার জীবনটা একেবারে উল্টেপাল্টে দিলে। এই ক’বছরে আমার জীবনটা যে পাল্টে গেছে অজিত। আমি দীপেনকে একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করেছি। দীপেনও আমাকে ভালোবাসে। আর ক’দিন পর আমরা ভেবেছিলাম সব নতুন করে শুরু করবো। এই তিনটে বছরে কাউকে যখন পাশে যায় নি, তখন একমাত্র দীপেন এসে আমার হাত ধরেছিল, তোমার তো ফেরার কোন কথা ছিল না। ডাক্তার তো জবাব দিয়ে দিয়েছিল। এখন কি করব অজিত।
ঘরের বাইরে থেকে পৌষালীর হাসির শব্দ ভেসে আসে। অজিত আর ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সামনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। আকাশটা যেন আজ বড্ড বেশি পরিষ্কার লাগছে। কয়েক বছর আগে সামনের বাগানটায় একটা শিউলি গাছ পুঁতেছিল অজিত। এই শিউলি ফুলের গন্ধে এক সময় ঘুম ভাঙতো ওদের। আজ খেয়াল করে শিউলি গাছটা শুয়ো পোকায় ভরে গেছে। গাছের পাতাগুলো বিশ্রিভাবে খেয়ে ফেলেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় অজিতের। হালকা শিউলি ফুলের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। কি করবে এখন অজিত! শিউলি গাছটাকে কি ও বাঁচাতে পারবে!
(সংগৃহীত)