বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

রাহাত খান : সময়ের নির্মোহ কথক

রাহাত খান : সময়ের নির্মোহ কথক

আহমেদ মাওলা, ০১ ডিসেম্বর, এবিনিউজ : রাহাত খান (জন্ম ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪০) মূর্ত সময়ের এক বিস্ময়কর কথক হিসেবে আমাদের সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন। সত্তর দশক ছিলো এক বিলোড়িত সময়,-সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ–একদিকে ছিলো বিজয়ের উল্লাস, অন্যদিকে সমাজের ভেতরে চলছে মূল্যবোধের নীরব ভাঙচুর, নৈরাজ্য, অবক্ষয়ণ্ড সেই নষ্ট ও নিষ্ঠুর সময়ের অকপট কথক হয়ে ওঠেন রাহাত খান। গল্প দিয়েই তিনি সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রথম বই ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, রাহাত খান আমাদের চেনা জগতেরই গল্প লেখেন কিন্তু পড়তে পড়তে একটু অগ্রসর হলেই বোঝা যায়, চেনা জগত ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, আমরা প্রবেশ করি এমন এক অচেনা এলাকায়, যেখানে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব সামান্য, আমরা রুদ্ধশ্বাসণ্ডবিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমাদের স্নাষু আলোড়িত হয়, জীবনের বিভিন্ন প্রান্তের দরজা খুলে যায়। মানবিক কারুণ্য এবং অশ্রুজল আমাদের অধিকার করে নেয়। বাস্তবতাকে ধরতে গিয়ে তিনি ভাষাকে ভেঙেচুরে নিজের মতো করে গড়েছেন, তুলে এনেছেন মানুষের মুখের অবিকল ভাষা, সংলাপে জুড়ে দিয়েছেন ্যাং, অশ্লীল বাক্য। জীবনকে তিনি কতোভাবে খুঁটিয়ে দেখেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাহাত খানের অঙ্কিত চরিত্রগুলোর দিকে তাকালেই। দালাল, ফড়িয়া, বদমাশ, ব্যর্থ, পরাজিত, নষ্ট, নিষ্ঠুর মানুষ অবলীলায় স্থান করে নিয়েছে রাহাত খানের গল্পে। ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ‘ভালোমন্দের টাকা’ ‘অন্তহীন যাত্রা’ ‘চুড়ি’ ‘শরীর’ ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ ইত্যাদি অসাধারণ গল্প আমাদের অবাক করে দেয়। তার ভাষা কুশলতা, জীবনাভিজ্ঞতা আমাদের বিস্মিত করে। সালাউদ্দিন আইয়ুবের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাহাত খান বলেছেন, ‘ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র কোনটাতেই আমার পরিপূর্ণ বিশ্বাস বা আস্থা নেই। তবে আমি ব্যক্তি উদ্যোগ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক দায়িত্ব সচেতনতা ও মানুষের মৌলিক অধিকারে বিশ্বাসী।’

অর্থাৎ রাহাত খান শ্রেণিগত চেতনাকে সামনে রেখে সাহিত্যচর্চা করেন নি। আমাদের এখানে এরকম একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, দুঃখ–দারিদ্র্য, বস্তি এবং নিম্নশ্রেণির জীবন নিয়ে লিখলেই মহৎ সাহিত্য হয়। নিম্নবিত্তের জীবন নিয়ে লিখলেই কমিটম্যান্টের সাহিত্য, লেখকের সামাজিক দায়িত্ব পালন হয়, নচেৎ হয় না। কিন্তু মাক্সীয় সমালোচক আলথুজার বলেছেনণ্ড ‘শ্রেণিগত বাস্তবতা একমাত্র বাস্তবতা নয়, শ্রেণিগত মানবতাও একমাত্র মানবতা নয়, সব কিছুকে শ্রেণির মধ্যে ফেলে বিবেচনা করার মধ্যে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে।’ সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব যেমন আছে, তেমনি শ্রেণিশোষণের স্বরূপ উন্মোচন করাও লেখকের দায়িত্ব। মানবজীবনের সব প্রান্তকে বিচার করা উচিত মানবিকতার মহৎ আত্মদর্শন দিয়ে। সেই দার্শনিক প্রত্যয় রাহাত খানের লেখায় আছে। রাহাত খান সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭৫ সালে সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার, সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯) মাহবুব উল্লাহ–জেবুন্নেছা পুরস্কার (১৯৭৯) আবুল মনুসর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০) হুমায়ুন, কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২) ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) একুশে পদক (১৯৯৬) লাভ করেন।

২. পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন এবং পবিত্র, মানবিক সম্পর্কের নাম ‘প্রেম’। প্রেমকে রাহাত খান জীবনের মতোই গভীর এবং ব্যাপক করে তুলেছেন তার উপন্যাসে। প্রেম কেবল শারীরিক উত্তেজনার নাম নয়, প্রেম তার কাছে জীবনেরই নামান্তর। প্রেমের শিখা তিনি জ্বলতে দেখেছেন জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে। প্রিয় নারী বা প্রেমিকাকে তিনি দেখেছেন রক্তে–মাংসের আবেগে কম্পিত নারী হিসেবে। ঘ্রাণ না নেয়া ফুলের মতো নয়, সে নারীকে নিয়ে শয্যা যাপনের দুঃসাহসও তিনি দেখেন। ফ্রয়েড মেমন বলেছেন-‘সেক্স ইজ মেইন স্প্রিং অব হিউম্যান লাইফ।’ আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যৌন চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুনতে কদর্য লাগলেও এই চরম সত্যটি অস্বীকার করা যায় না। জীবনলোভী এবং জীবনপ্রেমী মানুষ রাহাত খান জীবনকে ‘চেটেপুটে’ খেতে ভালোবাসেন। এজন্যই রাহাত খানের উপন্যাসে নর–নারীর সম্পর্ক, শারীরিক লেনদেন নিরাভরণ, অনেকটা খোলামেলা। দেহহীন প্রেম বা প্লাটনিক প্রেমে তিনি বিশ্বাসী নয়। কারণ, দেহকে কেন্দ্র করেই প্রেমের উৎপত্তি, প্রেমের অভিযাত্রাও দেহের দিকে। যদিও প্রেম শেষ পর্যন্ত দেহকে অতিক্রম করে যায়, হৃদয়বৃত্তির অনন্ত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে দেহাতীত মহিমা অর্জন করে।

বৈষ্ণব তত্ত্বে যেমন জীবাত্মা ও পরমাত্মার কথা বলা হয়, লালনের দেহতত্ত্বে যে সাধন–ভজন, খাঁচা ও অচিন পাখি প্রতীকী তাৎপর্য লাভ করেছে, সেটাই মরমী প্রেম। রাহাত খানের উপন্যাসপ্রেম জাগতিক, শারীরিক এবং প্রজ্বলিত চিতার মতো। রাহাত খানের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় (২০০২) এক প্রিয়দর্শিনী (১৯৮৩) ছায়াদম্পতি (১৯৮৪) আকাঙক্ষা (১৯৯৬) এবং ‘আমার সময় (২০০৫) উপন্যাসে ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত রাহাত খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবন শুরু করেন জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে। তারপর ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজ, ঢাকা জগন্নাথ কলেজ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে প্রায় আট বছর তিনি অধ্যাপনা করেন।

১৯৬৭ সালে জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতা পেশায়। সাংবাদিকতার পেশাগত প্রয়োজনে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থাকা, ক্ষমতার শক্তি, দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে রাহাত খান খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি মূলত গল্পই লিখেছেন। সাংবাদিকতা সূত্রে জীবনকে বড় ক্যানবাসে দেখার সুযোগ ঘটে এবং তিনি গল্পকার থেকে ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠেন। ১৯৮২ সালের মধ্যে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় পর পর লিখে ফেলেন তিনটি উপন্যাস-‘ব–দ্বীপের ভবিষ্যৎ’ ‘অমল ধবল চাকরি’ এবং ‘এক প্রিয়দর্শিনী’। সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখেন ‘হে অনন্তের পাখি’। পত্রিকার পৃষ্ঠায় আমরা তখন এসব উপন্যাস মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। রাহাত খান এরপর অনেক উপন্যাস লিখেছেন-‘ছায়া দম্পতি (১৯৮৪) হে শূন্যতা (১৯৮৪) সংঘর্ষ (১৯৮৪) শহর (১৯৮৪) আকাঙক্ষা (১৯৯৬) হে মাত:বঙ্গ (১৯৯৭) প্রতিপক্ষ (১৯৯৮) মধ্য মাঠের খেলোয়াড় (২০০২) আকাশের ওপারে আকাশ (২০০৪) দিন যায় দিন আসে (২০০৪) ছায়াপাত (২০০৫) গন্তব্যে (২০০৫) ইত্যাদি। গত চার দশকে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে রাহাত খানের অবদান খুব সামান্য নয়। রাহাত খান সুনির্দিষ্ট কোনো কমিটমেন্ট নিয়ে সাহিত্য রচনা না করলেও তাঁর লেখায় রয়েছে বড় ধরনের কমিটমেন্ট। মানুষের অস্তিত্ব, মানবিক সম্পর্ক, প্রেম–যা চিরায়ত ও সার্বজনীন, এটাই তাঁর সাহিত্যের বড় কমিটম্যান্ট। সেই প্রজ্বলিত প্রেমকে দেখতে পাই। ‘মধ্যমাঠের খেলোয়াড়’ উপন্যাসের নায়ক জাফর। পুরাণ ঢাকার আটঘারিয়া লেনের পলেস্তারা খসা ঘরের বাসিন্দা জাফরের সঙ্গে লাইলীর সম্পর্ক। যদিও সে সম্পর্ক খুব গভীর নয়ণ্ড আড্ডা মারা, খুনসুটি করা, বাজি ধরে হেরে যাওয়া–এই ধরনের।

‘লাইলী মেয়েটা ভালো বেশ লম্বা দেখতে। একটু রোগা মুখ,

চোখ দু’টি খুব টলটলটে সুন্দর। আমরা কোনো চিটি চালাচালি

করিনি, একবারও চুম্মুটুমু খাইনি… তবু বছর দেড়েক থেকে আমি

লাইলী বেশ আগডুম–বাগডুমের মধ্যে আছি।’

আগস্ট মাসে লাইলী ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর চলে গেছে। তার বাবা ফিদা হোসেন স্বাধীনতার পর জাসদের রাজনীতি করতে গিয়ে জেল খেটে, শিক্ষা হয়েছে। টঙ্গির কারখানা নামমাত্র মূল্যে বেচে পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছে। সিঙ্গাপুরে এক লাখ টাকা ইনভেস্ট করতে পারলে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। জাফরের ইচ্ছা, সেও কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যাবে। লাইলী চলে যাওয়ার পর বাদল একটা সরকারি ফার্মে জাফরকে সিকিউরিটি ইনচার্জের চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিল। অফিসের কেরানি ফারুক এবং এক পিয়ন গোপনে মাল চুরি করার সময় জাফর তাদের ধরে মার দেয়। পর দিন জি. এম সাহেব ফারুককে মারার অপরাধে জাফরকে চাকরি থেকে বাদ দেয়, চুরির বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। জাফর ছোটবেলা থেকেই ওয়ারি ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলে। জুনিয়ার লীগ, বি–টিম, লীগ খেলা, মারপিট, ডোনেশন কালেকশন এসবের সঙ্গে জড়িত ছিলো জাফর। বাদল, আমিন, খান্না এদের সঙ্গে ফুটবল খেলে। খেলোয়াড়দের ফর্মে থাকতে হলে নিয়মিত কোচ, অনুশীলন করতে হয়। লাইলী চলে যাওয়ার পর জাফর কিছুতে মন দিতে পারে না। জাফরের ইচ্ছা, কিছু টাকা জমিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যাবে। এর মধ্যে খালাতো ভাই ওমর আলী চমৎকার গল্প–উপন্যাস লিখতো কিন্তু বড় খ্যাতির আশায় ফিল্ম লাইনে ঢুকে পলিটিক্সের শিকার হয়ে এখন চরম দুর্দশা। স্ত্রী সায়মাসহ ওমরকে নিজের বাসায় তোলে। ওমর ফিল্মের শুটিংয়ে কয়েক দিনের চিটাগাং গেলে এর ফাঁকে জাফর সায়মাকে কৌশলে হাত করে দৈহিক সম্পর্ক। প্রথম উপগত একটু ঝক্কিঝামেলা হলেও পরে সায়মা নিজেই নিয়মিত ডেকে নেয় জাফরকে। সায়মা এখন ফিল্ম স্টার। জাফর তারপর তার পৈতৃক বাড়ি জব্বারপুরে যায়। উদ্দেশ্য চাচা সদরুদ্দিনের সঙ্গে থেকে কাঠের ব্যবসা শিখবে। কাঠের ব্যবসা করে টাকা জমায়ে সিঙ্গাপুর চলে যাবে লাইলীর কাছে। চাচা সদরুদ্দিনের বিরাট কাঠের আড়ৎ, তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। জব্বারপুর এসে জাফর কিছুদিন বাল্যবন্ধু নেয়ামতের চা দোকানে আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়। এমন সময় একদিন দেখে চাচার বন্ধু জব্বারপুর পুলিশ ফাঁড়ির দারোগা দেলোয়ার হুসেন কাজের মেয়ে পদিনাকে নিয়ে হুটোপুটি খাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে পদিনার হাসি–অসংলগ্ন আওয়াজ শুনে জাফর বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটা খড়ের আঁটি ছুঁড়ে মারে। সাথে সাথে পদিনা শাড়ি ঠিক করতে করতে বেরিয়ে যায়। দেলোয়ার হুসেন জাফরের সামনে পড়ে– ‘কী ভাতিজা, কেমন আছ।’ বলে। কিছুদিন পর দেলোয়ার হুসেন বলেন-‘আসমার সাথে শাদী লাগিয়ে দিলে কেমন হয়?

: তা কি করে হয় ?

: আরে ভাতিজা, চাচাতো ভাইবোন বিয়ে শাদী কি হয় না? আপনার মতটা কি তাই বলেন, একটা ধুমধাম হৈ চৈ জব্বারপুরে হয়ে যাক।’ জাফর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেয়ামত গভীর রাতে ডেকে বলে, জাফর তোর খুব বিপদ। এক্ষণি কাপড়চোপড় নিয়ে বেরিয়ে আয়। থানার সেকেন্ড অফিসার দেলোয়ার দলবল নিয়ে তোকে এরেস্ট করতে আসছে। অভিযোগ তুই নাকি কাদের সিদ্দিকীর লোক।

জাফর রাতের অন্ধকারে জব্বারপুর থেকে পালিয়ে এসে যায় হাতিবন্ধ্যা গ্রামে ছোটবেলার বন্ধু জিয়াউদ্দিনের বাড়িতে। জিয়াউদ্দিন, জমির উদ্দিন, আদিল উদ্দিন তিন ভাই। বিশাল একান্নবর্তী সংসার, বছরে হাজার মণ ধান, পাট, কাজের লোক আছে। গৃহকর্তী আয়েশা খাতুন আদিলের স্ত্রী, তার কথায় চলে সংসার। হাতিবান্ধায় সবুজ মাঠ, নীল আকাশ দেখতে দেখতে এক দিন চন্দ্রালোকিত রাতে নদীর নির্জন বালু চরে অপরূপ এক নারীর কণ্ঠ শুনতে পায়। গান গাইতে গাইতে সে বানেচা পরীর মতো আকাশে উড়ে যেতে চায়। পরে জানা যায় ও হচ্ছে আমেনা। বাড়ির কাজের মেয়ে, অপরূপ সুন্দরী কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে পরীতে পায়, তখন অন্যরকম হয়ে যায়। হাতিবান্ধা থেকে জাফর খেলোয়াড় খান্নাকে চিঠি লেখে। ওদিকে জব্বারপুরের কেইসে পুলিশ তাকে খুঁজছে। ঢাকায় গেলে সে পুলিশ ধরে ফেলবে। চাচা এজমালী সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য মেয়েকে বিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে, তার থেকে জাফরের বাঁচার উপায় নেই। এছাড়া নানা নারী সম্ভোগের ঘৃণিত স্মৃতি জাফরকে নিত্য তাড়িয়ে ফেরে। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে আমরা দেখি পরীতে পাওয়া নারী আমেনাকে ঝাড়ফুক করার জন্য ওঝা আসে। শুরু হয় জ্বিন তাড়ানোর নামে আমেনার ওপর পৈশাচিক অত্যাচার। জাফর নিজের চোখে দেখে সহ্য করতে পারে না। জ্বিন ছাড়ালে আমেনাকে বিয়ে করবে আদিল। ওঝা আমেনাকে লাথি কিল এবং আগুনে বাঁশ পুড়িয়ে ছেঁকা দিলে আমেনা বিকট শব্দে চিৎকার শুরু করে। জাফর তখন ওঝার হাত থেকে আমেনাকে বাঁচানোর জন্য ওঝাকে ঠেলে ফেলে দেয়। ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। জাফর তখন বলে-‘আদিল ভাই, আমেনাকে আমি বিয়ে করবো।’ পরদিন জিয়াউদ্দিন জাফর এবং আমেনাকে ট্রেনে তুলে দিতে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত আসে। ট্রেনে জাফর আমেনার হাত ধরে চা খাবে কিনা ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করতেই আমিনা বলে–হ্যাঁ। উপন্যাসটি শেষ হয় এভাবেণ্ড

‘ব্যস। এটুকু যথেষ্ট। আমার শক্তি আমি পেয়ে গেছি। গোটা জব্বারপুর আমি এখন মোকাবেলা করতে পারি। আমি জীবনের মাঠে খেলতে নেমে একটা চমৎকার গোল করে ফেলেছি। আমি জয়ের স্বাদ পেয়ে গেছি। আমি পারবো।’

জাফরের এই অভিব্যক্তির মধ্যে যে প্রেমণ্ড শক্তি, দৃঢ়তা, আত্মপ্রত্যয় খুঁজে পাওয়া যায়, তা কোনো অর্থ–বিত্ত বা কোটি টাকার সঙ্গে তুলনা হয় না। প্রেম–ভালোবাসার মধ্যে জীবনের যে সার্থকতা, তা অধিকাংশ প্রেমিক–পুরুষ উপলব্ধি করতে পারে না। ‘ভালোবেসে একজন নারীর হৃদয় জয় করা মানে বিশ্ব জয় করা’ এই আপ্ত বাক্য এমনিতে সৃষ্টি হয়নি। রাহাত খান তাঁর উপন্যাসে প্রেমকে দেখেছেন জীবন জয়ের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে।

‘এক প্রিয়দর্শিনী’ (১৯৮৩) উপন্যাসের পটভূমি জার্মানের বার্লিন শহর। সাংবাদিকতার উপর একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য নয়টি দেশের মোট চৌদ্দজন ছাত্রছাত্রী একটা (হেইম) ছাত্রাবাসে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার নাদিয়াক ও সাঙিয়াঙ, তাইওয়ানের চিয়াং ও টিনা, ফিলিপাইনের রুডলফ ও এভলিন পিলি, চিলির মারিয়া পাস, বাংলাদেশের মি. খান, ভারতের রমেশচন্দ্র তরুণ বসু, শ্রীলঙ্কার সুনীল প্রেমতিলক, জর্ডানের ফৈয়াজ, সারিতা এদের মধ্যে প্রাত্যহিক কথাবার্তা, পারস্পরিক সম্পর্ক, বার্লিনের জীবন–যাপন, নানা খুনসুটি উপন্যাসের প্রধান বিষয়।

যদিও মদ খাওয়া, ডিস্কোতে যাওয়া, রুমে রুমে আড্ডা দেয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের একটা আনন্দমুখর সময় কাটে।

কারো কারো মধ্যে প্রেম, চুমু, আলিঙ্গন, দৈহিক মেলামেশা হতেও দেখা যায়। তরুণ বসু মি. খানকে বলছেণ্ড

‘বলে রাখছি দাদা, বার্লিন থেকে যাওয়ার আগে অন্তত কোয়ার্টার সেঞ্চুরি পুরো করে যেতে হবে। না, না, ভুল বুঝবেন না। নারী জাতিকে আমি অতিশয় শ্রদ্ধা করি। এই পবিত্র জল স্পর্শ করে বলছি দাদা বিশ্বাস করুন। আমার চোখ মাংসাশী চোখ নয়, যদি অপরাধ না নেন তো বলি, এই দীনের চোখ প্রেমিকের চোখ।’

বোঝা যায় পাশ্চাত্যের ফ্রি মিশিংয়ের আমাদের সমাজ–সংস্কৃতির তুলনা অর্থহীন। এ উপন্যাসের একটি জায়গায়, ভারতের তরুণ বসু ও বাংলাদেশের মি. খান যখন বাংলায় কথা বলে, তখন অন্য দেশের ছাত্রছাত্রীরা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, এই ভাষায় পৃথিবীর কত লোক কথা বলে? তখন তারা প্রথমে টেগর এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের কথা উল্লেখ করে। এতে খুব সহজে বাংলা ভাষার অবস্থান পরিষ্কার বোঝানো সম্ভব হয়। ‘প্রিয়দর্শিনী, উপন্যাসে কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এর সঙ্গে ওর প্রেমময় সম্পর্ক হয়, সম্পর্ক ভাঙ্গে, নানা ঘটনা, নানা প্রসঙ্গ, দেশ–জাতি, রাজনীতি, আন্তঃদেশীয় নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি, মি. খানের সঙ্গে চিলির মেয়ে মারিয়ার প্রেম, বিয়ের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত গড়ায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত মারিয়া টেলিফোনে বলে– ‘বাঁধানো টবের ফুলগাছ আর হতে চাইনা।… ভালোবাসার শেষ চুমুটা তাই টেলিফোনে দিচ্ছি। ’খান, তুমি বুঝতেই পারছ, বিয়ের মতো কোন গুরুতর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার মন–মানসিকতা এখন নেই। … মনে রেখ, চিরকাল আমি দাবি করবো যে তোমার মঞ্জু চৌধুরীর চাইতে আমি দেখতে সুন্দর।’

অর্থাৎ প্রিয়দর্শিনীর সঙ্গে মি. খানের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিয়ে না হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। বিয়ে হয়ে গেলে খানের জীবনে মারিয়া আর প্রিয়দর্শিনী অর্থাৎ তার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী হয়ে থাকতো না। মারিয়া হয়ে যেতো গড়ায় তোলা তৃষ্ণার জলের মতো। প্রেম এভাবে মহৎ, বৃহৎ, অবিস্মরণীয় হয়ে আছে সবার জীবনে।

‘ছায়া দম্পতি’ (১৯৮৪) ঢাকার নাগরিক, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংসার, দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়েই কাহিনি গড়ে উঠেছে। মাহবুব, আব্দুল্লাহ, কিচলু তিন বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষ করে কেউ ইনডেন্টিং, কেউ ট্রেডিং, কেউ ইন্ডাস্ট্রি ব্যবসায় বেশ ভালো উন্নতি করেছে।

মধ্য ষাটের দশকে ওসব ব্যবসায় খুব লাভ ছিল। তিন বন্ধুর স্ত্রী, মাহবুবের স্ত্রী চেমন আরা, আব্দুল্লাহর স্ত্রী লিলি, কিচলুর স্ত্রী সাবিনা–যে যার স্ত্রীতে আটকে পড়েছে। কে কতোখানি স্ত্রী শাসিত পরিবারের মানুষে পরিণত হচ্ছে, তা নিয়ে গল্প এবং রস–রসিকতা হয়। অবসরে একজনের বাসায় অন্যজন যায়, আড্ডা দেয়, পার্টিতে খাওয়া দাওয়া হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, ঢাকা শহরের পরিবর্তন, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন এগুলোও উঠে আসে উপন্যাসে। কিচলুর সংলাপে ঢাকা শহরের পরিবর্তন উঠে আসে এভাবে–

‘দ্যাখ এই কবছরে ঢাকা শহরের কি চেঞ্জ! ডি.আই.টি. ছিলো আমাদের সময় টপ বিল্ডিং। গুলিস্তানের দিকে যাবে ভাবলে পাগল হয়ে যেতাম। এখন ডি আই ডি ফু:। মতিঝিল দিলখুশায় ইঁদুরের মতো লাগে ঐ বিল্ডিংটা, আর গুলিস্তানের দিকটা মনে হয় ওল্ড ঢাকারই অংশ।

তিন বন্ধুর জীবনেও পরিবর্তন আসে। আব্দুল্লাহ একদিন অসময়ে বাসায় এসে চুপিচুপি খোলা দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকে দেখতে পায়, তার স্ত্রী লিলি বিছানায় ঝুঁকে পর্ণগ্রাফি পত্রিকা দেখছে। স্ত্রীর অজান্তেই বাইরে বেরিয়ে কলিং বেল টিপে আবার বাসায় ঢোকে। তখন ছায়ার মতো কাউকে দেখে। আব্দুল্লার মনে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ জন্মে। পরে সে বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করে। মাহবুবও তার স্ত্রী চেমন আরার মধ্যে অন্য কারো ছায়া দেখতে পায়, তার মনেও স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ জেগে আছে। এভাবে আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী লিলির দাম্পত্য জীবনে অন্য পুরুষের ছায়া অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্ত্রীর গয়নার বাক্সের মধ্যে পর্ণগ্রাফির ম্যাগাজিন আবিষ্কার করে। দু’জনের দাম্পত্যের মধ্যে চিড় ধরে যায়। উপন্যাসের শেষে ‘লিলির কথা’ ‘আব্দুল্লার কথা’ শিরোনামে বর্ণিত ঘটনার মধ্য দিয়ে নেপথ্য রহস্য বেরিয়ে আসে। আব্দুল্লাহ লিলিকে প্রশ্ন করে, লিলি জবাব দেয়। দু’জনের কথোপোকথন–

‘ : যাওয়ার দু একটা কথার জবাব দিয়ে যাবে লিলি?

: বলো।

: কি ধরনের পুরুষ তোমার পছন্দ ? সালমানের মতো ? ডেভিডের মতো ? লিলি কোনো জবাব দেয় না।

: বিদেশ যাওয়ার কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলে কেন ? ডেভিডের ব্যাপারটা জেনে ফেলবো সেই ভয়ে ?

: আমার মনে হয় তুমি বনানীর মতো হতে চেয়েছিলে।

ফ্রি সেক্স। কোয়ার ফ্রি লাইফ। দ্যাট বনানী ইজ, তুমি ওর কমটাই হতে চেয়েছিলে।

ঘরে আলোজ্বলে দেখি লিলি নেই। বারান্দায় বসেছিল। কাঁদছিল।

: আমি তোমাকে ক্ষমা করতে রাজি আছি।

লিলি বলল : না।

আমি কাঁধ স্পর্শ করে বললাম : লিলি আমার সন্তান ?

লিলি হু হু করে কেঁদে ভেঙে পড়ল আমার বুকে।’

‘ছায়া দম্পতি’ উপন্যাসের এই সমাপ্তির মধ্য দিয়ে নাগরিক মধ্যবিত্তের আঁতের কথা উন্মোচিত হয়েছে। রাহাত খান খুব দক্ষতার সঙ্গে ঢাকার নাগরিক মধ্যবিত্তের অন্ত:জীবনকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করেছেন। শরীর বা সেক্সই দাম্পত্য জীবনের একমাত্র সম্পর্কের সূত্র নয়, বিবেক, মানবিক কারুণ্য এবং যুক্তির শৃঙ্খলা দিয়ে তিনি ‘ছায়াদম্পতি’ উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণ করেছেন। ঢাকা শহরের ষাট ও সত্তর দশকের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন, মদ্যপান, পার্টি, হোটেলে রাত্রিযাপন, অন্য নারীতে আসক্তি–এসব সমকালীন বাস্তবতা ‘ছায়াদম্পতি’ উপন্যাসের কাহিনিতে স্থান পেলেও শেষ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ এবং সুলতানা লিলির ব্যক্তিগত জীবন প্রাধান্য লাভ করেছে। তাদের দাম্পত্য ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সময়ের নাগরিক বাস্তবতার চিত্র।

‘আমার সময়’ (২০০৫) উপন্যাসটিকে আমি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে চাই। কারণ, এই উপন্যাসটিতে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন রাহাত খান। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোকের চরিত্রও বদলে যায়। স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকরা প্রথম কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকলেও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বোল পাল্টিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠে। এ উপন্যাসের ইমদাদ হোসেন সব আমলের প্রথম দিকে একটু বেকায়দায় থাকেন। পরে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। কয়েক ডজন বাসের মালিক, তেয়াত্তরে ইলেকশান করেছেন মাছ মার্কায়।

জনগণের উপর মহা ক্ষেপা। সে উপন্যাসের নায়ক ইফতেখার আহমদ জয়কে বলেণ্ড ‘অনেস্ট আর সেনসিয়ার থেকে লাভ কি ? মিয়ারা ভোট তো দেও নৌকা মার্কায়।’ পঁচাত্তর সালের শেষে নিজেই একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে পত্রিকায় বিবৃতি দেয়। ইমদাদ হোসেন একদিন জয়কে বাসায় যেতে বলে। জয় তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করে মাসে সাড়ে সাতশ’ স্কেলের একটা চাকরি খুঁজছে। চাকরি পেলে সে পুরানা পল্টন, সেগুনবাগিচা এলাকায় দুই কামরার একটা ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নেবে। বাসায় দেখে ইমদাদ হোসেনের মেয়ে সিমি, দু’জনেই পূর্বপরিচিত বলে খুনসুটি করে। ইমদাদ হোসেন জয়কে পাঠায় চৌধুরী আখতারুজ্জামানের কাছে। লেখাপড়া জানা, স্মার্ট, ইসলামী ওরিয়েন্টেড একটা ছেলে দরকার। বিশাল একটা প্রজেক্ট আছে। বাড়িতেই নিচের তলায় চৌধুরী আখতারুজ্জামান অফিস খুলে বসেছেন। প্রজেক্ট হচ্ছে– ‘হারানো মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার প্রজেক্ট।’ লোক সমাজের কতগুলো লষ্ট ভ্যেলুজ আবার মানুষের মধ্যে ফিরায়ে আনা। যেমন বিশ্বাস। বিশ্বাস জিনিসটা এখন সমাজ থেকে উঠে গেছে। এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনা। চৌধুরী আখতারুজ্জামান এক সময় আমলা ছিলেন, শেষে কিছুদিন মিনিস্টারও ছিলেন। ইংরেজিতে নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন। সেটি বাংলা অনুবাদ করতে গিয়ে জয়ের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কাওছারি বেগম নামে তিরিশ বছরের ছোট এক ননবেঙ্গলি মহিলাকে বিয়ে করেন। কাওছারি বেগমের কাছে হৃদয় নয়, জীবনের জৌলুসটাই প্রধান।

১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনজন বিদেশী টমাস হপকিন্স, রাশিয়ান অলেকান্ডার পেশকমভ, কানাডার মিস ওয়ারেন পার্সি এসেছিলেন বাংলাদেশের হারানো মূল্যবোধের ওপর গবেষণা করতে। তারা দীর্ঘদিন এখানে থেকে যে রিপোর্ট লিখে গেছেন তার সারমর্ম হলো– ‘বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের একদা সৎ, বিশ্বাসী, ঈশ্বর প্রেমিক ও মানব কল্যাণবাদী জনগণের উত্তর পুরুষদের মধ্যে ক্রমেই মূল্যবোধের সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে। তাদের এখন ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই কমে আসছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় অকেজো। দাড়িওয়ালা মৌলানা, মোল্লা–তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ভয়াবহভাবে হ্রাস পাওয়ার পথে। … বিদ্যালয়ের সিলেবাস এমনভাবে করা হয়েছে যে, বিদ্যার্থীরা সেখানে অরাজকতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরই অধিকারী হয় কেবল। যে সমুদয় মূল্যবোধ তাদেরকে ঈশ্বর বিশ্বাসী, সৎ, সুবোধ নাগরিকরূপে গড়ে তুলতে পারতো, সেইসব মূল্যবোধের শিক্ষা সেখানে প্রায় অনুপস্থিত। শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে পিতামাতাকে অগ্রাহ্য ও অমান্য করা, সরকারকে অকারণে নিন্দা সমালোচনা করা, চুরি, ডাকাতি নারীর ওপর দৌরাত্ম্য ইত্যকার অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তার জীবনের উচ্চাকাঙক্ষা কি? সে জানায়, তার উচ্চাকাঙক্ষা রাজনীতি করা। প্রতিক্রিয়াশীল ও বুর্জোয়া সমাজ কাঠামো ভেঙে দিয়ে সেখানে মেহনতি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। জিজ্ঞেস করলাম, মানব সমাজের শাশ্বত মূল্যবোধগুলো তোমার ধারণা কি ? সে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা না করে বলে, এসব মূল্যবোধের োগান সাম্রাজ্যবাদীরাই দিচ্ছে। যুবকটি নির্দোষ। তার বিদ্যালয়, তার শিক্ষক, তার পরিবেশ তার অভিভাবক তাকে আদি ও অকৃত্রিম মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় নি।

ইফতেখার আহমদ জয় এসব পড়ে, চৌধুরী আখতারুজ্জামানের প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে এসব ডিক্টেশন দেয়। নয়নের বাবা ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির মেম্বার ছিল, দেড় বছর পলাতক থেকে আবার ভেসে উঠেছে। এখন বিরাট কন্টাক্টর। তার বন্ধু নিযামুদ্দিন সিনেমার পরিচালক। নয়নদের তিন তলা বাড়িতে স্যুটিং চলছে। জয়, অরুপ, ওসমান, মিন্টু ওখানে যায়। সহনায়িকা বুলবুলির কাছে তাদের জার্নালিস্ট পরিচয় খাতির, ড্রিং চলে, মদ খেতে খেতে ইফতেখার আহমদ জয় ভাবে–মুঠভর্তি ক্ষমতা যদি সে পেয়ে যেত, তাহলে সাড়ে সাতশ’ টাকা স্কেলে চাকরি, পুরানা পল্টনের দিকে দু’কামরার একটা বাসা, ইমদাদ হোসেন মন্ত্রী হয়ে ফ্ল্যাগ লাগানো গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে চাওয়া, চৌধুরী আখতারুজ্জামান চান চারিদিকে ইসলামী ওরিয়েন্টশনের চাষ, বুলবুলি চায় সিনেমার নায়িকা হতেণ্ড সবার হতে চাই আকাঙক্ষা ইফতেখার আহমদ জয় একাই পূরণ করে দিতে পারতো। চৌধুরী আখতারুজ্জামান চান তার ছোট ছেলে এয়ারনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তায়েফের সঙ্গে ইমদাদ হোসেনের মেয়ে সিমির বিয়ে দিতে। কিন্তু এলাকার সবাই জানে সিমি হাসানের এয়ারমার্ক করা মাল। তার দিকে ফিরেও তাকানো যাবে না। ইফতেখার ভাবে সিমি যদি তার কাছে আসে, তবে হাসানের অনুরোধ– ‘সিমিকে তুই ভুলে যা।’ খামোখা সে সিমিকে ভোলার চেষ্টা করবে কেন ? সে সিমির জন্য অপেক্ষা করে। সিমি পেলে সে হাসানকে থোড়াই কেয়ার করবে। দু’রুমের বাসা ভাড়া করে সিমিকে নিয়ে থাকবে সে। ‘আমার সময়’ উপন্যাসের নায়ক ইফতেখারের আকাঙক্ষা, সমকালীন বাস্তবতার দ্বন্দ্ব মিলে উপন্যাসটি যেন রাহাত খানের আত্মজীবনী হয়ে উঠেছে। রাহাত খান হয়ে উঠেছেন সত্তর দশকের এক নির্মোহ কথক, আশ্চর্য এক কথাশিল্পী।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত