বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

মধ্য রাতের গদ্য

মধ্য রাতের গদ্য

মিলন বনিক, ৩০ অক্টোবর, এবিনিউজ : কে সি দে রোডে ফুটপাতের উপর শমশু মিয়ার ঝুপড়ি দোকান।

সারা রাত খোলা থাকে। রাতের বেলা কাস্টমারও বেশি। দোকানে শুধু চা, গরুর দুধ, বনরুটি আর টোস্ট বিক্রি হয়। দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল। চট্টগ্রাম থেকে গাড়িগুলো সব এখান থেকেই ছাড়ে। যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। রাত দু’টোর পর ভিড়টা একটু কম। দু’টোর পরে দূরপাল্লার কোনো গাড়ি ছাড়ে না, পৌঁছায়ও না। ওদিকে পাঁচটার পর এক এক করে দূরের গাড়িগুলো পৌঁছতে থাকে। লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। মাঝখানের সময়টােেত শমশুমিয়া একটু জিরিয়ে নেয়। সাথে থাকে দশ বারো বছরের নুরু। পুরো নাম নুরুল ইসলাম।

মাঘ মাসের কনকনে ঠাণ্ডা। দু’একজন কাস্টমার আছে। তারা সবাই রাস্তার ছিন্নমুল মানুষ। গায়ে ময়লা চাদর, মাথায় মাফলার মুড়ি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। মাথার ওপর তেলপারের ছাউনি। বাইরে কুয়াশার আস্তর। শহরের নিয়নবাতিগুলো খুব কাছে থেকেও ঝাপসা দেখাচ্ছে। কাস্টমারকে চা দিয়ে নুরু তাড়াতাড়ি আগুনের চুলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আগুনের তাপ নিয়ে দুই হাতের তালু সেঁকে নেয়। তারপর আগুনে স্যাঁকা গরম হাতের তালু দুইটা কতক্ষন পর পর নাকে মুখে বুলিয়ে নেয়। তাতে একটু গরম আঁচ লাগে। কিছুটা আরাম বোধ হয়। শরীর চাঙ্গা হয়। ভালো লাগে।

রঞ্জুর সাথে সুব্রত এই প্রথম সিনেমা দেখতে এসেছে শহরে। বিকাল তিনটার শো দেখাবে রঞ্জু। ছয়টায় শেষ। ব্যাস। সিনেমা শেষে সন্ধ্যার পর পর বাড়ি ফিরে যাবে দুই বন্ধু। সিনেমা প্যালেসে জীবনে এই প্রথম সিনেমা দেখবে সুব্রত। একেবারে আনাড়ি। অপরদিকে রঞ্জু পুরানো চালু মাল। বয়সেও বড়। পেটে মিউনিসিপ্যালিটির পানি পড়েছে অনেক আগে। লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি।

জীবন জীবিকার তাগিদে স্যাঁকরার কাজে লেগে পড়েছে অল্প বয়সে। কাজ শেখা প্রায়ই শেষ। এখন নিজেই জমাদারি বসবে। নিজের একটা গদি হবে। নিজেই কাজ করবে। নিজেই আয় রোজগার করবে। জীবন ও জীবিকার কঠোর সংগ্রামে আজ সে জয়ী হতে চলেছে। সেই সাথে ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার গুরুদায়িত্ব রঞ্জুর কাঁধে। অনেকদিন পর গ্রামে এসেছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আনন্দ, হৈচৈ করে আবার ফিরে যেতে হবে শহরে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে।

আড্ডার এক পর্যায়ে সুব্রতই প্রশ্নটা করলো,

– এবার তো জমাদারি বসলি। কী খাওয়াবি বল?

– গ্রামে আর কী খাবি? চল, শহরে। সিনেমা দেখাবো। আর যা খেতে চাস, খাওয়াবো।

– সে কী? কোন হলে?

– সিনেমা প্যালেস।

– কখন?

সিকো ফাইভ হাত ঘড়িটা দেখে বললো,

– তিনটা ছয়টা। এখন বারোটা বাজে। খেয়ে বের হলে তিনটার মধ্যে শহরে পৌঁছে যাবো।

আসার ভাবনাটা সুব্রত ভাবেনি। এই প্রথম সিনেমা দেখা হবে। এতো কম আনন্দের কথা নয়! মেট্রিক পাস করে পড়াশোনা আর এগোয়নি। গ্রামে চাষবাস নিয়ে থাকে। শহরে খুব একটা আসা হয়না। ছোটবেলায় একবার বড়’দার সাথে সিনেমা দেখেছিলো। কোন হলে মনে নেয়। শুধু এটুকু মনে আছে যে, হলের মধ্যে যখন মুষলধারে বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো তখন সুব্রত ভয়ে কান্না করে দিয়েছিলো। বৌদি হেসে বলেছিলো, এই সবু, কান্না করছিস কেনো? এতো সিনেমার দৃশ্য।

আজ রঞ্জুর সাথে সিনেমা দেখা হলো, রাতে আর বাড়ি ফেরা হলোনা। এই হাঁড় কাঁপানো শীতে রীতিমতো কান্না পাচ্ছে সুব্রতর। এই শীতের রাতে এত কষ্ট কেউ করে? শহরের একটা কাক–পক্ষিও জেগে নেই। গায়ে গরম জামা নেই। একটা সুইসবল কাপড়ের ফুল শার্ট। কে জানতো যে সারারাত থাকতে হবে? যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে গেলে এতো কষ্ট হতো না। এখন বাড়িতে নিশ্চয় সবাই চিন্তা করছে। সমশুমিয়া বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে দু’জনের দিকে। রাতের শহর। কত কিছিমের লোকজনের আসা যাওয়া। কার মনে কী আছে? কে কোন উদ্দ্যেশে পথ চলছে তা কে জানে?

সমশু মিয়ার দোকানের একপাশে টুলের ওপর হাত পা গুটিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে রঞ্জু আর সুব্রত। একজন চোখ বুজে ঝিমোচ্ছে তো অন্যজন চোখ মেলে পাহারা দিচ্ছে। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় সেজন্য সতর্ক থাকা। মাঝে মধ্যে গরম দুধ আর চা খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতেও সমশুমিয়ার মন ভরছে না। রাত প্রায় দু’টো। অবশেষে সমশুমিয়া বলেই ফেললো–

– তোমরা কই যাবা? হেই রাত সাড়ে বারোটা থেইকা বইসা আছো। মতলব কী?

রঞ্জু চালাক। খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,

– আমাদের এক আত্মীয় আসবে। তাই অপেক্ষা করছি।

রঞ্জু মিথ্যা বললো কেন তা সুব্রতর মাথায় আসছে না। কোনো আত্মীয় তো আসবে না। বরং বিপদে পরে এই শীতের মধ্যে ফুটপাতে বসে রাত কাটাতে হচ্ছে। সেটা বললেই হতো। সমশুমিয়া ভালোই জানে, এটা স্রেফ মিথ্যা কথা। তাই জোড় দিয়ে বললো,

– মিছা কথা কও ক্যান? অহন তো আর কোনো গাড়ি আইবো না।

রঞ্জু চুপসে গেলো। রঞ্জুর চেয়েও বড় চালাক এই সমশুমিয়া। ফিক করে হেসে দিলো নুরু। বললো,

– ওস্তাদ, মামারা মনে অ’য় বিপদে পড়ছে। অহন কই যাইবো এত রাইতে। দোকান বন্ধ কইরা দিমু।

লোকজনের চলাচল থেমে গেছে। সমশুমিয়া গদিতে বসে ঝিমুচ্ছে। নুরু একটা টুলে হাত দু’টো দুই উরশুর মধ্যে গুঁজে দিয়ে শুয়ে পড়েছে। জেগে আছে রঞ্জু। সুব্রতর মোটেও ঠাণ্ডা সহ্য হচ্ছে না। রীতিমতো শরীর কাঁপছে। ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। একটু ওম পেলে এখনি ঘুমিয়ে পড়তো। লাল হয়ে আছে চোখ দুটো। এত রাতে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে খরগোশের মতো কান খাড়া করে দিয়েছে রঞ্জু। এ আবার কোন বিপদ? চোখ মেলে তাকিয়ে আছে সুব্রত। মেয়ে দু’টোর উগ্র সাজ পোশাক। পরনে লাল টকটকে প্রিন্টের শাড়ি। দুজন সমশুমিয়ার দুপাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

একজন সমশুমিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ঐ ছমশু, দুইটা টাটকা গরম লাল চা লাগা।

– ঐ শেফালি, এত রাইতে কত্তুন আইলি?

– আমাগো কাম তো রাইতে। রাইতে না আইসা দিনে আসুম ক্যা? আর কইছ না। এক মাগীর পুতে ডাইকা নিয়া গেলো।

কই নিয়ে গেলো তা সমশু জানে। ওদের কথাবার্তা সুব্রতর ভালো লাগছে না। বিশ্রি রকমের চোখের চাহনি। তীক্ষ্ম, রু । রঞ্জুর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। কথা বলছে সমশুমিয়ার সাথে কিন্তু চোখ দুটো রঞ্জুর দিকে স্থির। রঞ্জুও বুঝে গেছে ওরা কারা। এই শহরে রঞ্জুর অনেক দিনের যাওয়া আসা। অলি গলি ভালোই চেনে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। বাঁকা ঠোঁটে রঞ্জুর দিয়ে তাকিয়ে বললো–

– মাগীর পুতে কাম কইরা কয়, ট্যাহা নাই।

– ব্যাটার লুঙ্গিটা খুইলা রাখলি না ক্যান? পাল্টা প্রশ্ন করলো সমশুমিয়া।

– মাদারির লগে কিছু নাই। হাতঘড়ি আর শার্টটা খুইলা খালি গায়ে হান্দাইয়া দিছি।

সুব্রতর শরীর ঘামছে। যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে ভীষণ ভয় করছে। এই শীতেও ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে না। মিটমিট করে হাসছে রঞ্জু। ফিসফিস করে বললো– চুপ করে বসে থাক।

সমশুমিয়া চা বানিয়ে দেয়। চায়ে চুমুক দেয় শেফালি। তীক্ষ্ম চোখে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ঐ রেহানা, ঠাণ্ডা পরতাছে। শরীর গরম কইরা ল। নতুন নাগর পাইলে কামে লাগামু।

সুব্রতর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় যাবে? সুব্রতর এক দূরসম্পর্কের ভাই আছে টেরিবাজারে। এত রাতে ওখানে যাওয়াও ঠিক হবে না। কোনোভাবেই সহজভাবে মেনে নেবে না। হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আত্মীয়স্বজন যাওয়াটা পছন্দ করেন না বলে কেউ যায়ও না।

রেহানা এতক্ষন সমশুমিয়ার গা ঘেঁষে ঘুরঘুর করছিল। পারলে যেন কোলে বসে পরে। চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললো,

– মনে হয়, শহরের নতুন মাল। সাহস নাই। দেহস না, বইয়া বইয়া ভিজা কুড়ার মতোন ঝিমাইতাছে।

– ল, আমাগো লগে বাসায় নিয়া ঘুম পাড়াইয়া দিই। রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললো শেফালি।

পিলে চমকে গেলো রঞ্জুর। সুব্রতর মনে হলো রঞ্জু এবার ঠিকই ভয় পেয়েছে। সুব্রতর হাতে চিমটি কাটলো রঞ্জু। বিপদ সংকেত। এই মুহূর্তে বাইরে বের হওয়া মুশকিল। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই। সমশুমিয়ার সাথে রেহানা শেফালির ভালোই জানাশোনা। রঞ্জুর চেয়ে সুব্রত আরও বেশি ভীতু। সমশুমিয়া বুঝতে পেরেছে। ভালো মানুষের মতো বললো,

– বিপদে পইড়া রাইত কাটাইতেছে। ঝামেলা করিস না।

– ওরে বুইড়া মরদ, তুই এত দরদ দেখাস ক্যান?

কাছে কোথাও ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। মাইকে ওয়াজের সুন্দর সুর ভেসে আসছে। খুব কাছে কোথাও হবে। রঞ্জু হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

– চল।

– কোথায়? সুব্রত উৎকণ্ঠার সাথে বললো।

রেহানা বিশ্রি হেসে বলে উঠলো,

– ল, আমাগো লগে যাই। সুখ দিমু।

রঞ্জু কোন কথা বললো না। সুব্রতর হাত ধরে টেনে রাস্তায় নামিয়ে বললো,

– চল। ওয়াজ শুনবো।

– কোথায়?

– ঐ তো। মাইকে শোনা যাচ্ছে। খুরশিদ মহলের সামনে।

সুব্রত ভরসা পেলো। ওখানে অনেক লোকজন আছে। কোনো সমস্যা হবে না। পেছনে এক কোণায় বসে থাকা যাবে। রঞ্জুর হাত ধরে রাস্তায় নেমেছে সুব্রত। দ্রুত দৌড়ে পালাতে গিয়েও পা থমকে যাচ্ছে। রেহানা থু করে একগাল টকটকে লাল পানের পিক রঞ্জুর সামনে ফেলে আঙ্গুলের মাথা থেকে চুন মুখে দিয়ে অসভ্যের মতো হাসছে। খুব রাগ হচ্ছে সুব্রতর। এ কেমন নির্লজ্জ মেয়েরে বাবা। পিকের কয়েক ফোটা রঞ্জুর গায়েও পড়েছে। প্রতিবাদ করলেই বিপদ। রঞ্জু তা জানে।

দু’জন লুঙ্গি পরা লোক এলো। পুরাই মাতাল। গলায় মাফলার। মাথায় উলের টুপি। অবিন্যস্ত দাঁড়ি গোফ। পা দুটো টলছে। সমানে পান চিবোচ্ছে আর সিগারেট টানছে। একজন লুঙ্গির কাঁচা উরু পর্যন্ত তুলে হাঁটছে। অন্যজন রেহানার হাত ধরে টেনে বললো–

– ঐ রেহানা, চল। দুইশ ট্যঁ’আ দিয়ুম।

ওদের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। খেঁকিয়ে উঠলো রেহানা,

– পুরান মরদ, বাইক্যা মজা লুটতে আইছস। ছ্যাং কাডি হাতে ধরাই দিলে বুঝবি, রেহানা কী জিনিস। আগের ট্যাহা দে। এই লাইনে বাকি কাম নাই।

– ল’ চল। আগরগুন’অ দিয়ুম।

– আগে দে। তাইলে ভালা কইরা সোহাগ দিয়া দিমুনে।

অন্যজন পকেট থেকে দুইটা একশো টাকার নোট দেখিয়ে বললো,

– এই চা, একদম পেরেশ নোট। ল’ চল।

– ঐ শেফালি, এই মাদারি দেখি নতুন নাগরের সোহাগ লইতে দিবো না। চল আগে নগদ কামাইয়া লই। পরে দেহা যাইবো নে।

চোখের সামনেই ওরা ফুটপাত ধরে কিছুদূর গিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। সুব্রত হাঁফ ছেড়ে বললো,

– যাক বাবা, বাঁচা গেলো।

রঞ্জুকে দোষারোপ করে বললো,

– তোর জন্য আজ এই অবস্থা। এত কষ্ট পেতে হচ্ছে।

– আমি কি জানতাম, মুসলিম হলের ভ্যারাইটি শো’টা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে?

– আমি তো কখনও ভ্যারাইটি শো দেখিনি। আমার জানার কথাও নয়।

– তাতে কী হয়েছে? আজ তো দেখেছিস।

– তা দেখেছি।

– জরিনার নাচটা কেমন লেগেছে বল?

– যেভাবে নাচলো, তাতে তো মনে হলো স্টেজ ভেঙ্গে পড়বে। ভাগ্যিস পড়েনি।

– দেখলি তো, জরিনার সাথে কত মানুষ মাতালের মতো নাচলো।

– তা দেখেছি। ওরাও তো মাতাল।

– মাতাল বলেই তো মজা পেয়েছে। আমরা মাতাল হতে পারিনি, তাই মজাও পায়নি।

– মজার দরকার নেই। ভাগ্য ভালো যে, রেহানা শেফালির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। তা না হলে, মজা কী জিনিস হাঁড়ে হাঁড়ে বুঝিয়ে দিতো।

খুরশিদ মহলের সামনে হকার মার্কেট। মার্কেটের সামনে বিশাল প্যান্ডেল। সামিয়ানা ঠাঙানো। অনেক লোক। সবার মাথায় টুপি। হুজুরদের সাথে সাথে আল্লাহু–আকবর ধ্বনি তুলে ওয়াজ করছে সবাই। মাঝে মধ্যে আমেন বলে দু’হাত ওপরে তুলে মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে।

রঞ্জু কিংবা সুব্রত এ ধরনের জিকিরে অভ্যস্থ নয়। রেহানা, শেফালি কিংবা টং দোকানের মালিক সমশুমিয়ার ভয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে। এখানে পরিচিত কেউ থাকার কথা নয়। কে কাকে চিনবে? কোনোভাবে রাতটা পার করতে পারলেই হলো। সকালের প্রথম বাসে বাড়ির পথ ধরবে। মাথায় রুমাল বেঁধে একেবারে পেছনের সারিতে ওরা দু’জন হাঁটু গেড়ে বসেছে। তাতে একটু আরাম বোধ হচ্ছে। কানের ঠাণ্ডাটা কম লাগছে। ভালোই হলো।

পাশের ভদ্রলোক মোনাজাত করছেন। বার বার আড়চোখে দেখছেন। বুকটা কেঁপে উঠলো সুব্রতর। তবে কি বুঝে ফেলেছে আমরা বিধর্মী? কীভাবে বোঝাবো? যদি কিছু মনে করেন? যদি আমাদের ভুল বুঝেন? রাত তিনটা বাজে। মাহফিল শেষের দিকে। মাইকে ঘোষণা এলো, মোনাজাত শেষে আপনারা সবাই তবরুক নিয়ে যাবেন। সব ভক্তপ্রাণ মুসুল্লিরা যেমন করছেন, রঞ্জু ও সুব্রত দুইহাত উপরে তুলে একইভাবে মোনাজাত করছে। সুব্রত ভাবলো, সৃষ্টিকর্তা তো এক। আমরা আমাদের মতো ডাকছি। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় আমাদের সহায় হবেন। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।

মোনাজাত শেষে পেছন থেকে একজন জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের নাম কী?

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। লোকটি পেছনে থাকাতে এতক্ষণ সুব্রত বা রঞ্জু খেয়াল করেনি। লোকটির বিদঘুটে চেহারা। চোখ দুটো লাল। মোটা গোঁফ। কুচকুচে কালো গায়ের রং। রঞ্জু ভালো করে দেখে নিলো। কালো পাঞ্জাবি। অন্ধকাণ্ডে যে কেউ দেখলে ভয় পাবে। রঞ্জু সুব্রতর উরুতে চিমটি কাটলো। সুব্রত বুঝে নিলো এ আরেক বিপদ। যেভাবে হোক সামাল দিতে হবে। রাত আর বেশি নেই।

কোনো জবাব না পেয়ে লোকটি চোখ বড় করে তাকালো। গোঁফে বাম হাত বুলিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো,

– নাম কী?

– আবদুস শুক্কুর। জবাব দিলো রঞ্জু।

– বাড়ি কোথায়?

– নোয়াপাড়া।

মনে হলো ল্যাটা চুকে গেছে। মাহফিল শেষ। যে যার মতো ওঠে তবরুকের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছে। পলিথিনে করে তবরুক নিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। রঞ্জু আর সুব্রত প্যান্ডেলের একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুযোগ পেলেই ফিরে আসবে সমশুমিয়ার দোকানে। আর কোনো উপায় নেই। পা বাড়ালো রঞ্জু। পেছন থেকে রঞ্জুর পিঠে হাত রেখে লোকটি বললো–

– মাহফিলে এসেছো। তবরুক না নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? চলো তোমাদের তবরুক নিয়ে দিচ্ছি।

– গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ। আমার এলার্জি আছে। বললো সুব্রত।

– দুজনেরই এলার্জি?

– হুঁম। সায় দিলো রঞ্জু।

এবার আসল কথাটা বলেই ফেললো লোকটি।

– আমি তোমাদের অনেকক্ষণ ধরে ফলো করছি। চলো আমার বাসায়। কোনো অসুবিধা হবে না।

লোকটির বলার ভঙ্গিতে পিলে চমকালো। শেফালি রেহানার চাইতেও বড় ভয়। রঞ্জু সবকিছু খুলে বললো। লোকটি আর কিছু বলেনি। রঞ্জু আর সুব্রত আবার সমশুমিয়ার দোকানে পা গুটিয়ে বসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাবছে, কখন সকাল হবে?

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত