বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

ঘড়ি বাবু

ঘড়ি বাবু

লাবণ্য ভট্টাচার্য্য, ২৭ নভেম্বর, এবিনিউজ : দম দিতেই আবার সচল হোল ঘড়িটা। অস্থির কাঁপনে কাঁটাগুলো ছুটছে দ্রুত। সময়কে ছুঁতে চাই, ছুঁয়েও ফেলে। গত রাতের শ্বাসকষ্ট থেকে এখন মুক্ত ঘড়িটা। তৈয়ব মির্যার চোখের গর্তে একটু আলো ফোটে। স্বস্তির, কিন্তু কতক্ষণ তার আয়ু? আলোটা আবার ভুস করে নিভে যায়। আজ ভোরে একটা মানুষকে মাটি চাপা দিয়েছে মির্যা। তার হৃদ্‌পিণ্ডটা হঠাৎ অচল হয়ে পড়তে চায়। চশ্‌মার কাঁচের ফাঁকে সবকিছু ঝাল্পা লাগে। ঘড়ির সচল কাঁটাগুলোও কেমন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

হৃদপিণ্ডটা আবার ধুক্‌পুক্‌ করেক্ষাড়ে ওঠে। শ্লথ গতিতে যেন ঘুরে চলে কাঁটা, কিন্তু সামনের ঘড়িটার সঙ্গে যে তার দূরত্ব অনেক। পকেট থেকে রুমাল বের করে চশ্‌মার কাঁচটা মুছে ফেলে মির্যা।

দূর থেকে একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে খুট্‌ খুট্‌ একজোড়া। চঞ্চল পায়ের শব্দের সঙ্গে স্পষ্টতর হয় একটা কচি মূল, গায়ের রং– কালো, চোখের চাউনি কেমন সরল, মায়াবী, বোধহয় নূতন ভর্তিদের দলে। দ্রুত হেঁটে মেয়েটি করিডোর পেরিয়ে যায়। টিয়া বেঁচে থাকলে কি ওর বয়সীই হোত? হয়তো আরো একটু ছোট, ঠিকঠাক হিসাব মেলাতে পারে না সে। মাথার ভেতরের ভাবনার বিন্যাসগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। একটা কষ্ট ধোঁয়ার মত তার সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

মির্যার বুকের চিলেকোঠায় ছোট্ট টুন্‌টুনে একটা স্বপ্ন ছিল, অবাধ্য কল্পনার উষ্ণতায় তাকে সবসময় ভরিয়ে রাখতো মির্যা।

টিয়া একদিন বড় হয়ে তার অজ্ঞতার সব লজ্জাকে ঢেকে দেবে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির করিডোরে টিয়ার স্বগর্ব পদচারণায় পরিতৃপ্ত হবে মির্যা।

সাত–আট বছরের একটা শিশু সংসারে এমন সুখের নহর বইয়ে দিতে পারে তা আগে কখনও ভাবতে পারেন মির্যা। টিয়াই যেন তাকে বেঁচে থাকার অক্সিজেন যোগাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় টিয়ার মৃত্যু, –যেন সুখের ঝাড় লণ্ঠন আঁছড়ে পড়লো মাটিতে। বর্ণিল কাঁচের টুক্‌রোর সাথে বেঁচে থাকার অনিবার্য উপাদান ক্ষুদ্র্র, ক্ষুদ্র্র আলোর কণাও জীবন থেকে শুষে নিলো এক অবিনাশী আঁঠার।

তখন মির্যার হৃদ্‌পিন্ডের ধুক্‌পক্‌ প্রায় থেমে গিয়েছিলো, কিন্তু অচল হতে পারেনি, কুসুম দক্ষ হাতে আবার তার জীবন ঘড়িতে দম দিয়েছে। সংসারী হয়েছে মির্যা।

ঐ ছোট্ট মেয়েটা তাকে যে সুখ দিয়েছে সেই সুখকে মাঝেমাঝে বুকের ভেতর থেকে ছেনে তোলে মির্যা, তারপর গভীর রাতে তা চোখের সামনে মেলে ধরে কৃপণের মত।

এসব ভাবনায় মির্যার বুকের খোল ছেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে, আবার আপনাআপনি তা বাতাসে চালান হয়ে যায়।

আর নয়, একটা লম্বা সময়কে নষ্ট করে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। আরো বিশটি ঘড়িতে দম দিতে হবে। এরা অপেক্ষায় আছে তার একটু আদুরে ছোঁয়ায় কাঁটাগুলো মূলর হবে। গতিশীল জীবন যেন, সময়ের কাঁধে হাত রেখে যমজের মত এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ি আর সময়, সময় আর ঘড়ি।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ঘড়ি আর সময়কে নিবিড় সখ্যতায় বেঁধে রাখার কারিগর এই তৈয়ব মিয়া। প্রায় ত্রিশ বছরের চাকুরী তার। বিভিন্ন ভবনের ত্রিশ, চল্লিশটা ঘড়িতে প্রতিদিন দম দেয় মির্যা। শুধু ঘড়িতে চাবি দেওয়া নয়, ঘড়ি মেরামতের সুদ কারিগরও সে। তাই না চাইলেও ঘড়িবাবু নামটার ভার তাকে বহন করে যেতে হচ্ছে।

কলা ভবনের করিডোর দিয়ে হাঁটতে, হাঁটতে অতিক্রান্ত দিনগুলোকে নিয়ে আবারও ভাবে মির্যা, যে দিনগুলো জোর করে তার মনটাকে দখলে নিয়েছে।

কুসুম, টিয়া তার জীবন ঘড়ির এক একটা সচল কাঁটা যেন। এখন নিস্পন্দ, নিথর। মির্যার ভিতরটা ভারী, ভারী ঠেকে, সময় কেমন শ্বাস রোধী হয়ে ওঠে। তবুও হাঁটে মির্যা, সমাজ তত্ত্ব বিভাগের দেওয়াল ঘড়িটার কঠিন অসুখ, সারাতে হবে। এতদিন সময় পায়নি মির্যা। কুসুমই ছিল তার দিন রাত্রি দখল করে, কঠিন অসুখ, জন্ডিস। মির্যা টের পেলো অনেক পরে। ডাক্তারের আন্তরিক প্রচেষ্টা, আর মির্যার প্রাণপণ সেবা কিছুতেই ফেরানো গেলোনা কুসুমকে। তার হলুদ শরীর আর কালো হোল না।

গতরাতে কুসুমের লাশটা বার বার দেখেও কেমন অচেনা মনে হয়েছে মির্যার। বিশ বছরের সঙ্গী কুসুম। তার জীবন ঘড়ির গতি একটু ধীর হয়ে পড়লে নিপুণ হাতে সব ঠিকঠাক করে দিতো। আর এখন সে কোথায়? কষ্টের একটা নিম্নচাপ ঘনিভূত হয় মির্যার বুকে। হাঁটার গতি ক্রমশঃ ধীর হয়ে আসে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের খোল ছেড়ে ছুটে পালায় বাতাসের অনুকূলে।

মির্যা ভাবে টিয়া আর কুসুম এই দুটো মানুষের নেই হয়ে যাওয়া কেমন অবিশ্বাস্য। কুসুম তবু এখনও আছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে, সামান্য কাঁচা মাটির ঢাক্‌না,- তার নিচে কুসুমের ফুলে ওঠা শরীর, চোখ দুটো বন্ধ। আজ সকালেই মির্যা কবর দিয়েছে তাকে। কিন্তু মেয়েটা অনেক দূরের মানুষ। মাঝখানে বারো বছরের অস্পষ্টতা। ছুঁতে পারেন তাকে। শুধু জলের পর্দার আড়ালে চোখ দুটো ঝাল্পা হয়ে আসে।

নাহ্‌, আরক্ষায়, ঘড়িটা আজ সারাতেই হবে। ক্লান্ত পা দুটোয় ভর করে কোনভাবে নিজেকে টেনে নিয়ে যায় মির্যা। অনুমতি ছাড়াই বিভাগীয় সভাপতির রুমে ঢুকে পড়ে সে। লোকটার ভাবলেশহীন মুখে হঠাৎ বিরক্তির শেকড় গজায়।

“কোথায় ছিলে তুমি এতদিন? ঘড়িটা সেই কবে খারাপ হয়ে পড়ে আছে। বার বার বলেও তোমাকে কোন কাজ হয়নি, জান? আমি তোমার বিরুদ্ধে একশন নিতে পারি?ঃ

এসব কড়কড়ে কথা মির্যাকে তেমন স্পর্শ করে না। তার পাথরের মত চোখ জোড়া পলকহীনভাবে ঘড়িটাকে দেখে।

“কি হোল দাঁড়িয়ে কেন? যাও, যাও কাজে লেগে পড়।ঃ ধমক দেয় সভাপতি। মির্যা নিঃশব্দ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আছে ঘড়িটা। ছোট বড় সব কাটগুলোই বন্ধ, স্থির তার স্ত্রী কুসুমের ঠোঁটের মত।

মির্যার ভেতর একটা চাপা আলোড়ন। ঘড়িটা আজ সারাতেই হবে। গতিশীল কোন কিছুর হঠাৎ থেমে যাওয়া বড় কষ্টকর তার কাছে।

দেওয়াল ঘড়িটাকে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনে মির্যা। তারপর রিক্সায় তুলে সোজা দোকানে ফিরে আসে। ঘড়িটার গায়ে ধুলো জমেছে। খুব আস্তে, আস্তে ময়লা পরিষ্কার করে সে। বার বার ঝাল্পা হয়ে আসা চশ্‌মার কাঁচ মুছে নেয়। আবার স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ো ঘড়িটা খুলে ফেলে মির্যা। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরীক্ষা চলে তার। কিন্তু কতক্ষণ?

রাজ্যের ক্লান্তি বিষের মত ছেয়ে ফেলে শরীর মন। ঢলের মত অবসাদ নামে। গত রাত থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষুধাটা ছুরির মত পেটের নাড়িভুড়ি কাটছে। সামনে রাখা গ্লাসের সবটুকু পানি পেটের ভেতর চালান করে দেয় মির্যা। তারপর দোকানের এক কোণায় পড়ে থাকা তক্তোপোষে গুটিশুটি শুয়ে পড়ে। মাথার নিচে ভাঁজ করে রাখা হাতটা বালিশের কাজ দেয়। কিন্তু ঘুম কোথায়? চোখের পাতাকে শাসন করে সে। অবাধ্য চোখ খুলে যায়, ঘুমকে বাগে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই।

পাঞ্জাবীর পকেটে হাত রাখে মির্যা, মানিব্যাগের ভিতর বেশ কিছু পুরোনো কাগজ, মাঝখানে একটা ছোট্ট ছবি আর পুরোনো আরো বিবর্ণ। টিয়া, মির্যা আর কুসুম। অনেক দিন আগে তোলা ছবি, টিয়ার মূলটা কেমন অস্পষ্ট, হলুদের ছোপ। ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে টিয়া। অনেক দিন ছবিটা দেখা হয়নি। কুসুমের অসুখ কেমন ব্যস্ত করে রেখেছিলো তাকে।

আসলে মানুষের তুলনায় ছবি একেবারে মূল্যহীন আর মানুষ ফুরিয়ে গেলে ছবিটা সম্বল হয়ে ওঠে। যেমন– মির্যার জীবনে এই ছবি ছাড়া আর কিছু নেই।

হঠাৎ তার হৃদ্‌পিণ্ডটা ছিঁড়ে ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে বেরিয়ে আসে। এক সময় ঘুম আর ক্ষুধা দুই শক্তিধর শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে ঘুমের কাছেই হার মানে মির্যা।

ঘুম তাকে অনেক দূরে নিয়ে যায়, ফিরে আসে বেশ দেরিতেই, যখন ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে সাতটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। আলো জ্বালে মির্যা। ঘড়িটার মুখোমুখি হয়। টেবিলের উপর চিৎ হয়ে আছে ঘড়ি। কাজ শুরু করে মির্যা, বেশ কিছুক্ষণ নিচু হয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়টা ব্যথা করছে।

চা আসে, আবার কাজ শুরু, বুকের ভেতর চ্‌িন চিনে ব্যথা। টেবিলে মাথা রাখে মির্যা। চোখ দুটো জ্বলছে একটানা ঘুমের পরেও চোখের অবাধ্যতা। চা আর টোষ্ট বিস্কুটের সহায়তায় ক্ষিধের কুমির শান্ত হয়। পোষ মানে, তবুও মাথার ভেতর ঝিঁঝিঁর ডাক। কিন্তু বসে থাকার আর উপায় নেই। ঘড়িটা যে আজই ঠিক করতে হবে।

আবার সোজা হয়ে বসে মির্যা, কাজে মন দেয়। প্রাণপণ চেষ্টায় সে ঘড়িটা সারিয়ে তোলে। অচল ঘড়িটা এখন সচল, তার স্থির কাঁটাগুলো নড়ছে, এদিক, ওদিক।

মির্যার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। নিজেকে এখন বেশ হাল্কা মনে হয়। ঘড়িটা ঠিক করে দেওয়ালে বসিয়ে দেয় মির্যা। কাঁটাগুলো আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। পেন্ডুলামটা দুলছে ডানে, বামে, বামে ডানে। চারপাশের নির্জনতা ভেঙে হঠাৎ বারোটার ঘন্টা বাজে। মির্যার কাজ শেষ, কিন্তু কোথায় যাবে সে এখন? বাসায় ফেরার তাড়া নেই, নিজের কষ্টকে খুলে দেখাবার মত কেউ কোথাও নেই। ঘর জুড়ে শুধু শূন্যতা আর স্মৃতির পোড়া গন্ধ, যাতে দম আটকে আসা বিবামিষা তৈরি হয়।

অগত্যা আলো নিভিয়ে দোকান ঘরেই শুয়ে পড়ে মির্যা। ঘরের ভেতর পেন্সিলের শিষের মত ঘন কালো অন্ধকার। প্রাণপণ চেষ্টায় সে ঘুমকে ছুঁতে চায়, পারে না, ঘুমের এই লুকোচুরি খেলায় পরাস্ত হয় সে।

মির্যার বন্ধ চোখের ভেতর ঘড়ির চঞ্চল কাঁটা ঘুরছে, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, এগিয়ে যাচ্ছে সময়। আর ক্রমশঃ পিছিয়ে যাচ্ছে মির্যা। সময়ের পিচ্ছিল পিঠ থেকে সে যেন পড়ে যাচ্ছে শুধু।

বন্ধ ঘড়ি মেরামতের সুদ কারিগর এই তৈয়ব মির্যা। কত নষ্ট ঘড়িকে সে আয়ু দিয়েছে, বার বার। কুসুম, টিয়া তার জীবন ঘড়ির এক, একটা সচল কাঁটা। থেমে গেছে চিরকালের মত। নিয়তির কাছে আজ কত অসহায় সে। এই নিয়তিরই নিষ্ঠুর কুঠারাঘাতে কুসুম, টিয়ার সাথে সব সম্পর্ক কাটা পড়ে গেছে কখন। ঘড়ি বাবু নামটা তার কাছে আজ শুধুই প্রহসন।

ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর কষ্টের অবিরাম আক্রমণে মির্যার ভিতর কি সব হয়ে যায়। দম আটকে আসে তার। অচিন এক ব্যথা তার পাঁজরের দেওয়াল খামছে ধরেছে, যেন শ্বাসনালীর দরজাটা আটকে দিয়েছে কেউ। মির্যার বুকের খাঁচা ভেঙে হৃদ্‌পিণ্ডটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, পারে না, শুধু অবাধ্য কষ্টের কতগুলো সাদা ফেনা গলার কাছে এসে কেমন আটকে যায়।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত