
ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, এবিনিউজ : ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং ভারতের হিমাচল প্রদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। আগ্রহের বিষয় ব্যাসেল বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক খাত, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজার ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি। কর্মজীবন শুরু ১৯৭৯ সালে ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ অন হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টে। পরে ১৯৮১তে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন বিআইবিএমে। ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক। বিআইবিএম আয়োজিত বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্সসহ ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এবিনিউজের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
এবারের ব্যাংকিং সম্মেলনের থিম কি?
বিআইবিএম ২০১২ সাল থেকে বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন করে আসছে। এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাংকিং পেশাজীবী, গবেষক, শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বলা যায়, তাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করার উদ্দেশ্য নিয়েই এ প্লাটফর্ম তৈরি করা। এ সম্মেলনে শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, বাইরে থেকেও গবেষণা নিবন্ধ আসে। একইভাবে আমরা এ বছরও জুনের দিকে গবেষণা নিবন্ধ আহ্বান করেছি। এবার ১০০টির মতো প্রবন্ধ সংক্ষেপ পেয়েছি। তার থেকে আমাদের মূল্যায়ন কমিটি চূড়ান্তভাবে ২০টি নিবন্ধ নির্বাচন করেছে। তবে এ বছরও দুই দিনব্যাপী সম্মেলন হবে। দুদিনের অবশ্য দুটি থিম। প্রথম দিনের থিম— সামষ্টিক ব্যাংকিং পরিবেশ (ম্যাক্রোব্যাংকিং এনভায়রনমেন্ট) আর দ্বিতীয় দিনের থিম— আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ডিজিটাল আর্থিক সেবা (ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ফর ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন)।
থিম হিসেবে এবার এসব বিষয় বেছে নিলেন কেন?
এসব থিম বেছে নেয়ার একটি প্রেক্ষাপট আছে। আমরা তো এমনিতেই প্রতি বছর আমরা ব্যাংকের ক্রেডিট, ট্রেড, ট্রেজারি, ইন্টারনাল কন্ট্রোল, হিউমেন রিসোর্স, ইসলামিক ব্যাংকিং ও আইটি— এ সাতটি খাতের ওপর প্রতি বছরই সার্ভে করি। সাতটি ক্ষেত্রের জরিপের ফলাফলে যা পেয়েছি তাতে মনে হলো আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছে সেগুলো শেয়ার করি। একদিকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে প্রচেষ্টাগুলো ছিল, সেগুলো থেকে ধীরে ধীরে সুফল আসা শুরু করেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্তিমিতও হচ্ছে, এটিও ঠিক; অন্যদিকে আমাদের যে সার্বিক ব্যাংকিং পরিবেশ, আমাদের ক্রেডিটের সার্ভে, ট্রেডের সার্ভে ও ইন্টারনাল কন্ট্রোলের সার্ভে থেকে মনে হয়েছে যে, সামষ্টিক ব্যাংকিং পরিবেশের থিমটি এবারের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হবে।
দ্বিতীয় দিনের থিম সম্পর্কে বলতে গেলে, একদিকে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যই হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি। এখন এজন্য সুনিশ্চিতভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নই হতে হবে। প্রবৃদ্ধি ও অর্থায়নের মধ্যে কোনো ধরনের বৈপরীত্য থাকলে জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নীতি আগে থেকে নেয়া শুরু করেছে। এবারের দ্বিতীয় দিনের থিমটা জাতীয় লক্ষ্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে খাপ খেয়ে যায়। আবার কিছু বিদেশী সংস্থাও এ থিমের ব্যাপারে একটু উৎসাহ দেখাচ্ছিল। সবকিছু মিলে আমরা শেষ দিনের থিম ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ফর ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন রেখেছি।
বিশ্বের ব্যাংকিং খাত যেভাবে এগোচ্ছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তাল মেলাতে পারছে কি?
আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই তো ব্যাংকিং। সারা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা এখনো দেখব যে, প্রবৃদ্ধির হার খুব একটা বাড়েনি। এখনো ৩-৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও ধীরে ধীরে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে আসছে কিন্তু সেই হারে এখনো আসেনি। এবং আর্থিক সংকটের বড় ভিকটিম ও সোর্স ছিলেন ব্যাংকাররাই, যার জন্য বিশ্ব ব্যাংকিং খাত সে অর্থে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখনো কিন্তু তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এবং আর্থিক খাতকে ঠিক করার জন্য ব্যাসেল-৩ দেয়া হয়েছে। এটিও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ডড-ফ্রাংক অ্যাক্ট নামে যে আইনটি করা হয়েছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বললেন, তিনি ওই আইন বাতিল করবেন। এর ফলে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন থমকে দাঁড়ায়। এতে ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া ততটা দ্রুত হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র ডড-ফ্রাংক অ্যাক্ট সংশোধন করলে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নও থমকে যাবে। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং খাত দোলাচলে পড়ে যাবে। তারা কি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করবে, নাকি নিজেরা নিজেদের মতো করবে— এ নিয়ে একটি বড় অনিশ্চয়তা দেখা যাবে। এদিকে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে, এটা ঠিক। এখন ব্যাংকিং খাতও যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে সুনিশ্চিতভাবে সেটি প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে। অন্যথায় ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার সুযোগ কম।
সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংকিং খাতের কি অবস্থা?
বাংলাদেশে আমরা ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের স্কিম অনেক আগেই নিয়েছি। সেই অর্থে আমরা বাস্তবায়ন শুরুও করে দিয়েছি। ব্যাসেল-৩ আবার কেবল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে নয়, তার একটি অংশ হচ্ছে লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট। সেটা তো আমরা অনেক আগেই গ্রহণ করেছি। ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করতে গেলে আসলে ক্যাপিটাল রিকোয়ারমেন্ট বাড়বে, যেহেতু ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার নামে একটি নতুন বিষয় এসেছে, যেখানে মূলধনের ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ টায়ার ১-এ রাখতে হবে। সেজন্য ক্যাপিটাল রিকোয়ারমেন্ট বাড়বে। এখন প্রশ্ন হলো, এ ক্যাপিটাল রিকোয়ারমেন্ট আমাদের ব্যাংকগুলো পূরণ করতে পারবে কিনা? ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোর অতটা সমস্যা হবে না। সমস্যাটা হবে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আবার সেই অর্থে সমস্যাও নেই, সরকার যদি দিয়ে দেয়। কিন্তু আসলে সমস্যা বলছি এ কারণে যে, ব্যবসা করে ক্যাপিটাল তুলে আনতে পারলে সেটাকেই কৃতিত্ব দিতাম। সেটা না করে যদি রাজকোষাগার থেকে ক্যাপিটাল গ্যাপ পূরণ করা হয়, তাতে কোনো কৃতিত্ব নেই। সেই অর্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর একটু সমস্যা হবে। তবে আমি আশা করি, দু-একটি ছাড়া ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোর খুব একটা সমস্যা হবে না।
দু-একটি ব্যাংক না পারলে তাদের জন্য কী করণীয়?
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ব্যাংক একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ হওয়া উচিত। এর ওপর আমরাও একটি আলোচনা করেছিলাম। একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের বিষয়গুলো সার্বিক ব্যাংক রেজল্যুশনের একটি অংশ। আমাদের একটি সার্বিক ব্যাংক রেজল্যুশন পলিসি থাকা উচিত। বলতে চাইছি, এক্সিট পলিসি। বাজার অর্থনীতিতে কেউ যদি লাইসেন্স শর্ত কোয়ালিফাই করেন, তাকে লাইসেন্স দেয়া উচিত। তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আবার রেগুলেটরের নয়। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টোটা। এখানে কেউ লাইসেন্স পেলে মনে করেন— আমি শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যাংক ব্যবসা করব, আর সমস্যায় নিপতিত হলে আমাকে উদ্ধার করা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এ রকম একটি দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। এমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে ব্যাংকাররা (মালিকসহ) দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন না। সেজন্য আমি মনে করি, শুধু একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ নয়, সার্বিক ব্যাংক রেজল্যুশন পলিসি থাকা উচিত— প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে কীভাবে বিদায় নেবে। একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ কখনো জোর করে হয় না।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিচালকের সংখ্যা, মেয়াদ বাড়ানো হলো। এটাকে কীভাবে দেখেন?
এটা নিয়ে বিভিন্ন সময় নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়। উদ্যোক্তা-মালিকপক্ষ যুক্তি দেয়, ব্যাংকটি তাদের। সেখানে তারা তিনজনের জায়গায় চারজন রাখলেন বা নয় বছরের জায়গায় ১৯ বছর রাখলেন, তাতে কী আসে যায়; বিদেশে তো বছরের পর বছর থাকতে পারে! এ যুক্তি খণ্ডন করে আমরা বলতে চাই যে, স্পন্সর ডিরেক্টর কেউ নয়, মৌলিকভাবে ব্যাংকগুলোর মালিক হলেন আমানতকারীরা। ক্যাপিটালের অংশটা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বড়জোর উদ্যোক্তাদের ক্যাপিটাল হবে ২-৩ শতাংশ। ২-৩ শতাংশ বিনিয়োগ করে কেউ যদি ১০০ শতাংশ ফান্ডের ওপর খবরদারি করেন, তা অবশ্যই অন্যায় হবে। বিদেশে যে পরিচালকরা বছরের পর বছর বোর্ডে থাকেন, কীভাবে থাকেন? বিদেশে রাখে কেন? বিদেশে পরিচালকরা ব্যাংকের বোর্ডে বসে অনেক সক্ষমতা অর্জন করেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তিনি ব্যাংকটি ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য তাকে রাখা হয়। আমাদের দেশে তো এ ধরনের কোনো উদাহরণ নেই যে, কোনো একটি বোর্ড সক্ষমতা অর্জন করে প্রমাণ করেছে, তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যাংক চালাতে পারে! এজন্য পরিচালকদের আমরা বারবার রাখতে চাই। সুতরাং আমার কথা হলো, ব্যাংকের বোর্ডগুলো যদি দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জন করতে পারত তাহলে না-হয় পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো যায়, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা যেহেতু হচ্ছে না, সেহেতু এ আইন করার কোনো ন্যায্যতা নেই।
দ্বিতীয়ত. বিদেশী ব্যাংকগুলোয় যেসব ডিরেক্টর বসেন, তারা নিঃসন্দেহে মালিকদেরই প্রতিনিধি কিন্তু তারা একেকজন যে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, সেটি বিস্ময়কর। এমন ব্যক্তিদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিলে মানুষ এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। তাছাড়া বিশ্বের সব দেশেই বোর্ডের কাজ তো আর ঋণ মঞ্জুর করা নয়, এক্ষেত্রে আমি বাংলাদেশেই কেবল বিচ্যুতি দেখি। শুধু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বোর্ডই ঋণ মঞ্জুর করে। ঋণ মঞ্জুরের মধ্যেই সব আকর্ষণ নিহিত। বোর্ডের কাজ হচ্ছে নীতি তৈরি করা, একটি ভিশন-মিশন ঠিক করে দেয়া— কোন দিকে যাবে ব্যাংকটি। অথচ আমাদের দেশের বোর্ড নীতি তৈরি করতে সক্ষম নয়, তাদের আকর্ষণ ঋণ মঞ্জুর করায়। সেটা যদি ঠিকমতো করত তাহলেও ভালো হতো, সেটিও তো যথাযথভাবে হচ্ছে না। সেজন্য আমরা আলোচ্য সংশোধনীর বিরোধী। এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও এটির প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ধরে মতামত দিয়েছে। অনেক বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছে।
দেখা যাচ্ছে, একটি গ্রুপের কাছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক চলে গেছে। এটাকে কীভাবে দেখেন?
এটাকে আমি পুঁজি কিছু হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখি। আসলে আমাদের শাসনতন্ত্রও এটি সাপোর্ট করে না, বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক নীতিও এটা সাপোর্ট করে না। পুঁজির এমন পুঞ্জীভবন হলে দেশের মধ্যে সম্পদবৈষম্য আরো বাড়বে। একটা গ্রুপের কাছে সম্পদ যদি পুঞ্জীভূত হয়ে যায়, তাহলে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না।
এটা তো বৈধভাবে নেয়া হচ্ছে না, অবৈধভাবে জোর করে নেয়া হচ্ছে?
একে উন্নত বিশ্বে বলা হয় হোস্টাইল টেকওভার। হোস্টাইল টেকওভার বিশ্বের বহু দেশেই হয়। একটি কোম্পানির শেয়ার অন্য আরেকটি কোম্পানি-গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ক্রয় করে প্রথমোক্ত কোম্পানির বোর্ড দখল করে নেয়। বাংলাদেশেও তা-ই হচ্ছে। ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু হলেও অবৈধ নয়। দৃষ্টিকটু এ কারণে যে, টেকওভার হওয়া ব্যাংক দুটো পারফরম্যান্সের দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোই ছিল, প্রসঙ্গক্রমে ব্যাংক দুটি ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক। টেকওভারের পেছনে যুক্তি দেয়া হচ্ছে, তারা জঙ্গি অর্থায়ন বা অন্য কিছুতে জড়িত। যাদেরকে ইসলামী ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তাদের পোর্টফোলিও হওয়া উচিত ইসলামিক। অর্থাৎ পোর্টফোলিওর অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ পিএলএস থাকা উচিত। এ ধরনের রেগুলেটরি বাধ্যবাধকতা ও বিএফআইইউর কড়া নজরদারি ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারবে।
কেলেঙ্কারিগুলোর বিচার হয় না...
বিচার বা শাস্তি হয় না বলেই তো নতুনভাবে আবার কেলেঙ্কারি ঘটে। এটাকেই আমরা বলি বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে যে একের পর এক কেলেঙ্কারি ঘটছে, এর পেছনে মূল কারণ শাস্তি না হওয়া। শাস্তি যথাযথভাবে হলে একটির পর একটি কেলেঙ্কারি হতো না।
সম্প্রতি স্বতন্ত্র পরিচালকরা অনেক ব্যাংক থেকে সরে আসছেন? এর কারণ কী বলে মনে করেন?
স্বতন্ত্র পরিচালকের ধারণাগত অর্থ হলো, তারা ব্যবস্থাপনা থেকে স্বাধীন। কিন্তু এখানে স্বতন্ত্র পরিচালকের নামে যাদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তারা ব্যবস্থাপনায় স্বাধীন, তবে তারা মালিকদের কাছে নির্ভরশীল। তার মানে মালিকদের আত্মীয়স্বজনই আসছেন। তারা মালিকদেরই লক্ষ্য পূরণ করেন। দু-একটি ব্যাংকে, যেখানে সরকার থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক দেয়া হয়, তারাও সরে আসছেন। কেন? তার দায়বদ্ধতা থেকে। দেখছেন যে, ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে পারছেন না। ফলে সেখান থেকে সরে আসছেন।
ব্যাংকিং খাতে জনবলের কি অবস্থা?
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিসিএস পরীক্ষার মতো ব্যাংকিং খাতের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোও সব বিষয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। অর্থাৎ যেকোনো বিষয় থেকে ব্যাংকিং খাতে আসতে পারবে। যা-ই হোক, বিভিন্ন বিষয় থেকে এলেও তাকে সেভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, শিখিয়ে নিতে হবে। ইদানীংকালে দক্ষ জনবল শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সমস্যা নয়, ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোরও বড় সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে যে, প্রবেশন অফিসার বা এমটিও নিয়োগ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে করতে হবে। বিষয়টি ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোও পরিপালন করে। কিন্তু এর নিচে বা অন্য পদগুলোয় নিজেদের পরিচিত লোক নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে ইদানীংকালে ব্যক্তিখাতেও মানবসম্পদ নিয়োগ ভালো হচ্ছে না। কিছুদিন পর ব্যাংকগুলো এর প্রভাবজনিত সমস্যার মুখোমুখি হবে।
দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হলো, আশির দশকের শুরুতে দেশে ব্যাংক ছিল ৮-১০টি। উপরের লোকজন ওই ৮-১০টি ব্যাংকেরই। এরা চলে যাওয়ার পর বিরাট শূন্যতা তৈরি হবে। কারণ এখন ব্যাংক ৫৭টি। এতগুলো ব্যাংক পরিচালনার জন্য বিপুলসংখ্যক এমডি, ডিএমডি, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইত্যাদি লাগবে। এত লোক পাবে কোথায়? এজন্য ব্যাংকের জনবল পরিকল্পনা থাকা উচিত। কিন্তু আমার জানামতে, খুব কম ব্যাংকেরই যথাযথ জনবল পরিকল্পনা আছে। যখন যাকে দরকার তখন এক বা দুই ধাপ পদোন্নতি ও বেশি অর্থ দিয়ে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে নিয়ে আসা হয়। এটি একটি খারাপ ব্যাপার। অভিজ্ঞতা ছাড়াই একটি বড় পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এতে খরচও বাড়ে আবার ব্যাংকের জন্যও খুব একটা ভালো হয় না।
ব্যাংকিং খাতের মূল নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বা অবস্থার ব্যাপারে মত কী?
আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে আমার অভিমত হলো, বিশ্বে কোনো উদাহরণ নেই যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী না করে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী বা উজ্জীবিত করা যায়। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে যদি টার্ন অ্যারাউন্ড করাতে হয়, তাহলে সেটি অন্য কাউকে দিয়ে হবে না, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংককেই করতে হবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকতে পারে, সেটি নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে এবং সেগুলো দূরীভূত করা যেতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে অন্য কিছু করে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করা আমার মনে হয় না সফল হবে।
উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমি দেখি নীতিনির্ধারকরা সবসময় বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করলে মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং ডিভিশনটি কেন করেছিলেন আপনারা? সবকিছুই মন্ত্রণালয় করে কিন্তু আবার কোনো দায়দায়িত্ব নেবে না। এখানে সমস্যা হচ্ছে, সরকার মালিক আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো সরকারের উপরে নয়। নিয়ন্ত্রক মালিকের অধস্তন হলে কীভাবে মালিককে নিয়ন্ত্রণ করবে? এটা বিরাট উভয় সংকট। এজন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার।
সৌজন্যে: বণিক বার্তা