![নিয়তি](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/11/04/nioti_109025.jpg)
আহমেদ মনসুর, ০৪ নভেম্বর, এবিনিউজ : লাশটি পড়ে আছে বাথরুমে। পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়ানো অবধি কেউ জানতেও পারবে না। ঘরে ভিতর থেকে খিল দেওয়া। লাশটি ইফতি রহমানের। তিনি ছিলেন একা মানুষ। বয়স ষাটের অধিক হলেও বিয়ে টা করেননি। বাবা–মার একমাত্র সন্তান বলে খুব আহ্লাদী ছিলেন। মাধ্যমিক পাস করার পর বাবা–মার কাছে বায়না ধরলেন গ্রাম্য যাত্রাদলের সাথে গান করবেন। বাবা হাজী বদরুল মোল্লা ছিলেন পাড়ার মসজিদের পাঞ্জেগানা ইমাম। রক্ষণশীল মনষ্ক। তার উপর ইমাম সাহেবের ছেলে নাট্যগিরি করে বেড়ালে পাড়ার কেউ কি আর তার পিছনে নামাজের নিয়ত করতে চাইবে? সবাই বলাবলি করবে, দেখ আলেমের ঘরে জালেম পয়দা হয়েছে। বদরুল মোল্লার তাতে নাক কান কাটা যাবে না? কাজেই তিনি ছেলেকে যাত্রাদলে যোগ দিতে দিলেন তো নাই উল্টো বেদড়ম মারধর করেন।
‘ছেলেটার সুমধুর কণ্ঠ, কত ভালো গানের গলা। জগতের সকল সুরগুলো যেন গলার মধ্যে ভাঁজে ভাঁজে বসানো। ছোটবেলায় মসজিদের মাইকে কত সুন্দর হামদ–নাত গাইত। লোকে তন্ময় হয়ে শুনতো আর প্রশংসার আপ্তবাক্য ছড়াতো। কি ভূতে পেয়ে গেলো ছেলেটাকে কি জানি।’ খানিকটা আক্ষেপ আর দুঃখ করেই বললেন ইফতির মা বিলকিস বানু। ‘ভূতে নয়, ভূতে নয়, পেয়েছে ঐ যাত্রাদলের মালাউন দলপতি শম্ভুনাথ পোদ্দার। নিত্য কান পড়া দিলে ওরকম ইবলিশও ফেরেশ্তা হয়ে যায় আর ফেরেশ্তাও পাড় শয়তান হয়ে যায়’ বললেন– বদরুল মোল্লা।
পিতার হাতের উত্তম–মধ্যম খেয়ে ইফতি স্থির করলেন এ ঘরে আর থাকবে না। বাবা–মার অজান্তে একদিন সুযোগ বুঝে ছায়াঘেরা সুনসান সুনীবিড় কাঞ্চনতলী গ্রাম ছেড়ে চিরতরে ঢাকা শহরে পাড়ি জমায়। পালিয়েছিলেন রাগের মাথায়, আবেগের বশে, কিন্তু ঢাকাই যে তার আমৃত্যু নিবাস হবে সেটা কি তিনি তখন জানতেন?
শত চেষ্টা তদবির করেও বদরুল মোল্লা আর তাঁর সন্তানকে ঘরে ফেরাতে পারেন নি। একসময় তার হাতেই শরবত খেয়ে ভবের মায়া ত্যাগ করেন বিলকিস বানু। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতেই তিনি গেলেন। নয় আরো কিছুদিন হয়ত পৃথিবীর দানা পানি খেতে পারতেন। মায়ের মৃত্যুর সংবাদ লিখে ছেলের কাছে চিঠি লিখলেন বদরুল মোল্লা। অনেকটা আবেগ ঢেলে দিয়েই লিখেছিলেন চিঠিটা। ভেবেছিলেন, মাতৃবিয়োগের সংবাদ হয়ত ছেলেকে পীড়া দেবে। ফিরে আসবে ঘরে। কিন্তু ইফতিকে তা পীড়া দেয়নি। সে ফেরেনি। স্ত্রী–সন্তানের শোকে শোকে বদরুল মোল্লাও আর বেশিদিন টেকেননি। ভিটায় এখন সাত দোন–এর পুকুর, আশপাশের লোক আর শরীকরাই এখন ভোগ–দখল করে খাচ্ছে সব।
ইফতি রহমান ঢাকা শহরে বহু লাঞ্চনা–গঞ্জনা ভোগ করার পর পরিশেষে একটা পত্রিকা অফিসে ছোটখাটো একটা চাকুরী জুটিয়ে নেন। প্রথম প্রথম টুকটাক কবিতা–টবিতাও তিনি লিখতেন। পরে অবশ্য সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতে আরম্ভ করেন। তাতে পয়সা–কড়িও বেশ হাতে আসত। রামপুরায় একটা বাসা নিয়ে একাই তিনি থাকতে।
এরাদা করেছিলেন কখনো বিয়ে করবেন না। বিয়ে পরধীন জীবন। পরিবার মানে শিকল। যখন যা ইচ্ছে করবার প্রেরণা নষ্ট হয়ে যাবার জন্য একমাত্র পারিবারিক সম্পর্কই দায়ী, তাঁর বিশ্বাস। তাই তিনি জগতের সকল সম্পর্ক থেকে নিজেকে সযতনে আর কৌশলে আলাদা রেখেছেন।
আয়কৃত অর্থের প্রায় অর্ধেকটা তিনি সিগারেট আর পানশালায় খরচ করতেন। বাকিটা তিনি এ ওর সাথে আড্ডা দিয়ে আর যে কোন কারো বিপদে–আপদে আগ বাড়িয়ে বিলিয়ে দিতেন। আর দশজনের মতো জীবনের কোন হিসাব তিনি কখনো করেননি। বেহিসাবি ছন্নছাড়া আর অনেকটা বোহেমিয়ান জীবনে যখন যাকে ভাল লেগেছে তার পিছনে ছুটেছেন, ঘুরেছেন। দুই হাত খুলে শুধু যাকে তাকে দিয়েছেন। পাবার আশা তাঁর ছিলো না কখনো।
২.
ইফতি রহমান বিয়ে না করলেও প্রেম করে বেড়িয়েছেন দিব্যি। একাধিক প্রেমের ইতিহাস আছে তাঁর। যদিও ওসব সম্পর্ক কখনো স্থায়ী হতো না। উড়নচন্ডী ধরনের জীবন বলেই এমনটা হতো। এর মধ্য থেকে একটা কাহিনী শুধু এখানে তুলে ধরা যাক।
একটা অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করবেন ইফতি রহমান। একই অনুষ্ঠানে তারই একটা কবিতা পড়বেন অন্য একজন আবৃত্তিশিল্পী। আবৃত্তিশিল্পী ইডেন কলেজের ছাত্রী। লুবনা সাইমুন। দেখতে শুনতে যেমন লাবণ্যময়ী, কণ্ঠও সুমধুর। লুবনার কণ্ঠে নিজের কবিতা শুনতে শুনতে বিমোহিত হলেন ইফতি। নিমিষেই হারিয়ে গেলেন কোন অজানায়।
কবিতা পাঠ শেষে লুবনা কবির কাছে এলেন। শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। লুবনা ইফতির কবিতা নিয়মিত পড়েন। ভালো লাগে। ইফতি তার একটা কার্ড দিলেন লুবনাকে। তিনি তা ভ্যানিটি ব্যাগে গুজে রাখতে রাখতে চোখের পলকে এমোনিয়া গ্যাসের মতন কোথায় মিলিয়ে গেলেন। ইফতি তাকে অনেক খুঁজেও পায়নি।
ইফতি সেদিন অফিস থেকে ফিরে হুমায়ূন আজাদের ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ বইটি হাতে বিছানায় বসে পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো নারীকণ্ঠ।
–আমি লুবনা, কেমন আছেন?
–আমি ভালো, আপনি?
–আছি ভালো। আপনার একটা কবিতা পড়ছিলাম। ‘ভালোবাসার সপ্তডিঙা’। একটা শব্দ বুঝতে পারছিলাম না। ‘কুহেলিকা’। আপনি এর দ্বারা আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন?
-‘কুহেলিকা’ মানে কুয়াশা। পবিত্র প্রেমের মধ্যখানে মাঝেমাঝে ভিলেন এসে দাঁড়িয়ে যায় না, ওটাই।
–ওহ! তাই বলেন। ঐ শব্দটির জন্য পুরো কবিতাটার মিনিং পরিষ্কার হচ্ছিল না। অনেকবার পড়েছি। কি রকম যেন একটা মোহ আছে আপনার কবিতায়। অর্থ না বুঝেও হরদম পড়া যায়। বারবার পড়তে মন চায়। আরামবোধ হয় পড়তে।
এভাবে মাঝে মাঝেই লুবনার কল আসে। ইফতি কথায় মায়া মিশিয়ে কাব্যিক ছন্দে দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলে যায়। লুবনা মেয়েটা সহজ–সরল। নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ইফতি প্রেমে পড়ে যায়। ইফতি তো প্রেমে পড়েই ছিলেন। শুধু সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ছয় মাস ধরে চলে প্রেম। লুবনা তার সমস্ত কিছু উজাড় করেই দিয়ে দিলেন ইফতিকে। পরিণতিটা অবশ্য সুখের হয়নি।
সেদিন বিকাল বেলা। এক বান্ধবীর বাসা থেকে হেটে হেটেই রমনা পার্কের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন লুবনা। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো পার্কে একটু ঢু মেরে যাওয়া যাক। পার্কে ঢুকেই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লেন তিনি। উল্টো দিকের বেঞ্চিতে চোখ যেতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। ইফতি মুখ গুঁজে আছেন অন্য একটি মেয়ের বুকে। প্রথমে নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হতে চায়নি। দু’হাতে চোখ দু’টি ভালভাবে ঘষে পুনরায় তাকালেন। না, অবিশ্বাসের কোন হেতু নেই। ছেলেটা ইফতিই। লুবনা মূহুর্তেই সম্বিত হারিয়ে ফেলেন। আবেগটাকে ধরে রাখতে না পেরে কেঁদেই ফেলেন। হঠাৎ সচকিত হয়ে ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না ভেবে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে সরে পড়লেন।
৩.
লুবনার মতো অনেকেই একে একে তাঁর জীবনে এলেন আর কিছু কিছু স্মৃতি রেখে চলে গেলেন। বন্ধুরাও একে একে সরে যান তার একঘুয়েমি আচরণের জন্য। চাহিদা সূচির মতো দাম বাড়লে পণ্যের চাহিদা যেমন কমে, ইফতি রহমানের বয়স আর খ্যাতি বাড়তে বাড়তে কাছের মানুষরাও কমতে থাকে। একাকীত্বে ভুগতে ভুগতে তিনি একরকম এরোগেন্ট হয়ে ওঠেন। ভাষার মাধুর্য হারিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। তিনি নিজের থেকেও আলাদা হতে থাকেন। একসময় অনেকে তার কাছে নানা তদবির নিয়ে যেতেন। তিনি সকলের আবদার রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করতেন। এখন আর কেউ আসে না। অথচ এর মধ্যেই তিনি লেখক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে। সকলের অবহেলা তাঁকে মানসিক যন্ত্রণা দিলেও নিজেকে নিজের অবহেলা তাঁর শরীরটাকেই শেষ করে দিলো। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাসায় একা একা একপ্রকার মৃত্যুশয্যাতেই তিনি প্রতিনিয়ত পড়ে থাকেন। তাঁকে দেখাশুনার জন্য একটি ছেলে ছিলো। টানা পাঁচ মাস বেতন না পেয়ে সেও তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনি এখন বড্ড অসহায়। কেউ কেউ মাঝে মাঝে আসেন। চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়ে আর নানারকম কথাবার্তা বলে চলে যান। ওষুধ কিনবেন কি খাবারটাও তিনি খেতে পারেন না ঠিক মতন। তিনি জীবনের অন্তিম এ সময়ে এসে একজন জীবন সঙ্গিনীর বড্ড অভাববোধ করেন। কিন্তু ওসবের সমস্ত সম্ভাবনা আজ হারিয়ে গিয়েছে।
সকালে ঘুম ভাঙলে ইফতি রহমান হাতরিয়ে হাতরিয়ে বাথরুমে ঢুকেন। হঠাৎ মাথাটা কেমন জানি চক্কর দিয়ে উঠল। কিছু একটা ধরতে যাবেন ঠিক তখনই পা পিছলে পড়ে যান। মাথাটা গিয়ে লাগে পানির কলের সাথে। কলটা ছিলো স্টেইনলেস্ স্টিলের। খোলা ছিলো। মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। কলের জল আর মাথা ফাটা রক্তে পুরো বাথরুম সয়লাব। চিরতরে তিনি আর উঠলেন না।
(সংগৃহীত)