![মনোলজিক রহস্যের উন্মোচন](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/11/13/humaiyon_110773.jpg)
আহমেদ মাওলা, ১৩ নভেম্বর, এবিনিউজ : মিসির আলি বাংলা সাহিত্যের এক অভিনব এবং অবিস্মরণীয় চরিত্র। সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র হলেও মিসির আলি পাঠকনন্দিত, আকর্ষণীয়, সংকট মোচনকারী, রহস্য উন্মোচনকারী একজন দরদি মানুষ হিসেবে পরিচিত। রস–রহস্য–রোমাঞ্চকর অসাধারণ চরিত্র হিসেবে মিসির আলি বাংলা সাহিত্যে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। আধিভৌতিক বা থ্রিলারের রোমাঞ্চকর অপরাধ জগত নয়, প্রকৃতির অদ্ভুত আচরণ, মানবমনের জটিল রহস্যের অন্তর্ভেদ–উন্মোচনই মিসির আলির প্রধান কাজ। হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি চরিত্রের উদ্ভব সম্পর্কে বলেছেনণ্ড ‘যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটায় থাকার সময় গাড়িতে যেতে যেতে একটি লোকসঙ্গীত শোনেন– ডফম্রণ হমলর ণহণ্র টভঢর্ রহর্ ম ্রণণ অর্থাৎ চোখ বন্ধ করে দেখা। আমাদের হাসান রাজার একটি গানে আছে ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপরে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ’ অধিকাংশ মানুষ চোখ খোলা রেখেই অনেক কিছু দেখতে পায় না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখতে বলার মধ্যে একটি ভিন্নতর ব্যাপার নিশ্চয় আছে। চোখ বন্ধ করে দেখার ধারণা থেকেই মিসির আলি চরিত্রের সৃষ্টি। মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। হুমায়ূন আহমেদের কৌশলী কলমে চরিত্রটি ভিন্ন শিল্পমাত্রা পায়। হুমায়ূন আহমেদ এক জায়গায় লিখেছেনণ্ড
মিসির আলি নামের অতি সাধারণ মোড়কে একজন অসাধারণ মানুষ তৈরির চেষ্টা ‘দেবী’তে করা হয়ণ্ড একজন মানুষ যার কাছে প্রকৃতির নিয়ম–শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগত যিনি স্বীকার করেন না। সাধারণ যুক্তিবাদী মানুষেরা আবেগবর্জিত হন। যুক্তি এবং আগেব পাশাপাশি চলতে পারে না। মিসির আলির ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমের চেষ্টা করলাম, যুক্তি আর আবেগকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দিলাম, দেখা যাক কি হয়।’
(মিসির আলি অমনিবাস– ১, ১৯৯৩, ভূমিকা)
মিসির আলীর চোখ বন্ধ করে দেখার মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাপার নেই। আছে বিজ্ঞান ও বুদ্ধির ভিত্তি। কারণ, মিসির আলি এমন একজন মানুষ যার কাছে যুক্তি আর বিজ্ঞানের স্থান সবার ওপরে। মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। ‘দেবী’ রচনার সময় তার লক্ষ ছিল একটি জমাট রহস্যঘন কাহিনি তৈরি। এজন্য একটি আধিভৌতিক পরিবেশ ও সমস্যাকে বেছে নেন তিনি। রহস্যের জট ছাড়ানোর জন্য অ্যাবনরমাল সাইকোলজির খণ্ডকালীন অধ্যাপক ‘মিসির আহেব’কে কাহিনিতে উপস্থিত করেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘দেবী’ উপন্যাসে তাকে ‘মিসির সাহেব’ই বলা হয়, ‘নিশীথিনী’ ‘নিষাদ’ পর্যায়ে তিনি ‘মিসির আলি’ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে মিসির আলি একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে পূর্ণ অবয়ব পান। মিসির আলি চরিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাসগলো হচ্ছেণ্ড ‘দেবী’ (১৯৮৫), নিশীথিনী (১৯৮৭), অন্যভুবন (১৯৮৭), নিষাদ (১৯৮৯), বৃহন্নলা (১৯৮৯), ভয় (১৯৯১), বিপদ (১৯৯২), অনীশ (১৯৯২), মিসির আলির অসীমাংসিত রহস্য (১৯৯৬), তন্দ্রাবিলাস (১৯৯৭), আমিই মিসির আলি (২০০০), বাঘবন্দি মিসির আলি (২০০১), হরতন ইশকাপন (২০০৮), মিসির আলির চশমা (২০০৮), কহেন কবি কালিদাস (২০০৯), মিসির আলি, আপনি কোথায়? (২০০৯), মিসির আলি আনসলভ (২০১০), যখন নামিবে আঁধার (২০১২), ভয় (গল্পগ্রন্থ) (১৯৯১) ইত্যাদি। উপন্যাসগুলোর শিরোনাম দেখেই স্পষ্ট হয়, মিসির আলি চরিত্রের ক্রমবিকাশ এবং বৈচিত্র্য। বিভিন্ন রকম সংকট, সমস্যার মুখোমুখি করে মিসির আলি চরিত্রটি ক্রমপরিণতি এবং সম্পূর্ণতা দান করা হয়েছে। যদিও হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,ণ্ড ‘আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার চারপাশে মিসির আলির মতো মানুষ খুব বেশি দেখি না। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমার নিজেকেই মিসির আলি মনে হয়।… আমি আসলে অর্ধেক হিমু, অর্ধেক মিসির আলি। হা–হা…’
(বসন্ত বিলাপ, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩, পৃ. ১৩৬)
যেসব সমস্যা নিয়ে মিসির আলি কাজ করেন, তা মূলত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। এ জটিলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আধিভৌতিক পরিবেশে গড়ে উঠে মিসির আলি মনোজগতের আলো–আঁধারি পথে জ্ঞান ও তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ দক্ষতা দিয়ে অন্ধকার কাটিয়ে আলোতে পৌঁছে যান। প্রখর বুদ্ধির অধিকারী মিসির আলিকে তাই এই কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজের বিচ্ছুরিত আলোর দূত বলা যায়। মিসির আলির ভাবনাতে একজায়গায় পাওয়া যায়।
‘সব কিছুর পেছনেই কারণ থাকে। এই জগতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না, সবই লজিক। জটিল লজিক। জটিল কিন্তু অভ্রান্ত লজিকের বাইরে এক চুলও কারো যাবার ক্ষমতা নেই।’
থ্রিলার কিংবা রহস্য উপন্যাসে ভয়ঙ্কর সব অপরাধের রোমহর্ষক বর্ণনা থাকে অথবা আধিভৌতিক কাহিনিতে যে রকম গা ছমছম করা রোমাঞ্চকর ঘটনা থাকে, মিসির আলি সিরিজের উপন্যাসগুলো তার থেকে ভিন্ন। ভিন্নতার দিকটা হচ্ছে, ওইগুলোতে রোমাঞ্চ তৈরির জন্য রোমাঞ্চকর ঘটনা সাজানো হয়। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে রোমাঞ্চকর ঘটনার কোনো যৌক্তিক কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মিসির আলির প্রত্যেকটি উপন্যাসই স্বতন্ত্র। মিসির আলি অপরাধ দমন কিংবা ভৌতিক রহস্য, কুরসংস্কার মোচনের ওঝা নন। প্রকৃতির রহস্যময়তা উন্মোচন, মনস্তাত্ত্বিক জটিল সমস্যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে উদ্ধাকারী ত্রাতার ভূমিকা পালন করেন মিসির আলি। তার কর্মকাণ্ডে যুক্তি আর আবেগ হাত ধরাধরি করে চলে। এই অর্থে মিসির আলি থ্রিলার চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, ব্যাতিক্রমী একটি অভিনব চরিত্র।
সাধারণত যুক্তিবাদী মানুষেরা আবেগবর্জিত হন। কারণ, যুক্তি আর আবেগ পাশাপাশি চলতে পারে না। কিন্তু মিসির আলি চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলেছেন,
‘যুক্তি আর আবেগকে হাত ধরাধরি করে, হাঁটতে দিলাম, দেখা যাক কি হয়।’
মিসির আলি ব্যক্তির সংকট মোচনে নিরলস, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন, কোনো প্রাপ্তির আশায় নয়, সম্পূর্ণ স্বার্থহীনভাবেই কাজ করেন। প্রয়োজনে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেও নির্দিষ্ট স্থানে গমন করে খোঁজখবর নেন, জায়গা পরিদর্শন করেন, ডায়রি, পুরানো নথি, পত্রিকার নিউজ খোঁজেন, অদম্য কৌতূহল থেকেই তিনি এসব করেন। তীক্ষ পর্যবেক্ষণ, যুক্তির শৃঙ্খলা পথে অগ্রসর হলেও তার মধ্যে একটা দরদি প্রযত্ন আছে। মিসির আলি চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য থেকে বলা যায়, ‘আবেগ আর যুক্তি’ তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে।
মিসির আলির চেহারার কোনো বর্ণনা হুমায়ূন আহমেদ কোথাও দেননি। পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রটিকে এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন যে, পাঠক নিজেই কল্পনা করে মিসির আলির একটা অবয়ব দাঁড় করিয়ে নিতে পারে। শুধু ‘নিশীথিনী’ উপন্যাসে নীলুর বাবা বর্ণনা করেছেন, ‘রোগা কালো এবং কিঞ্চিৎ কুঁজো একজন মাঝবয়সী মানুষ হিসেবে। টেলিভিশন নাটকে মিসির আলির ভূমিকায় আবুল হায়াত অভিনয় করতে গিয়ে দাড়িগোফ লাগানোর ফলে তাঁকে সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শংকুর মতো লাগছিল। অধুনা লুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলো নিয়ে একটা কাভার স্টোরি ছাপা হয়। প্রচ্ছদে শিল্পী রণবী অন্য চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিসির আলিরও একটি কাল্পনিক ছবি এঁকেছিলেন। না, মিসির আলি জেমস্ বন্ড, শার্লক হোমস্, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শংকু বা ফেলুদার মতো নয়। হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলিকে দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাবনরমাল সাইকোলজির একজন খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে। বয়স ৫০ থেকে ৬০–এর মধ্যে। উজ্জ্বল চোখ, দুর্বল স্বাস্থ্য কিন্তু খুবই মেধাবী। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে প্রায় রোগ–ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। থাকেন নিঃসঙ্গ এবং নিজেই রান্না করেন বা কাজের মেয়ে রান্না করে দেয়। ব্যক্তি জীবনে মিসির আলি নিঃসঙ্গ, আত্মভোলা হলেও সমস্যা কবলিত ব্যক্তিকে সাহায্য করতে জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছপা হন না। কারণ, মিসির আলি মনে করেন, প্রকৃতি কোনো রহস্য পছন্দ করে না, বুদ্ধির প্রয়োগে সব রহস্যের উন্মোচন সম্ভব। সমস্ত রহস্যের জাল ছিন্ন করে সত্যের সন্ধান করেন। তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ এবং আকাট্য যুক্তি দিয়ে প্রকৃতির রহস্য ভেদ করেন। মনোজগতের আলো–আঁধারি পথে নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী, সত্যসন্ধ, আলোর দূত এবং এবং ত্রাতা মিসির আলি সত্যি বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় চরিত্র।
‘দেবী’ উপন্যাসে মিসির আলিকে দেখানো হয়েছে ‘ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টিচার’ হিসেবে। মূল কাহিনিতে আনিসের স্ত্রী রানু হঠাৎ একরাতে ভয় পেয়ে জেগে ওঠে। সে রাতে ঝড়–বৃষ্টি, ছাদে বানরের উৎপাত ভেবে রানুকে শান্ত করে। দ্বিতীয় রাতে আনিস দেখে রানু বিছনায় নেই। এঘর ওঘর খুঁজে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে রানু ছোট্ট টেবিলে বসে আছে। বাতি জ্বালিয়ে আনিস আবার বাতি নিভিয়ে দেয়। কারণ, রানুর গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। কাপড় পরতে বললে রানু প্রচণ্ড গরমের কথা বলে। অথচ জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তারপর আবার কাপড় পরতে বললে রানু বাধ্য মেয়ের মতো কাপড় পরে ঘুমোতে যায়। রানুর এই সমস্যার জন্য অফিসের কমলেন্দু বাবুর পরামর্শে আনিস মিসির সাহেবের বাসা কাঁঠাল বাগানে যায়। কমলেন্দু বাবুর বোনের চিকিৎসা তিনি করেছিলেন। আনিসের সব কথা শুনে মিসির সাহেব রানুকে নিয়ে আসতে বলেন।
‘আনিস উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষীণস্বরে বললেন, আপনাকে কত দেব?
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, কমলেন্দু বাবু কি আপনাকে বলেননি আমি ফিস নিই না। এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি বুঝতে পারছেন? (‘দেবী’ পৃ. ২০)
আনিসের স্ত্রী রানুর ভয় পাওয়ার রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে মিসির সাহেব কাহিনিতে জড়িয়ে পড়েন। রানুর অসুস্থতার কারণ বিশ্লেষণের জন্য মিসির সাহেব একটা খাতায় প্রথম পাতায় লেখেখণ্ড ‘একজন মানসিক রুগীর পর্যায়ক্রমিক মনোবিশ্লেষণ’। সেখানে নানা তথ্য থাকে। তৃতীয় পাতার হেডিং হচ্ছে। ‘অডিটরি হেলুসিনেশন’। তারপর রানুর কাছ থেকে পাওয়া ভয়ের ঘটনার বিবরণ। মধুপুরে চাচাতো বোন অনুফার বিয়েতে গায়েহলুদের দিন রং কাদা খেলার পর নদীতে গোসল করতে গেলে একটা মরা মানুষের লাশ রানুর পা জড়িয়ে ধরে তার পাজামা খুলে ফেলতে চায়। তারপর সে বেহুঁশ হয়ে যায়। অনুফা তাকে টেনে ওপরে তোলে এবং তখনো মারা লাশটা রানুর পা জড়িয়েছিল। পরে লাশটাকে নদীর তীরে পুঁতে ফেলা হয়। রানুর মুখে শোনা গল্পে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে, যেমনণ্ড
* একজন মৃত মানুষ পানিতে ভেসে থাকবে। ডুবে থাকবে না। গল্পে মৃত মানুষটি ডুবে ডুবে চলার কথা আছে। এরকম থাকার কথা নয়।
* পাজামা খুলে ফেলার কথা আছে। কিশোরীরা সাধারণত শক্ত গিঁট দিয়ে পাজামা পরে। গিঁট খুলতে হলে ফিতা টানতে হবে। ঐ মানুষটি ফিতা টেনেছিল, না পাজামাটাই টেনে নামিয়েছে?
* মৃত লোকটির কি কোনো পোস্টমোটেম করা হয়েছিল?
* প্রথম অসুস্থতার সময় কি মেয়েটি ঘুমের মধ্যে কথাবার্তা বলত?
* মেয়েটি বলল, লোকটির নাম জালালউদ্দীন। কীভাবে বলল? লোকটির নাম তো জানার কথা নয়। নাকি পরে শুনেছে?
* জালালউদ্দীন জাতীয় নামের কারো সঙ্গে কি এই মেয়েটির পূর্বপরিচয় ছিল?
মিসির আলি এভাবে প্রশ্ন ও এর জবাব খোঁজার মধ্যে দিযে যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে যেকোনো জটিল সমস্যার সমাধানের পথে এগিয়ে যান। মিসির আলির এ পদ্ধতিটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। ‘দেবী’ উপন্যাসেও দেখা যায়, প্রশ্নের পাশে কিছু মন্তব্য লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা থাকে, যেমনণ্ড ‘মেয়েটির অবশ্যই কিছু পরিমাণ এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশন আছে। সে সবকটি কার্ডের সঠিক চিহ্ন বলতে পেরেছে। মানসিকভাবে অসুস্থ রুগীদের এই দিকটি উন্নত হয়ে থাকে।’ (পৃ. ৪১)
মিসির আলি ইউনিভার্সিটিতেও চারাটির ‘এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশন’ পরীক্ষা করেন। সেটা হচ্ছে, কোনো ঘটনা ঘটার আগেই তা বলতে পারার মস্তিষ্কের অনুমাননির্ভর একটা মানসিক দক্ষতা। ‘দেবী’ উপন্যাসেও রানু মেয়েটি সে রকম কিছু মানসিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। রানু কোনো বিপদ বা অমঙ্গলের কথা আগে থেকে বলতে পারে। ‘ দেবী’ উপন্যাসের কাহিনির এক পর্যায়ে রানু তার বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে ঘটা একটা ঘটনার কথা বলে। তাদের বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসের ছয় তারিখ, চৌদ্দ তারিখ আনিস তার মামাসহ বিলে মাছ ধরতে গেলে দুপুরের দিকে হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলণ্ড
‘কাঠের দোতলা। আমি একা একা কাঠের দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলার কোণার দিকে একটা ঘর স্টোর রুমের মতো। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ একটি মেয়ের কথা শুনলাম। মেয়েটি খুব নিচুস্বরে বললণ্ড ‘সোনপোতা বিলে ওদের নৌকা ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই ডুবেছে।’ এর কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে? আছে। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাজেই তোমার মনে ছিল অমঙ্গলের আশঙ্কা। অবচেতন মনে ছিল নৌকাডুবির কথা। অবচেতন মনই কথা বলেছে তোমার সঙ্গে।’ (পৃ. ৭১)
রানুর মানসিক রোগের সৃষ্টি হয় এভাবে এবং সে ‘অডিটরি হেলসিনেশন’ রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মিসির আলি রানু সম্পর্কে খোঁজ–খবর নেয়ার জন্য রানুর গ্রামের বাড়িতে যায়। সোহাগী স্কুলের হেডমাস্টার প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে অনুফার স্বামীর বাড়িতে পৌছার ব্যবস্থা করে দেয়। মিসির আলি অনুফার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে মরা লাশটি রানুর পা জড়িয়ে থাকলেও তার পাজামা পরনেই ছিল। সুতরাং পাজামা খোলার ব্যাপারটি সঠিক নয়। মিসির আলি স্থানীয় থানায় গিয়েও পুরানো নথিপত্র দেখে। এর মধ্যে আলসারের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। একটু সুস্থ হয়ে মিসির আলি দ্বিতীয়বারের মতো রানুর গ্রামের বাড়িতে যায় এবং তিনশ বছরের পুরোনো বিষ্ণু মন্দিরে গিয়ে রুকমিনী দেবী মূর্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর একটা বাচ্চা মেয়েকে বলি দেয়া হয়। সে মেয়ে নাকি অমাবস্যা রাতে ঘুরে বেড়ায়। শ্বেত পাথরের মূর্তিটা হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। রানু নয়–দশ বছর বয়সে প্রায়ই ওই মন্দিরে মূর্তিটা দেখতে যেত। একটা হাত ভাঙা মূর্তিটা দেখতে খুব সুন্দর ছিল। একদিন মূর্তি দেখতে গেলে একটা ঘটনা ঘটে।
এ মন্দিরে খুব সুন্দর একটি দেবীমূর্তি আছে। আমি ঐ মূর্তি দেখার জন্য যেতাম।
‘তারপর কি হয়েছে, বলো।’
রানু তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তীব্র স্বরে বলল, ‘আমি বলব না, আপনি বলুন।’
মিসির আলি শান্তস্বরে বললেন, ‘ঐ লোকটি তখন টেনে তোমার পাজামা খুলে ফেললো।’
রানুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো।
‘ঐ লোকটির নাম ছিল জালালউদ্দীন।’
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, ‘তোমার অসুখ শুরু হলো সেদিন থেকে। তোমার মনের মধ্যে ব্যাপারটি গেঁথে গেল। পরবর্তীতে গোসলের সময় যখন মরা মানুষটি তোমার পায়ে লেগে গেল, তখন তোমার মনে পড়ল মন্দিরের দৃশ্য। বুঝতে পারছ?’
‘তোমার অসুখের মূল কারণটি আলোয় নিয়ে এলে অসুখ সেরে যাবে।’
রানু মৃদু স্বরে বলল ‘আপনি কি ঐ লোকটির সঙ্গে কথা বলেছেন? ‘বলেছি।।’
‘সে বলেছে, হঠাৎ সে দেখে মূর্তিটি ছুটে এসে তোমার মধ্যে মিলিয়ে গেছে, তোমার গা থেকে আগুন বেরুচ্ছে। জালালউদ্দীন তখন ছুটে পালিয়ে যায়।’ (পৃ : ৫৫)
রানুর ধারণা, তারপর সে মূর্তির মতো সুন্দর হয়ে যায়। ‘দেবী’ উপন্যাসের কাহিনির শেষ পর্যায়ে দেখা বাড়িওয়ালার মেয়ে নীলু একটা খারাপ লোকের খপ্পরে পড়ে। তাকে হত্যা করার জন্য লোকটি ক্ষুর নিয়ে এগিয়ে যায়। রানু ব্যাপারটা জানতে পারে। আনিস দেরি করে অফিস থেকে ফিরলেও বাসায় ফিরে দেখে রানুর অবস্থা খুবই খারাপ। রহমান সাহেবের স্ত্রীকে ডেকে রানুর কাছে বসতে বলে আনিস দ্রুত ডাক্তার আনতে যায়। রানু অস্থির হয়ে বলতে থাকে ‘নীলুকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে।’ রানুর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার আসার আগেই রানু মারা গেল। ওদিকে নীলু দেখে, একটা অল্প বয়সী মেয়ে খারাপ লোকটির দিকে এগিয়ে আসছে। তার পায়ে নূপুরের শব্দ, লোকটি দেয়ালের দিকে সরে যাচ্ছে। মিসির আলি ক্লাসে ঢুকে দেখে রানুর মতো একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি মৃদুস্বরে বলল, ‘আমার নাম নীলু।’
‘দেবী’ উপন্যাসে মিসির আলি রানুর মানসিক জটিল সমস্যার রহস্য উন্মোচিত করলেও শেষ পর্যন্ত রানু মেয়েটি মারা যায়। যদিও রানুর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নীলু খারাপ লোকটির হাত থেকে রক্ষা পায়। রানুর আত্মাই নীলুকে বাঁচাতে যায় কারণ ‘এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশনের’ মাধ্যমে রানুই নীলুর বিপদের কথা জানতে পেরেছিল। রানু শৈশবে মন্দিরে জালালউদ্দীনের খপ্পরে পড়েছিল, রানুকে তখন রক্ষা করেছিল দেবীমূর্তি। মিসির আলি রানুর মানসিক রোগ ‘অডিটরি হেলুমিনেশন’–এর ব্যাপারটি শুধু চিহ্নিত করেন তা নয়; তার কারণ ও গোপন রহস্যও ভেদ করেছেন। এখানেই মিসির আলি চরিত্রের অসাধারণত্ব।
‘মিসির আলির চশমা’ (২০০৮) নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস। গুরুত্বের দিকগুলো হচ্ছে, এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘চিঠিকন্যা শায়লা’ চিঠির ভেরে ভুল তথ্য দিয়ে মিসির আলিকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে, যা মিসির আলির জন্য ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। না, ভুল তথ্য দিয়ে মিসির আলির মতো যুক্তিবাদী মেধাবী মানুষকে আসলে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ উপন্যাসে লেখক অর্থাৎ হুমায়ূন আহমেদ নিজের কিছু সমস্যা নিয়ে মিসির আলির শরণাপন্ন হন এবং মিসির আলি খুব সহজে তা সমাধান করেন। শুধু তা–ই নয়, লেখকের সঙ্গে মিসির আলি কিছুদিন একত্রে একই ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। মিসির আলির রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকে দেখেছেন, কাজটা তিনি কীভাবে করেন। লজিকের সিঁড়ি কীভাবে পাতেন। হুমায়ূন আহমেদ স্বয়ং মিসির আলির রহস্যভেদ করার পদ্ধতিটা পর্যবেক্ষণ করেছেন, বিষয়টি সত্যি গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগত জীবনের এক সংকটময় মুহূর্তে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাটে একা থাকতে হয়। উপন্যাসের ভাষায়।
‘বাধ্য হয়ে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। তিনতলায় একা থাকি। দিনের বেলায় অফিসের একটা পিয়ন থাকে। হোটেল থেকে খাবার এনে দিয়ে সন্ধ্যায় নিজের বাসায় চলে যায়। এত বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে ভয় পাই।
ভয় পাবার কারণ হচ্ছে, আমি মোটামুটি নিশ্চিত ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি না। আমার সঙ্গে বিদেহী কোনো আত্মাও থাকেন। তিনি গভীর রাতে কাঠের মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করেন।… এক রাতের ঘটনা তো ভয়ঙ্কর। রাত তিনটা বাজে। বাথরুমে যাবার জন্য বিছানা ছেড়ে নেমেছি, হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে বেঁটে মতো এক ছায়ামূর্তি। আমি বিকট চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না। চিৎকার দিয়ে লাভ নেই। যে বিদেহী আত্মা আমার সঙ্গে বাস করেন, তিনি ছাড়া আমার চিৎকার কেউ শুনবে না। (প: ২৬)
হুমায়ূন আহমেদের এই মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় মিসির আলির বাসা খুঁজে খুঁজে গিয়ে উপস্থিত হলেন। শুধু যে বাসায় উপস্থিত হলেন তা নয়, মিসির আলি তাঁর মাথায় হাত রাখলেন। প্রিয়জনদের নিষ্ঠুরতায় অভিমানী বালকের মত হুমায়ূন আহমেদকে সান্ত্বনা দিলেন। নিঃসঙ্গ মানুষকে সঙ্গ দেয়ার উদ্দেশ্যে কয়েক দিন থাকার জন্য ব্যাগে কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছেন। মিসির আলি বললেন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
‘আমি বললাম, আপাতত আপনি আমাকে ভূতের হাত থেকে বাঁচান। একটা ভূত আমাকে রাতে ঘুমোতে দিচ্ছেনা। কাঠের ফ্লোরে সে রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমি নিজে ভূতটাকে দেখেছি।
মিসির আলি বললেন, কাঠ দিনের গরমে প্রসারিত হয়। রাতের ঠাণ্ডায় সংকুচিত হয়। তখনই নানান শব্দ হয়।
আমি বললাম, কাঠের এই ব্যাপারটা মানলাম। কিন্তু রান্নাঘরে ভূতটা পানির কল ছাড়ে। ছড়ছড় করে পানির শব্দ আমি রোজ রাতেই দুই–তিনবার পাই। মিসির শান্ত গলায় বললেন, রাতে চারদিক থাকে নীরব। আপনার নিচের তলা বা উপরের তলার লোকজন যখন কল ছাড়ে তখন সেই শব্দ ভেসে আসে। এর বেশি কিছু নয়।
সরাসরি যে ভূত দেখিছি সেটা কী?
মিসির আলি বললেন, আপনি নিজের ছায়া দেয়ালে দেখেছেন। ঐ রাতে নিশ্চয়ই আপনার কগ খোলা ছিল। কগ স্ক্রিন থেকে আসা আলোয় আপনার ছায়া পড়েছে। টিভি ছাড়ুন। আমি টিভি ছাড়তেই দেয়ালে নিজের ছায়া দেখলাম।
মিসির আলি বললেন, ভয়, কেটেছে?
আমি হ্যাঁ–সূচক মাথা নাড়লাম।’ (পৃ : ২৭)
মিসির আলির রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থেকে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই যেন অভিভূত হয়ে গেলেন।
‘মিসির আলির চশমা’ উপন্যাসের মূল রহস্য চক্ষু বিশেষজ্ঞা ডাক্তার হারুন রশীদের স্ত্রী শায়লা, তার একাধিক বিয়ে, শাশুড়ি কর্তৃক তার সন্তান হত্যার কল্পকথা বলে সন্তানকে লুকিয়ে রাখা এবং আমেরিকায় দ্বিতীয় স্বামী জালাল আহমেদকে কফিতে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে হত্যা ইত্যাদি রহস্যঘন জটিল ঘটনাবর্ত রয়েছে। মিসির আলি উত্তরায় বাসায় থাকতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদেকেও ‘চিঠিকন্যা’ শায়লার সমস্যা সমাধানে সরাসরি যুক্ত করেন। উপন্যাসে ‘চিঠিকন্যা’ বলে উল্লেখ করা হলেও শায়লা মূলত রসায়নের অধ্যাপক। শায়লা মিসির আলিকে ‘বাবা’ সম্বোধন করে জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য একটা চিঠি লেখে। সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে তার শাশুড়ি। ডাক্তার হারুন রশীদকে তার মা ছায়ার মতো অনুসরণ করতো। বিয়ের পরও হারুন–শায়লার ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু ছিল না। হারুনের অতিরিক্ত মাতৃভক্তিতে অতিষ্ঠ শায়লা শেষ পর্যন্ত তাদের ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে আলাদা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকবে। এপ্রিলের এক তারিখ এপ্রিল ফুল হবে বলে দুই তারিখে ফ্ল্যাটে ওঠার কথা ছিল কিন্তু এপ্রিলের এক তারিখ তাদের ছেলেটা মারা যায়। বাসার কাজের মেয়েকে সেদিন জগ ভাঙার অপরাধে বিদায় দেয়া হয়। দারোয়ানকে পাঠানো হয় নারায়ণগঞ্জে। শায়লা ছিল কলেজে। খবর শুনে শায়লা এসে দেখে মৃত সন্তান কোলে নিয়ে শাশুড়ি বসে আছে। কীভাবে মারা গেল জিজ্ঞেস করলে শাশুড়ি জবাব দেন। ‘আমি কিছু বলব না, তোমরা ফ্ল্যাট বাড়িতে চলে যাও। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না।’ শায়লার শাশুড়ি এখন মৃত। কিন্তু মরে যাওয়ার পরও শাশুড়ির আত্মা হারুনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। হারুনের প্রায় তার মায়ের আত্মার কথাবার্তা হয়। মায়ের আত্মার নির্দেশেই হারুন চলে। হারুনের ধারণা, শায়লা তাকে খাওয়ায় বিষ মিশিয়ে খুন করবে। তার মা অদৃশ্য থেকে হারুনকে প্রায় সাবধান করেন। স্ত্রী–স্বামী আলাদা খাটে শোয়। মায়ের আদেশে হারুন স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করে না। তাই তাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। চিঠি পড়ে মিসির আলি কয়েকটি বিষয়ে তদন্ত শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদকে ঐ সালে এপ্রিলের এক তারিখ কবরস্থ শিশুদের তালিকা দেখে ‘সাগর’ নামের কোনো ছেলের দাফন করা হয়েছে কি–না, তা দেখার জন্য। এছাড়া জালাল আহমেদ নামের কোনো চোখের ডাক্তার কর্ণিয়া রিপ্লেসমেন্টের বিশেষজ্ঞ আছে কি–না, তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। হুমায়ূন আহমেদ দু’টো বিষয়ে খুঁজে বের করেন। না, এপ্রিলের এক তারিখ ঐ নামের কোনো শিশুকে কবরস্থ করা হয়নি এবং জালাল আহমেদ নামের রাজপুত্রের মতো দেখতে, তার ছবিও উদ্ধার করতে সমর্থ হন। এদিকে মিসির আলি নিজেও অনেক খোঁজ–খবর করে তথ্য সংগ্রহ করেন। সব রহস্য উন্মোচনের পূর্বেই মিসির আলি হুমায়ূন আহমেদকে এর ফলাফল লিখে ইনভেলাপের মুখ বন্ধ করে রেখে দেয়ার জন্য বলেন। রহস্যভেদের পূর্বে যেন খামের মুখ খোলা না হয়। তা বলে দিয়েছেন।
কাহিনির ধারাবাহিকতায় শায়লা দ্বিতীয়বার চিঠি লিখে মিসির আলির কাছে ক্ষমা চায় বিভ্রান্তকর তথ্য দেয়ার জন্য। কাহিনির শেষে দেখা যায়, মিসির আলি শায়লাকে ডিনারে দাওয়াত দেন হুমায়ূন আহমেদের সেই উত্তরার বাসায়। সেখানে যথারীতি রাতে শায়লা উপস্থিত হয়।
‘শায়লা অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করতে করতে বললেন, ভুলভাল চিঠি লিখে আনপাকে বিরক্ত করেছি। বাবা, আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?
…… মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি তোমার হ্যান্ডব্যাগে সব সময় পটাশিয়াম সায়ানাইড রাখো?
শায়লা মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল।
……. মিসির আলি বললেন, শায়লা তুমি বিয়ের পর গ. ঝ. করতে আমেরিকায় যাও, ঠিক না?
শায়লা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।
সাগর নামের ছেলেটি তোমার অবৈধ সন্তান?
না। আমি হারুনকে নিয়মমাফিক তালাক দিয়ে জালালকে বিয়ে করি।… জালালের ধারণা হয় আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। যে কোনো সময় আমি তাকে খুন করতে পারি। এইসব হাবিজাবি। ডাক্তার হারুনের যে সমস্যা আছে সেই সমস্যা?
হ্যাঁ।
আমাদের যে বাচ্চা হয়ণ্ড সাগর, সেই বাচ্চাটাকে জালাল সরিয়ে ফেলেছিল। তার ধারণা হয়েছিল বাচ্চাটাকেও আমি মেরে ফেলব। … জালাল যে নিউইয়র্কের এক সাবওয়েতে কফি খেতে খেতে মারা গিয়েছিল এই খবর কি আপনি জোগাড় করেছেন?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।
সে হার্ট অ্যাটকে মারা যায়নি। কফিতে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে খেয়েছিল। সে সুইসাইড করেছিল।
……তার মৃত্যুর পর আমি দেশে ফিরে আসি। বাস করতে থাকি হারুনের সঙ্গে। আমার শাশুড়ির ধারণা, জালালকে খুন করে আমি এসেছি হারুনকে খুন করতে।
তোমার ছেলে সাগর কোথায় আছে? (পৃ : ৬৩)
পরিসমাপ্তিতে দেখা যায়, রাতের খাবারের টেবিলে হারুন ওই ছেলে সাগরকে সঙ্গে নিয়ে একগোছা দোলনচাঁপা হাতে আসে। মিসির আলি তখন হুমায়ূন আহমেদের কাছে রাখা রহস্য ফলাফলের বদ্ধ খামটি খুলতে বলেন, সেখানে লেখা আছেণ্ড ‘আণ্ডমারপণ্ডএক–ন্যা’ অর্থাৎ ‘আমার পত্রকন্যা’। হুমায়ূন আহমেদ এভাবে নিজে যুক্ত থেকে মিসির আলির রহস্য উন্মোচন প্রক্রিয়াকে খুব কাছ থেকে প্রত্যে করেন। এভাবেই মিসির আলির হয়ে ওঠেন রক্তমাংসের একজন মানুষণ্ড বিপদে যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়।
মিসির আলি চরিত্রকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ কিছু ভুলভ্রান্তিও করেছেন। যেমন ‘অন্যভুবনে’ মিসির আলিকে দেখানো হয়েছে বিবাহিত হিসেবে। এই চরিত্রটি আসলে বিবাহিত পুরুষ মানুষ হিসেবেই মানায়ণ্ড যিনি বুকে সমুদ্রের ভালোবাসা লালন করবেন কিন্তু ভালোবাসার বন্ধনে নিজেকে কখনো জড়াবেন না। এসব ছোটখাট ভুলত্রুটি সত্ত্বেও মিসির আলি চরিত্রটি নিঃসঙ্গ, কিন্তু খুবই হৃদয়বান, তীক্ষ ধর্মী শক্তির অধিকারী মানুষ, অসাধারণ যুক্তি ও বুদ্ধিসম্পন্ন একটি আলোকদীপ্ত চরিত্র হিসেবে অমর হয়ে থাকবে।
(সংগৃহীত)