![সুফিয়া কামাল স্মরণে](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2017/11/21/sufia-kamal_112115.jpg)
বিশ্বজিৎ সিংহ, ২১ নভেম্বর, এবিনিউজ : সাহিত্য সংস্কৃতি ও নারীর সার্বিক বিকাশে বেগম সুফিয়া কামাল এ দেশের মানুষের কাছে অনন্য দৃষ্টান্ত। বাঙালি মুসলমান নারীর দুরাবস্থার কথা চিন্তা করে রোকেয়া সাখাওয়াত আক্ষেপের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন:
‘পাঠিকাগণ। আপনারা কি কোনদিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দী সভ্য জগতে আমরা কি? দাসী! পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না।
(মতিচুর ১ম খণ্ড)
অবরোধবাসিনী মুসলিম রমনীর সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে রোকেয়া তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল নারী শিক্ষার আয়োজন। নারীদের স্বাবলম্বন করে তোলা, নারীর ভেতরের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করার স্বপ্ন দেখেছেন তাঁর সেই কর্মের সবচেয়ে সার্থক উত্তরসূরি বেগম সুফিয়া কামাল।
রোকেয়া স্মরণে তিনি কয়েকটা কবিতাও রচনা করেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছেন,
‘অগ্নি দহনে জীবন তোমার
দাহন করিয়া জ্বেলেছ আলো
করেছ উজ্জ্বল অঙ্গন তব
নাশিয়া সকল আঁধার কালো’।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তাঁর জীবনের অমূল্য পাথেয়। তাঁদের প্রেরণায় তিনি সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। গদ্য রচনা দিয়েই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু। তাঁর প্রথম বই ‘কেয়ার কাঁটা’ (১৯৩৭)। গদ্য চর্চায় মাত্র তিনটা বই লিখেছেন। ভ্রমণ কথা সোভিয়েতের দিনগুলো (১৯৬৮), স্মৃতি চর্চা একালে আমাদের কাল (১৯৮৮) ও দিনপঞ্জি একাত্তরের ডায়েরি (১৯৮৯)। এরপর কবি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই সাঁজের মায়া (১৯৩৮)। বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘তোমার কবিতা আমাকে বিস্মৃত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্ছে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা’।
নজরুল বলেছেন,
‘সাঁজের মায়া’র কবিতাগুলো সাঁজের মায়ার মতই যেমন বিষাদ–ঘন, তেমনি রঙিন–গোঁধুলীর রংয়ের মত রঙিন। এ সন্ধ্যা কৃষ্ণা–তিথির সন্ধ্যা নয়, শুক্লা চতুর্দশীর সন্ধ্যা। প্রতিভার পূর্ণ চন্দ্র আবির্ভাবের জন্য বুঝি এমনি বেদনাপুঞ্জিত অন্ধকারের, বিষাদের প্রয়োজন আছে। নিশীত চম্পার পেয়ালায় চাঁদিনীর শিরাজি এবার বুঝি কানায় কানায় পুরে উঠবে। বিরহ যে ক্ষতি নয়, সাঁজের মায়ায় তার অনুপম নিদর্শন। এরপর ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়: মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দীওয়ান (১৯৬৬), প্রশস্তি ও প্রার্থনা (১৯৬৮), অভিযাত্রিক (১৯৬৯), মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০), মোর যাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২) ইত্যাদি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে ‘মোর যাদুদের সমাধি পরে কাব্যগ্রন্থে’ তার পরিচয় পাওয়া যায়।
সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সাময়িক পত্র সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্য সংস্কৃতিতে অনেক পুরস্কারও তিনি লাভ করেছেন। তাঁর উদ্যোগেই গঠিত হয় ঢাকায় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ (১৯৬০)। একদিকে দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, আবার অন্যদিকে ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর বজ্রাঘাত। স্নেহ ও শক্তির আধার।
শামসুর রাহমানের ভাষায় বলতে হয়: ‘অন্ধকারে যিনি বার বার হেঁটেছেন রাজপথে। জ্বলন্ত মশাল হয়ে নির্ভুল’। আজ এই মমতাহীন অন্ধবেলায় তাঁকেই খুঁজে কে শীতার্ত মানুষ কোমল স্নেহের প্রত্যাশিত ওমের জন্য – তাই স্মৃতিপটে বার বার ‘আলোকিত পদ্মের মতোই ফুটে ওঠে তাঁর মাতৃমুখ’।
নজরুল সম্পর্কে কবির অভিমত ‘একটা ব্যথার মধ্যে, সব অপূর্ণতার মধ্যে দিয়ে তাঁর কবিতা। এত ব্যথা, এত বেদনা আর যেন কোন খানে নেই। তাঁর সারাটা জীবন এ রকম কেটে গেছে। মুহূর্তের জন্যেও তাঁর বেদনা কখনো যায় নি সেই যে সমুদ্রের এত গর্জন, সেই গর্জনই রয়ে গেল তিনি লিখেছেন– ‘সেই দিন হব শান্ত’। কিন্তু দিন আর তাঁর জীবনে আসে নি। এটাই বড় দুঃখ। নজরুলকে তাঁর সব সময় স্মরণ হতো। কবির কবিতা পড়ে তাঁর ভিতর একটা চেতনার সঞ্চার হতো। মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ অবস্থাতেও তিনি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন– মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, তাতে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলা ভাষা যাতে বজায় থাকে সেই চেষ্টাই তিনি করেছেন।
সাহিত্য জীবনে তিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ‘সওগাত যুগেই’। ঐ যুগ ছিল স্বর্ণযুগ সত্য সুন্দর আনন্দের অন্বেষণে যাত্রা শুরু হয় সাহিত্যের পথে। বঞ্চিত উপেক্ষিত পীড়িত নারীর জীবনকে আলোর স্পর্শে জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি রোকেয়ার মতোই কলম ধরেন। স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন (১৯৭৬) এ। ভূমিকায় আবুল ফজল বলেছেন,
আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল এক অবিস্মরণীয় নাম। এত দীর্ঘকাল ধরে একটানা আমাদের জন্য মহিলা কবিতা চর্চা করেছেন কিন্তু সন্দেহ। কবি কেন, সব লেখকেরই রয়েছে দ্বৈত ভূমিকা– একটি নিজের প্রতি আর একটি নিজের দেশ আর সমাজের প্রতি অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে মানুষের প্রতি। সর্ব অবস্থায় সুফিয়া কামাল যুগপৎ এই দুই ভূমিকায় পালন করে এসেছেন।
সব শেষ তাঁর আশার বাণী: ‘দেশের মানব সমাজের কল্যাণ হোক’। নূতন প্রজন্ম, সাহসী হোক, সংগ্রাম হোক। মানুষ মানুষের মতো বেঁচে থাকুক।
(সংগৃহীত)