
ঢাকা, ২৪ অক্টোবর, এবিনিউজ : দেশের পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাক। ১৯৮২ সালে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটি তিন যুগের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাজ করছে। সম্প্রতি এলপিজি খাতে বিনিয়োগ করেছে এনার্জিপ্যাক। জি-গ্যাস নামে এলপিজি বাজারজাত করছে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। এলপিজিতে বিনিয়োগের বিভিন্ন দিকসহ সামগ্রিক ব্যবসা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশীদ।
এলপিজি খাতে বিনিয়োগের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু বলুন।
এলপিজিতে আসার পরিকল্পনা ছিল আজ থেকে ছয় বছর আগে। প্রাথমিকভাবে প্লান্ট স্থাপনের স্থান নির্বাচন করা হয় মংলা বন্দর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে। দুই বছর চেষ্টা করেও পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ায় খুলনার দাকোপে প্রকল্পটি স্থানান্তর করতে হয়। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে যেতে হয় দুটি নদী পেরিয়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, দুর্বল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব— এমন সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দাকোপের চুনখালী ইউনিয়নে এলপিজি প্লান্টটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই আমরা। এর একটিই কারণ ছিল, নদীপথে যাতায়াতের সুবিধা।
নতুন স্থান নির্বাচনের পর প্রথমেই পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিই আমরা। আগের অভিজ্ঞতা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদেশ থেকে বাল্ক এলপিজি কিনে এনে সংরক্ষণ ও তা পরবর্তীতে বোতলজাত করার উদ্দেশ্যে এ প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রায় ৬০ বিঘা জায়গা কেনা হয়। প্রকল্পের সঙ্গে একটি জেটিও নির্মাণ করা হয়েছে। আগামীতে সংলগ্ন স্থানে নতুন কোনো প্রকল্প স্থাপন করলেও জেটিটি ব্যবহার করা যাবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কী ধরনের জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন?
অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এ প্রকল্প স্থাপনে সময় লেগেছে ১ বছর ৭ মাস। চ্যালেঞ্জিং বলছি এ কারণে যে, দুটি বর্ষা মৌসুম পার করতে হয়েছে। ১৫-১৬ ফুট উঁচু মাটি ফেলতে হয়েছে। এছাড়া জেটি তৈরি করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ১৬টি লাইসেন্স নেয়া। এসব লাইসেন্স পাওয়ার পরই জেটিতে এলপিজি আমদানি করে কাজ শুরু করতে পেরেছি। চ্যালেঞ্জটিকে শনাক্ত করে আগামীতে এক স্থান থেকে এসব লাইসেন্স দেয়ার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে ব্যবসা শুরু করতে উদ্যোক্তাদের সময়, ব্যয় ও ভোগান্তি (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) কমে আসবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) মতো এক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সেবা চালু করা যেতে পারে।
যেসব লাইসেন্স নিতে হয়েছে, তার কোনোটি পাওয়ার ক্ষেত্রে সময় নির্ধারিত নেই। ফলে অনিশ্চয়তায় থাকতে হয়। যেকোনো বিনিয়োগকারীর জন্য এ লাইসেন্সিং পদ্ধতি বড় ধরনের ভোগান্তির কারণ। প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নে মাটি ফেলার ক্ষেত্রে যতটুকু কষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্টসাধ্য ছিল লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি।
প্রকল্পের ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত এ জনপদে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি। শুধু প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানই নয়, অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। গ্রামের অনেক নারী এখন দোকানে খাবার বিক্রি করছেন। এতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন তারা। যে মাঝি সারা দিনে হয়তো একবার নদী পারাপার করতে পারতেন, তিনি এখন দিনে কয়েকবার পারাপারের অপেক্ষায় থাকা মানুষকে নদী পার করে দেন। প্রকল্পে নিয়মিত গড়ে ২০০ মানুষের পাশাপাশি আরো কয়েক গুণ মানুষ চুক্তিভিত্তিক নানা কাজে নিযুক্ত থাকবেন।
বাংলাদেশে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। খাতটির সম্ভাবনা কেমন?
জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে এলপিজির বড় সম্ভাবনা রয়েছে। আমার মনে হয়, এ খাতে দেশে আরো প্রকল্প আসা প্রয়োজন। কারণ এর চাহিদা বাড়ছে। এলপিজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
ভারতে এলপিজি পেনিট্রেশন যেখানে ৭৪-৭৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১৫-২০ শতাংশ। ভারতে এলপিজির বার্ষিক চাহিদা এখন ২২ মিলিয়ন টন। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটিতে এ চাহিদা ৪০ মিলিয়ন টনে গিয়ে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে এখন এলপিজির চাহিদা এক মিলিয়ন টনেরও কম। ভারতের জনসংখ্যার আকার বিবেচনায় নিলেও এলপিজির চাহিদার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছি আমরা।
দেশের জ্বালানি খাতে এলপিজি টেকসই ভূমিকা রাখতে পারবে কি?
শিগগিরই এক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। এলপিজির চাহিদা দু-তিন বছরের মধ্যেই বার্ষিক এক মিলিয়ন টনে পৌঁছে যাবে। জ্বালানি খাতে ভারসাম্যের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বড় একটি ব্যবধান তৈরি করেছে গ্যাসের প্রাপ্যতা। পূর্বাঞ্চলের অনেক স্থানেই এটি সহজলভ্য হলেও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নেই। রাজধানীতে ভর্তুকি মূল্যে বাসাবাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। অথচ যশোর বা খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সে সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে প্রতিবাদ হয়, তাতে রাজধানী ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর মানুষের কোনো সুবিধা হয় না। রাজধানীতে যে জ্বালানির মূল্য ৮০০ টাকা, তা কুড়িগ্রামে আরো কমে সরবরাহ করা উচিত।
শিল্পে এলপিজি ব্যবহারের সম্ভাবনা কতটুকু?
শিল্প-কারখানাগুলোকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। শ্রমশক্তি যেসব অঞ্চলে রয়েছে, সেসব অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। গাজীপুরে যারা কাজ করছেন, তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। ফলে যেসব জায়গা থেকে তারা আসছেন, সেখানে এসব কারখানা স্থাপন করা হলে ওই অঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এলপিজির মাধ্যমে এসব স্থানে শিল্প-কারখানার জ্বালানির সংস্থান করা যেতে পারে।
রান্নার কাজে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরতার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আমাদের দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার একটি নতুন অংশ এলপিজি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো যেসব দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে, তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে এটি ব্যবহার নিরুত্সাহিত করেছে। বরং এলপিজির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে গুরুত্ব দিয়েছে তারা। এসব দেশ প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানিও করে।
রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য সারা বিশ্বেই এলপিজি অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমাদের দেশে বাসাবাড়িতে ব্যবহারের জন্য এটি প্রচলিত। আগামীতে শিল্পেও ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। শিল্পে বয়লারসহ অন্যান্য হিটিং প্রক্রিয়ায় এলপিজি ব্যবহার হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসে যে কারখানা চলছে, সেটির সঙ্গে এলপিজিতে যে কারখানা চলবে, তার মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে। এজন্য খাতসংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ করা যেতে পারে।
সারা দেশে এলপিজির ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন?
দেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো কাঠ-কয়লা দিয়ে রান্না হয়। এতে শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে এলপিজি একটি সাশ্রয়ী বিকল্প হতে পারে। ভারতে এজন্য এলপিজিতে ভর্তুকি দিচ্ছে দেশটির সরকার। সারা দেশে এলপিজির ব্যবহার বাড়াতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ছোট সিলিন্ডারের ওপর ভর্তুকি দেয়া হয়। ছোট পরিবারগুলোর মধ্যে এলপিজির ব্যবহার বাড়াতে এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
এলপিজি খাতের সম্প্রসারণে সরকারের ভূমিকা কতখানি সহায়ক?
আমাদের দেশে এলপিজির অফুরন্ত ভবিষ্যৎ রয়েছে। সরকার এরই মধ্যে নীতিমালা তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে, যা খুবই ইতিবাচক। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে সরকারের গুরুত্ব দিতে হবে। গাজীপুরে শিল্প স্থাপনে যে সুবিধা দেয়া হয়, তার চেয়ে বেশি সুবিধা থাকা প্রয়োজন প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষেত্রে। তা না হলে সুস্থ শিল্পায়ন সম্ভব হবে না।
এলপিজিতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রসঙ্গে জানতে চাই।
আমরা অনেক দিন ধরেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাজ করছি। ফলে ব্যবসাটি আমরা বুঝি। এজন্যই এলপিজি খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছি আমরা। আগেই বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এলপিজি ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে রয়েছি। রান্নার গ্যাস কিংবা যানবাহনে ব্যবহূত গ্যাসের ক্ষেত্রে বর্তমানের যে চিত্র, তা শিগগিরই পরিবর্তিত হবে। এলএনজি আসছে। এটি মূলত শিল্পে ব্যবহার হবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি মিক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে এলএনজির সমন্বয় প্রয়োজন হবে।
আগামী দিনে এ খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে কি?
এলপিজি প্লান্টটির সঙ্গে নদীপথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় আগামীতে এটির সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে। কারণ আমদানির পাশাপাশি বোতলজাত এলপিজি নদীপথেই সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এতে ব্যয় সাশ্রয় হবে।
বাজারে এলপিজি খাতে অনেকগুলো ব্র্যান্ড রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জি-গ্যাসের বিশেষ দিকগুলো সম্পর্কে বলুন।
এনার্জিপ্যাকের প্রতি গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের আস্থা রয়েছে। দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানসম্পন্ন এনার্জি সেভিং ল্যাম্প প্রস্তুতকারী হিসেবে মানুষ আমাদের চেনে। এছাড়া ইলেকট্রিক সুইচ, ফ্যানসহ অন্যান্য পণ্যও রয়েছে আমাদের। মানের বিষয়ে এসব পণ্যে ভোক্তাদের দৃঢ় আস্থা রয়েছে। আর গ্যাসের মান ও সিলিন্ডারের নিরাপত্তা— এ দুটি ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে আশা করছি, এলপিজির নতুন ব্র্যান্ড জি-গ্যাসও ভোক্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সৌজন্যে: বণিক বার্তা