বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

শকুন্তলার জয়

শকুন্তলার জয়

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০ নভেম্বর, এবিনিউজ : শকুন্তলার জয় হয়েছে। অবশেষে। ‘মহাভারত’–এর নয়, কালিদাসের (খ্রি. ৫০০)। শকুন্তলার কাহিনী ‘মহাভারতে’ও আছে, হয়তো সেখান থেকেই মূল কাঠামো সংগ্রহ করেছেন কালিদাস, কিন্তু ব্যাস–বর্ণিত কাহিনী রাজা দুষ্মন্তেরই গল্প আসলে, শকুন্তলার নয়। ‘মহাভারতে’র উপাখ্যানে পরিত্যক্ত শকুন্তলা স্বামীর দরবারের গৃহীত হয় বটে, কিন্তু সে গ্রহণে শকুন্তলার জয় নেই, পুত্রসন্তানের জননী হিসেবে একজন নারীর স্বীকৃতি রয়েছে মাত্র। কালিদাস তাঁর নাটকে দুষ্মন্তকে বদলে দিয়েছেন, শকুন্তলাকেও। সেই সঙ্গে বদলে গেছে তাদের সম্পর্কও। কালিদাসের নাটকে শকুন্তলাই প্রধান, দুষ্মন্ত নন। দুষ্মন্ত আছেন, কিন্তু তাঁর প্রবল দৈহিক শক্তি, সমগ্র বিশ্বজুড়ে আধিপত্য, বিপুল সম্পত্তি ইত্যাদি সত্ত্বেও তিনি প্রথম নন, তিনি দ্বিতীয়। কাহিনী শকুন্তলারই।

এখানেও, কালিদাসের নাটকেও প্রত্যাখ্যান রয়েছে। রাজসভাতে বসে বনের লতা শকুন্তলাকে দুষ্মন্ত চিনতে পারেন নি, বিদায় করে দিয়েছেন। কিন্তু স্বামী ফেরত শকুন্তলা শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন। তাঁকে ফেরত পাবার জন্য কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে, দগ্ধ হতে হয়েছে মনস্তাপে। বিদায়ের মুহূর্তে শকুন্তলার করুণ চাহনি স্মরণ করে দুষ্মন্ত অস্থির হয়েছেন অনুশোচনায়। অবশেষে, বেশ কয়েক বছর পর শকুন্তলার যখন দেখা পেলেন দুর্গম এক তপোবনে তখন শোকে ও আনন্দে আত্মনিয়ন্ত্রণহীন রাজা একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন ভূতলে, শকুন্তলার পায়ের কাছে। অতবড়ো বীর তিনি, দেবরাজ ইন্দ্র যা পারেন নি, তা–ই করেছেন, দেবতাদের পক্ষে যুদ্ধ করে অসুরদের হারিয়ে দিয়ে এসেছেন সদ্য সদ্য; এর আগে তিনি কণ্বের তপোবনে উৎপাতকারী রা সদেরকে বিতাড়িত করেছিলেন; সেই রাক্ষস–দমনকারী ও অসুর–বিজয়ী বীর জীর্ণবসনা শীর্ণকায়া শকুন্তলার কাছে এখন ক্ষমাপ্রার্থী। মিলন ঘটেছে স্বামী–স্ত্রীর, জয় হয়েছে শকুন্তলার। কালিদাস তাঁর নায়িকাকে পরাভূতা হিসেবে দেখতে চান নি। সংস্কৃত সাহিত্যে বিয়োগান্ত পরিণতি অবশ্য প্রথাবিরুদ্ধ, কিন্তু প্রথার অনুরোধে নয়, শকুন্তলাকে তিনি বড়ো মনে করেন বলেই তাঁকে জয়ী করলেন।

বড় করেছেন তিনি দুষ্মন্তকেও। এবং তাতে শকুন্তলা আরও উঁচু হয়েছেন। ‘মহাভারতে’র দুষ্মন্তও অনেক বড়ো। বিশ্ব তখন বেশ ছোটোই ছিল, এবং দুষ্মন্ত ছিলেন সমগ্র বিশ্বের অধিপতি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ‘মহাভারতে’র দুষ্মন্ত অতিশয় সাধারণ। তিনি কামতাড়িত। স্বেচ্ছাচারী। মৃগয়াতে গিয়ে ঋষি কণ্বের তপোবনে শকুন্তলাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন, দেখেই ঠিক করে ফেলেছেন। একে তাঁর চাই, এই হরিণীটিকেও তিনি শিকার করবেন। তা–ই করলেন। মৃগয়া শেষে ফিরে এলেন রাজধানী হস্তিনাপুরে। হ্যাঁ, কথা দিয়েছিলেন লোক পাঠাবেন শকুন্তলাকে নিয়ে যেতে, নিয়ে গিয়ে পাটরানি করবেন, শকুন্তলার পুত্রই উত্তরাধিকারী হবে রাজসিংহাসনের। রাজধানীতে ফিরে তিনি ভান করলেন সবকিছু ভুলে যাবার। তিন বছর বয়সের শিশুপুত্রের হাত ধরে শকুন্তলা কথা কিছু কম বললেন না, অল্পসময়ের মধ্যে। যুক্তি দিলেন যে, তিনি কেবল পত্নী নন, মাতাও। প্রাচীন কবিরা বলেন যে, স্বামী স্বয়ং গর্ভরূপে স্ত্রীতে প্রবেশ করেন এবং পুনর্বার পুত্ররূপে জন্ম দেন। পণ্ডিতদের নির্দেশ আছে, পুত্রের জননী যে–স্ত্রী তাকে মাতার ন্যায় জ্ঞান করবে। এসব কথা বললেন। কিন্তু কোনো কথাতেই কাজ হলো না। যে ব্যক্তি চিনেছে বলেই চিনছে না, তাকে চেনানো যাবে কী করে?

যায় না? দুষ্মন্ত চেনেন না। উল্টো কটু কথা শুনিয়ে দেন শকুন্তলাকে। বলেন, তোমার মা হলেন গিয়ে ব্যভিচারিণী এক অল্পরা, যে তোমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে; তোমার বাবা নিষ্ঠুরস্বভাবের বিশ্বামিত্র, তুমি আবার ভালো হবে কী করে? প্রতারণা করতে এসেছ? কিন্তু সুবিধা হবে না, তোমার সব কথা মিথ্যা, যাও, চলে যাও, তুমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পার। সেই সময়ে হঠাৎ দৈববাণী শোনা গেল, আকাশ থেকে। রাজসভার সবাই শুনল একটি নির্দেশ। ‘দুষ্মন্ত, শকুন্তলাকে তুমি গ্রহণ করো। সে তোমার পুত্রের জননী, তোমাকে ওই পুত্রের ভরণপোষণ করতে হবে, এবং সে কারণে এর নাম হবে ভরত।’ এবার রাজা দুষ্মন্ত স্বীকার করলেন যে শকুন্তলা তার স্ত্রী। সভাসদদেরকে বললেন তিনি, ‘শুনলেন তো, এটি আমার পুত্র। দৈববাণী না শুনলে আপনারা নানা রকম কথা বলতেন; সেজন্যই তো আমি সত্য স্বীকার করতে সাহস পাইনি।’ তখন সকলে মিলে রাজার খুব প্রশংসা করল।

কালিদাসের দুষ্মন্ত কিন্তু ‘মহাভারতে’র দুষ্মন্ত নন, একেবারেই ভিন্ন মানুষ। এই দুষ্মন্তও শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বটে; তবে স্বেচ্ছায় নয়, করেছেন ঋষি দুর্বাসার অভিশাপের কারণে। অভিশাপের এই ঘটনা কালিদাসের উদ্ভাবন ও সংযোজন। ‘মহাভারত’–এ এটি নেই। কালিদাসের কাহিনীতে দুর্বাসা অভিশাপ দুষ্মন্তকে দেননি, দিয়েছেন শকুন্তলাকে। দেবার কারণ শকুন্তলার স্খলন। দুষ্মন্ত যেদিন তপোবন থেকে হস্তিনাপুরে রওনা দেন, তার পরের দিন সকালে মন খুবই খারাপ ছিল শকুন্তলার। আত্মনিমগ্ন ও অন্যমনস্ক ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে তাঁদের তপোবনে যে কঠিনস্বভাব ঋষি দুর্বাসা এসেছেন, শকুন্তলা তা খেয়াল করেন নি। অতিথি আপ্যায়নে কর্তব্যচ্যুতি দেখে দুর্বাসা ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং এই অভিশাপ দিয়েছে যে, যার চিন্তায় শকুন্তলা অতটা অন্যমনস্ক সে–ব্যক্তিটি শকুন্তলাকে ভুলে যাবে। শকুন্তলা ঋষির এই অভিশাপ শোনেন নি; আর দুষ্মন্তের তো শোনার প্রশ্নই ওঠে না। সেই অভিশাপের কারণেই দুষ্মন্ত ইচ্ছা–নিরপে ভাবে বিস্মৃত হয়েছেন শকুন্তলাকে। তাকিয়ে দেখেছেন, কিন্তু চিনতে পারেন নি। দোষ তাঁর নয়, দোষ ওই অভিশাপের। দোষ বলা যাবে শকুন্তলারও, তাঁর ভালোবাসাই তাঁর জন্য বিরহ ডেকে এনেছে।

ঋষির অভিশাপ শকুন্তলা না–শুনলেও তাঁর দুই সঙ্গী, অনুসূয়া ও প্রিয়ংবদা শুনেছে। শুনে হায় হায় করে তারা দৌড়ে গেছে দুর্বাসার পিছু পিছু। অনুনয় করেছে। কিন্তু ঋষি তো তার কথা ফিরিয়ে নিতে পারেন না, শুধু সংশোধনী যোগ করলেন এটুকু যে, শকুন্তলা যদি কোনো প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেন তবে দুষ্মন্ত তাঁকে চিনতে পারবেন। আশ্বস্ত হলো অনুসূয়া ও প্রিয়ংবদা। তাহলে ভয় নেই, কেননা সতী শকুন্তলার কাছে তো প্রমাণ আছে, রয়েছে রাজার দেওয়া রাজার নাম খোদাই করা মূল্যবান একটি আংটি। শকুন্তলার বিপদ হবে না।

ওদিকে সন্তানসম্ভবা হয়েছেন শকুন্তলা। তার পালক পিতা ঋষি কণ্ব বললেন, ‘এবার তোর পতিগৃহে যাওয়া প্রয়োজন।’ তপোবনবাসীদের কাছ থেকে শকুন্তলার বিদায় নেবার মুহূর্তটি কালিদাসের নাটকে সবচাইতে নাটকীয় মুহূর্ত নয় নিশ্চয়ই, নাটকীয় মুহূর্তটি আছে তখন যখন দুর্বাসা দ্বারা অভিশপ্ত শকুন্তলা রাজদরবারে দাঁড়িয়ে তার পরিচয়ের চিহ্ন হিসেবে দুষ্মন্তের দেওয়া আংটিটি খোঁজেন এবং দেখেন যে আংটি নেই। শকুন্তলার আঁচল শূন্য; আংটি কোথায় পড়ে গেছে কে জানে। বিস্তর পথঘাট পার হয়েছে, এসেছেন পায়ে হেঁটে, নদী, দুর্গম প্রান্তর, অরণ্যণ্ডসব অতিক্রম করে; স্মরণ নেই কোথায় খোয়া গেছে অতি মূল্যবান ওই প্রতীকচিহ্ন। শকুন্তলার জন্য সবচেয়ে কঠিন ও নাটকীয় মুহূর্ত এটিই। এ ছিল তাঁর অগ্নিপরীক্ষা। তপোবন থেকে বিদায়ের ক্ষণটি এর তুলনায় খুবই শান্ত। কিন্তু সেটিও ছিল অত্যন্ত করুণ। পালক পিতাকে ছাড়ছেন, ছেড়ে যাচ্ছেন আবাল্য সখীদের; লতা তাকে জড়িয়ে ধরে, প্রিয় হরিণ সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সবাইকে ত্যাগ করে, বারবার পিছু তাকিয়ে পতিগৃহে চলেছেন শকুন্তলা। আশা নিয়ে। লতা চলেছে বৃক্ষের খোঁজে। হায়, গিয়ে দেখবে বৃক্ষ নেই, বৃক্ষ পরিণত হয়েছে হৃদয়হীন নিরেট পাথরে।

রাজদরবারে দুষ্মন্ত বলেছিলেন, ‘প্রমাণ কী? কী করে বুঝব যে তুমি আমার স্ত্রী? শকুন্তলা বললেন, ‘প্রমাণ আছে।’ কিন্তু প্রমাণ তো তিনি দেখাতে পারলেন না। আকাশ ভেঙে পড়ল তার মাথার ওপর। সবকিছু বদলে গেল। তবুও চেষ্টা করেছেন শকুন্তলা, জাগাতে চেয়েছেন দুষ্মন্তের স্মৃতি। সেই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যাতে তারা দু’জনেই জড়িত। একদা বসেছিলেন তারা গাছের নিচে, দুষ্মন্তের হাতে একটি পদ্মপাতা, তাতে জল ছিল। একটি তৃষ্ণার্ত হরিণ এসেছিল কাছে। দুষ্মন্ত ওই মৃগের তৃষ্ণা নিবারণ করতে চাইলেন, কিন্তু মৃগটি এগোল না। শকুন্তলা যখন পাতাটি তার নিজের হাতে নিয়ে পান করতে দিলেন, মৃগ তখন তৃপ্তিভরে জল পান করল। এটি দেখে রাজা বলেছিলেন, ‘ও তোমাকে চেনে, তোমরা দু’জনেই এই বনের।’

কিন্তু অভিশপ্ত দুষ্মন্ত তো সবকিছু ভুলে বসে আছেন। সাড়া দেবেন কি, উল্টো হাস্য করলেন, বিদ্রুপের। উপমা দিয়ে বললেন, ‘বর্ষাকালে স্রোত যেমন বৃক্ষকে টেনে নিচে নামায়, তুমিও আমাকে তেমনি নামাতে চাচ্ছ, তোমার স্তরে। পঙ্কিল করতে চাচ্ছ আমাকে তোমার নিজের পঙ্কে।’ শকুন্তলা বলেছেন, ‘তুমি আর্য নও, তুমি অনার্য। তুমি নিজের মূর্তিতে সবাইকে দেখ। তুমি আমাকে স্বেচ্ছাচারিণী প্রমাণ করলে।’ বলে আঁচলে নিজের মুখ ঢেকে শকুন্তলা কেঁদেছেন। কিন্তু সেই চরম মুহূর্তে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করেন নি। এমনকি তাঁর নিজের সঙ্গীরাও নয়। সঙ্গীদের একজন, খুব জোরে যে এতক্ষণ শকুন্তলার পক্ষে বলছিল। সেই বদলে গেল। বলল, ‘হয় রাজা যা বলছে তা সত্য অর্থাৎ তুমি স্বেচ্ছাচারিণী, নয় তুমি যা বলছ তা সত্য অর্থাৎ তুমি রাজার স্ত্রী। যদি তুমি স্বেচ্ছাচারিণী হও তাহলে ঋষি কণ্ব তোমার মুখ দেখবেন না। আর যদি তুমি সত্যি সত্যি রাজার বিবাহিতা পত্নী হও তাহলে তুমি যে পতিব্রতা তা প্রমাণ করো, পতিগৃহে থেকে যাও। দাসীর মতো থাকবে হয়তো, তবু এখানেই থাকো। মোট কথা, আমরা তোমাকে সঙ্গে নিচ্ছি না। তুমি পাপিষ্ঠা।’ দুষ্মন্ত শকুন্তলার সঙ্গীদের কাছে জানতে চেয়েছেন তার পক্ষে কোনটা শ্রেয় হবে। শকুন্তলার কথা সত্য হলে শকুন্তলা দুষ্মন্তের স্ত্রী, আর মিথ্যা হলে শকুন্তলা পরস্ত্রী। কোনটা বড়ো পাপ, নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করা, নাকি পরের স্ত্রীকে নিজের বলে নিয়ে নেওয়া? চরম প্রশ্ন এবং মীমাংসা একটাই। শকুন্তলাকে ত্যাগ করা। না, শকুন্তলাকে তিনি রাখতে পারেন না। শকুন্তলার সঙ্গীরাও তাকে ফেরত নেবে না। শকুন্তলাকে কাঁদতে দেখে বৃদ্ধা গৌতমীর মায়া হয়েছিল। কিন্তু তিনিও নিরুপায়।

শকুন্তলা এখন কী করেন? বলেছিলেন, ধরণী বিদীর্ণ হও, আমি প্রবেশ করি। কিন্তু ধরণী বিদীর্ণ হয় নি। সঙ্গীরা তাকে ফেলে চলে গেছে। রাজার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন শকুন্তলা। সাড়া পান নি। উদ্ধার করলেন রাজপুরোহিত। বললেন, ‘যতদিন না তার সন্তানের জন্ম হচ্ছে ততদিন আমার গৃহেই থাকবেন শকুন্তলা।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত শকুন্তলার জন্য সে আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় নি। পুরোহিত গৃহে যাবার পথে আকাশ থেকে বিদ্যুৎবেগে নেমে এসেছেন শকুন্তলার মাতা, মেনকা। কন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন এবং নিয়ে গিয়ে রেখেছেন তাকে হিমালয়ের কাছে দুর্গম এক তপোবনে।

পরে আরেকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটল। হারানো আংটি ফেরত এলো রাজার কাছে, পরিষ্কার হলো সকল রহস্য। হস্তিনাপুর যাবার পথে এক নদীতে স্নান করতে নেমেছিলেন শকুন্তলা। আংটিটি যে কতো প্রয়োজনীয় তা তিনি জানতেন না; সাঁতরাবার সময়ে কোন ফাঁকে যে আঁচল থেকে সেটি খুলে পড়ে গেছে তা খেয়াল করেন নি। খেয়াল করেছে এক মাছ, আহার মনে করে আংটিটি সে গিলে ফেলেছে। পরে ওই মাছ ধরা পড়ে এক ধীববের জালে। মাছ কেটে আংটি পেয়ে জেলে সেটি বিক্রি করতে নিয়ে গেছে এক স্বর্ণকারের দোকানে। স্বর্ণকার দেখে আংটিতে রাজার নাম লেখা। সে গিয়ে খবর দিয়েছে নগরপালকে। নগরপাল আংটি নিয়ে হাজির হয়েছে রাজার কাছে। রাজা দেখেই চিনতে পেরেছেন। চিনতে পেরে শকুন্তলাকে তার মনে পড়েছে। ঋষির অভিশাপ ততদিনে কেটে গেছে, শুরু হয়েছে রাজার মনস্তাপ। বিদায় মুহূর্তে শকুন্তলার করুণ চাহনি রাজার মনে পড়ে। মনে পড়ে তপোবনে সুখের দিন ক’টি। বিশেষভাবে পীড়িত হন এই কথা ভেবে যে, তিনি নিঃসন্তান। তাঁর আরও স্ত্রী আছে, কিন্তু কোনো সন্তান নেই। শকুন্তলা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। রাজার জন্য মনস্তাপের কোনো অবধি থাকে না।

এক সময়ে একটি কাজের কাজ পেলেন তিনি। ইন্দ্রের আহ্বানে দেবলোকে গিয়ে অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফেরার পথে রথ নেমেছে হিমালয়ের কাছে। সেখানে এক তপোবন রয়েছে, তাতে দেখেন অল্পবয়স্ক এক বালক একটি সিংহশাবককে নির্যাতন করছে। দেখে তার অপত্যস্নেহ জাগল। পরে সব প্রকাশ পেল। এই বালক তারই পুত্র। এর মা হচ্ছে শকুন্তলা। তারপরে মিলন এবং গৃহে প্রত্যাবর্তন।

শকুন্তলারই জয় হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কেন? কিসের জোরে? জোরটা ছিল তার নিজের মধ্যেই। দু’টি গুণে বিশেষভাবে গুণান্বিতা কালিদাসের এই নায়িকা। এক. তাঁর রূপ। দুই. তাঁর মাতৃত্ব। এই দু’টিই মূল কারণ শকুন্তলার পক্ষে জয়ী হওয়ার।

প্রথম গুণ রূপ। সে রূপ অন্যরকম। শকুন্তলা একদিকে অল্পরকন্যা, যেজন্য তার রূপ অলৌকিক। অন্যদিকে, তিনি তপোবন–লালিতা; যেজন্য অত্যন্ত সরল। তার উপমা বনলতার। অলৌকিকতা ও সরলতার মিশ্রণে ভিন্ন রকমের তিনি। শকুন্তলার রূপ অক্ষয় হয়নি হয়তো। দুঃসহ শোকে, কঠিন যন্ত্রণায়, দীর্ঘ কৃচ্ছ্রসাধনায় ক্রমে য় পেয়েছে, কিন্তু তিপূরণ ঘটে গেছে আরেকভাবে মাতৃত্বে। সন্তানহীন দুষ্মন্তকে তিনি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন। তার যোগ্যতা সামান্য নয়।

সেই সঙ্গে অন্য একটি যোগ্যতাও রয়েছে শকুন্তলার। ‘মহাভারতে’র শকুন্তলার সঙ্গে তুলনা করলে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ‘মহাভারতে’র শকুন্তলার সংকোচ কিছুটা কম। রাজার কাছে আত্মপরিচয় তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন।

কালিদাস তার শকুন্তলাকে সে বিড়ম্বনা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। শকুন্তলার পরিচয় সখী অনুসূয়া বলেছে রাজাকে। একান্তে। ব্যাসের শকুন্তলা শর্ত দেয় বিবাহের; কালিদাসের শকুন্তলা বিয়ে করেন অন্য কোনো কারণে নয়, একটি মাত্র কারণেই শুধু, সেটি তার ভালোবাসা। এই শকুন্তলা দেখামাত্রই প্রেমে পড়েছেন দুষ্মন্তের, কৈশোরের জগৎ পার হয়ে পা দিয়েছেন তিনি অভিজ্ঞতার জগতে। ভান করেছিলেন কাঁটা ফুটছে তার পায়ে; কিন্তু ঠিকই ফুটেছিল, তবে পায়ে নয়, মনে। সেজন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

কালিদাসের দুষ্মন্তও কিন্তু কম যান নি। তপোবনে তিনি প্রবেশ করেছেন আত্মপরিচয় অবলুপ্ত করে দিয়ে। শকুন্তলা রাজার প্রশংসা শুনেছেন সাথিদের মুখে; কিন্তু তিনিই যে রাজা সে কথা ঘুণা রেও বলেন নি। আংটি দিতে গিয়ে দুষ্মন্ত প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলেন, কেননা আংটিতে তার নাম লেখা ছিল, ছল করে বললেন, রাজা দুষ্মন্ত ওই আংটি তাকে উপহার দিয়েছেন। বড় উদ্বিগ্ন ছিলেন দুষ্মন্ত একথা ভেবে যে, বর্ণভেদের কারণে বোধকরি শকুন্তলাকে বিয়ে করা তার পক্ষে অসম্ভব হবে। তিনি ত্রিয়, কণ্ব ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণকন্যা কি সম্মত হবে ত্রিয়ের পাণিগ্রহণে? যখন শুনলেন শকুন্তলা ব্রাহ্মণ নন, ত্রিয় পিতার সন্তান, তখন বড়ই আশ্বস্ত হলেন। তারপরে শকুন্তলাকে তার যে প্রত্যাখ্যান সে তো দৈবদুর্ঘটনা মাত্র।

নাটকের কাহিনী মিলনাত্মক। প্রথমে মিলন, পরে বিরহ, শেষে মিলন। কিন্তু ওই যে চূড়ান্ত পর্যায়ে মিলন তা কিন্তু বিচ্ছেদের দুঃখটাকে অবলুপ্ত করে দেয় না। বরঞ্চ পরিণতির সুখ আগের দুঃখকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্যই আশা করা যাবে যে, বিচ্ছেদের অগ্নিপরীক্ষা পার হয়ে তাঁরা উভয়েই শক্তিশালী হয়েছেন, শুদ্ধ হয়ে উঠেছেন; তাদের ভবিষ্যৎ সুখে ফাঁক ও ফাঁকি থাকবে না। কিন্তু তবু দুঃখভোগটা মিথ্যা হয়ে যায় না এবং দুঃখের কাহিনী বলেই শকুন্তলা–দুষ্মন্তের প্রেম এমন স্মরণীয়, নিরবচ্ছিন্ন সুখের গল্প হলে হাল্কা হয়ে যেত, গালগল্পের মতো।

মিথ্যা হয় না আরও এক সত্য। সে হচ্ছে নারীর অধস্তনতা। জয়ী হয়েও শকুন্তলা নারীই, আর নারী কিছুতেই প্রধান হবে না, নায়িকা হলেও নয়। প্রত্যাখ্যানের অধিকারটা তাই দুষ্মন্তেরই থাকে, শকুন্তলার থাকে না। আর যদিও স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছেন দুষ্মন্ত, তবু শকুন্তলাকে শুনিয়ে ‘নারী জাতি’ সম্পর্কে কটূক্তি করতে ছাড়েন না। আংটি খুঁজে না–পাবার হৃদয়বিদারক ক্ষণটিতে যে ধিক্কার শকুন্তলাকে শুনতে হয়, সেটি একটি অতিনিষ্ঠুর সাধারণীকরণ। দুষ্মন্ত বলেন, ‘তোমরা মেয়েরা যে উদ্ভাবনার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া গেল। প্রতারণা যে তোমাদের জন্মগত, তারও দৃষ্টান্ত দিলে তুমি।’ ‘বোঝা গেল’, দুষ্মন্ত যোগ করলেন কথাটা, ‘মেয়েদেরকে বিশ্বাস করতে নেই।’ নাট্যকার যতই উঁচুতে তুলুন তাকে দুষ্মন্তকে তার সময়ের ভেতরেই থাকতে হয়, বাইরে যে যাবেন সে উপায় কোথায়? শকুন্তলাকে তিনি ভালোবেসেছেন ঠিকই, আবারও বাসবেন ভালো, কিন্তু তাতে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে যে বদল আসবে, সে আশা বৃথা। ভেতরের মনোভাবটা একটু নাড়াচাড়া দিলেই বের হয়ে আসবে।

ওদিকে যে কণ্ব সর্বস্বত্যাগী ঋষি, যিনি সমাজ–সংসার জানেন না, তাকেও দেখি শকুন্তলার বিয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। শকুন্তলা আশঙ্কা করেছিলেন, রাজার সঙ্গে তার যে বিয়ে দুষ্মন্তের আগ্রহে পিতার অনুপস্থিতিতেই ঘটল, তার খবর পেয়ে কণ্ব ক্রোধান্বিত হবেন। তা হন নি, উল্টো খুশি হয়েছেন, কন্যা যোগ্যপাত্র পেয়েছে দেখে। সেটা যাক, আরও তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, শকুন্তলা পতিগৃহে যাচ্ছেন যখন তখন তাঁকে দেওয়া কণ্বের উপদেশ। পালক পিতা বলছেন পালিতা কন্যাকে, ‘পতিগৃহে গিয়ে তুমি গুরুজনদের শুশ্রূষা করবে। সপত্নীদের প্রতি প্রিয় সখীর মতো আচরণ করো। অপমানিত হলেও পতির বিরুদ্ধাচরণ করবে না।’ অকৃতদার এই ঋষিও সাধারণীকরণ করছেন, বলেছেন, ‘যুবতীদের পক্ষে গৃহিণীর পদ পাবার একমাত্র পথ ওই একটিই। বিপরীত পথে গেলে তারা পতির জন্য কারণ হয় যন্ত্রণার।’

এক অর্থে শকুন্তলা প্রকৃতির প্রতীক। যে প্রকৃতি ফুল দেয়, ফল দেয়, কিন্তু বিনিময়ে যত্ন চায়। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কটা হওয়া চাই সমঝোতার। লুণ্ঠন করলে দুষ্মন্ত আরেকজন স্ত্রী পেতেন, কিন্তু শকুন্তলাকে পেতেন না; প্রধান মহিষী পেতেন, তাঁকে পেতেন না দুষ্মন্তের জীবনকে যিনি পূর্ণ করে দিয়েছেন। প্রত্যাখ্যান এক ধরনের মরুভূমি বৈ অন্য কিছু নয়। অত্যন্ত শুকনো।

শকুন্তলা ছাড় দিয়েছেন, তপোবন ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন পতির সন্ধানে। দুষ্মন্তও ছাড় দিয়েছেন। শকুন্তলাকে রাজবাড়িতে পাননি, পত্নীর খোঁজে তাকে যেতে হয়েছে তপোবনে, তারপরে দুর্গম হেমকূটে। শিকারিরা এবং লুণ্ঠনকারীরা যে প্রকৃতির আত্মঘাতী শত্রু, এ কথা আমরা এখন বলছি। কালিদাসও সে কথাই বলে গেছেন, দু হাজার, বছর আগে।

শকুন্তলার জয় না হলে সভ্যতার ভারসাম্যটা টিকে থাকে কী করে?

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত